হাইলাইটস
- কার্ত্তিকস্বামী মন্দির। হঠাৎ করেই একদিন কী ভাবে যেন নামটা শুনে ফেললাম!
- বিগত কয়েক বছর ধরে যা কিছু অপরিচিত, তা খুঁজি অন্তর্জালের আঙিনায়। এই নামটাই বা বাদ যায় কেন?
- কাগজের বল নিয়ে খেলতে অভ্যস্ত ছোট্ট শিশু একদিন বিশাল বড় আঙিনায় খেলতে নেমে যেমন দূরে পড়ে থাকা লালরঙা বলটাকে দেখে বিস্ময়ে তাকায়, তেমন ভাবেই কয়েক মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়ালাম গুগল সার্চে ‘কার্ত্তিকস্বামী’ লিখে খুঁজে পাওয়া কয়েকটা স্থিরচিত্র আর তথ্য দেখে। তিন দিক জুড়ে রয়েছে তুষরাবৃত হিমালয়।
কার্ত্তিকস্বামী মন্দির। হঠাৎ করেই একদিন কী ভাবে যেন নামটা শুনে ফেললাম! বিগত কয়েক বছর ধরে যা কিছু অপরিচিত, তা খুঁজি অন্তর্জালের আঙিনায়। এই নামটাই বা বাদ যায় কেন? কাগজের বল নিয়ে খেলতে অভ্যস্ত ছোট্ট শিশু একদিন বিশাল বড় আঙিনায় খেলতে নেমে যেমন দূরে পড়ে থাকা লালরঙা বলটাকে দেখে বিস্ময়ে তাকায়, তেমন ভাবেই কয়েক মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়ালাম গুগল সার্চে ‘কার্ত্তিকস্বামী’ লিখে খুঁজে পাওয়া কয়েকটা স্থিরচিত্র আর তথ্য দেখে। তিন দিক জুড়ে রয়েছে তুষরাবৃত হিমালয়। হাত ধরাধরি করে থাকা শৃঙ্গগুলির কেউ বন্দরপুঞ্চ, আবার কেউ কেদারনাথ ডোম, চৌখাম্বা, হাতি পর্বত, নীলকণ্ঠ, দ্রোণগিরি কিংবা নন্দাঘুন্টি। রয়েছে ত্রিশূল নন্দাদেবী, মেরু ও সুমেরু পর্বতশ্রেণিও। ছোটবেলার পাঠ্যবইয়ে কপালকুণ্ডলার অংশবিশেষ ‘সাগরসঙ্গমে নবকুমার’ পড়ার সময় একটি লাইন পড়েছিলাম, ‘আহা! কি দেখিলাম! জন্মজন্মান্তরেও ভুলিব না।’ নিজের অজান্তেই যেন সেই কথা মুখ থেকে বেরিয়ে এল।
তারপর না জানি কত স্বপ্ন দেখেছি, অপরের চোখ দিয়ে দেখা ভ্রমণবৃত্তান্ত অধীর আগ্রহ নিয়ে শুনেছি, কল্পনা করতে করতে যেন দেখার আগেই দেখে ফেলেছি এ পথের দৃশ্য। শুধু ভেবেছি কবে যাওয়া হবে? আদৌ যাওয়া হবে কি? তবে সুযোগ এল খুব তাড়াতাড়িই। ভাবলাম, বরফের দেশে শীতের সময়েই যাব। মোটামুটি নভেম্বরের মধ্যেই সম্পূর্ণ ভ্রমণসূচি প্রস্তুত করে নিলাম। ঠিক হল, ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহের শেষে লখনউ, উত্তরাখণ্ডের একাংশ, দিল্লি ও আগ্রার উদ্দেশে বেরোনো হবে। প্রথম তিন দিনে লখনউ ঘুরে সেখান থেকে বাসে হরিদ্বার। হরিদ্বার থেকে ভোরের বাসে কনৌকচৌরি পৌঁছে সেখানে দুই দিন থেকে হরিদ্বার ফিরে বাকি জায়গাগুলি ঘোরা হবে। ব্যস, আর কী! নির্ধারিত দিনে কর্তা-গিন্নী মিলে বেরিয়ে পড়লাম উত্তর ভারত অভিযানে।
লখনউ থেকে সন্ধের বাসে উঠে খুব ভোরে পৌঁছলাম হরিদ্বার। সেখান থেকে সকাল ৭.৩০-এর বাস ধরে রুদ্রপ্রয়াগ। এখানেই অলকানন্দার সঙ্গে মিশেছে মন্দাকিনী। রুদ্রপ্রয়াগ থেকে পথ তিন ভাগে বিভক্ত হয়েছে। একটি গিয়েছে যোশীমঠের দিকে, একটি পোখরির উদ্দেশে এবং তৃতীয় রাস্তা দেওরিয়া তাল হয়ে তুঙ্গনাথে। কার্ত্তিকস্বামী মন্দির কনৌকচৌরিতে। রুদ্রপ্রয়াগ থেকে কনৌকচৌরি যেতে হলে পোখরিগামী বাসে চাপতে হবে। রুদ্রপ্রয়াগ থেকে সে পথে কিছুক্ষণ যাওয়ার পরেই বাসটির সঙ্গে যেন চলতে শুরু করে বরফাবৃত বিভিন্ন শৃঙ্গ। শেষবেলার রোদে তাদের রূপযৌবন যেন উপচে পড়ে! এত দীর্ঘ সময় ধরে পাহাড়ের এমন অপরূপ কান্তি বুঝি কখনও ধরা দেয়নি দুই চোখে। ক্রমে দিনের আলো নিভে এলে শৃঙ্গেরা মেঘের আড়ালে মুখ লুকাল। বাসের জানলা পেরিয়ে দৃষ্টি নামিয়ে তাদের খুঁজতে গিয়ে চোখ পড়ল পথের দুধারে জমে থাকা তুলোর মতো বরফ। শুধু কি পথ, ততক্ষণে আশপাশের গাছপালা, বাড়িঘর সবই মুড়ে গিয়েছে বরফের ঘোমটায়।
কনৌকচৌরি পৌঁছলাম বিকেল পাঁচটায়। জমে থাকা বরফের মাঝে যে একফালি গাড়ির রাস্তা, তারই মাঝে আমাদের নামিয়ে হর্ন বাজিয়ে বাজিয়ে চলে গেল বাস। নিমেষে কুয়াশায় মিলিয়ে গেল তার টেইল লাইটের রেখা। অঝোরে ঝরে পড়া নরম হালকা বরফ জমতে শুরু করল রুকস্যাকে, জ্যাকেটে। ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে চললাম আশ্রয়ের খোঁজে।
এখন আস্তানা খুঁজে পাই কোথায়? অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় নবীন দম্পতি হিমালয়ের হাতছানিতে ভুলে সে কথা আগে ভেবে দেখেনি। কিছুই তো বুক করে আসিনি আমরা! কনৌকচৌরি বাজারে রাত কাটানোর দু’-চারটে হোটেল-হোমস্টে থাকলেও পছন্দ হল না। আসলে আমরা চেয়েছিলাম গ্রামের মানুষের সান্নিধ্যে থেকে আরও বেশি করে পাহাড়ি জীবন ছুঁয়ে দেখতে। করোনা-পূর্ব সে সময়ে এই শখ পূরণে কোনও বাধাও আসেনি। তাই ঠিক হল, কনৌকচৌরি বাজার থেকে এক কিলোমিটার নীচে পোখঠা নামে এক গ্রামেই হবে আমাদের নিভৃতবাস। হিমেল সন্ধেয় দুটি অপরিচিত ছেলেমেয়েকে গ্রামের পথে হাঁটতে দেখে চা খাওয়ার নেমন্তন্ন জানাল স্থানীয় এক পরিবার। শুধু তাই নয়, দুই দিন সে বাড়িতে থেকে যাওয়ার অযাচিত প্রস্তাবও পাওয়া গেল অচিরেই। চা-আড্ডার পরে পাঁচমিশালি ডালের খিচুড়ি সটান ঘুমের কোলে ঢলে পড়তে দেরি হল না।
খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে দেখি বরফে চারদিক সাদা হয়ে গেলেও দারুণ ঝলমলে রোদ উঠেছে। জানতাম পোখঠায় বিশেষ দ্রষ্টব্য কিছু না থাকলেও কার্ত্তিকস্বামী মন্দির পৌঁছাতে পারলে অনেক কিছু দেখতে পাব। জলখাবারের পালা সেরে সঙ্গে কিছু খাবার নিয়ে পা বাড়ালাম গন্তব্যের দিকে। কনৌকচৌরি থেকে কার্ত্তিকস্বামী মন্দির টানা রাস্তা। টুকটাক ট্রেকিংয়ের অভিজ্ঞতা থাকায় গাইডের প্রয়োজন পড়ল না। পথের কিছু জায়গায় হাঁটু অবধি বরফ। গাছের ভাঙা ডাল কুড়িয়ে বরফে গেঁথে খুব সাবধানে এগোতে থাকলাম। আকাশে একটুকরো মেঘও নেই। সূর্যের কিরণ পড়ে শৃঙ্গেরা জ্বলজ্বল করছে, যেন প্রকৃতিদেবী স্নান সেরে অতি যত্নে হিরে-মুক্তোখচিত গয়নায় নিজেকে নয়নাভিরাম করে তুলেছেন। চলতে চলতে মাঝে এক জায়গায় একটু শ্বাসকষ্ট হল। একটু ঝুঁকে মুখ দিয়ে শ্বাস নিয়ে নাক দিয়ে ছাড়ার পরে শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক হল। চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে দু’ ঘন্টার মধ্যেই পৌঁছে গেলাম কার্ত্তিকস্বামী মন্দির প্রাঙ্গনে। মন্দিরের একদম সামনে ঝোলা ইয়াব্বড় ঘন্টার গম্ভীর শব্দে গায়ে কাঁটা দিল। পাহাড়ের দিকে মুখ করে বসে পড়লাম। কতক্ষণ, জানি না।
কার্ত্তিকস্বামী মন্দির নিয়ে এক পৌরাণিক বিশ্বাস প্রচলিত। পুরাণমতে শিব তাঁর দুই পুত্র কার্ত্তিক-গণেশকে ব্রহ্মাণ্ড পরিক্রমার নির্দেশ দেন। গণেশ তার বাবা-মায়ের চারপাশ ঘুরে ঘোষণা করেছিলেন, তাঁর ব্রহ্মাণ্ড পরিক্রমণ সম্পূর্ণ। কিন্তু কার্ত্তিক সত্যি সত্যি পুরো ব্রহ্মাণ্ড ঘুরে এসে যখন দেখেন যে গণেশ জয়ী হিসেবে বিবেচিত হয়েছেন, তখন তিনি খুব রেগে নিজের মাংস-ত্বক মায়ের দিকে এবং হাড় বাবার দিকে ছুঁড়ে দেন। লোক বিশ্বাসে ত্বক-মাংস সমেত কার্ত্তিকের দেহাংশ মায়ের দিক অর্থাৎ দক্ষিণে নিক্ষিপ্ত হয় এবং মুরগানস্বামী নামে পূজিত হন। অন্য দিকে, হাড়-কঙ্কাল সহ দেহাংশ বাবার দিক অর্থাৎ উত্তরে অবস্থান করে কার্ত্তিকস্বামী নামে পূজিত হন। এই সব বিবিধ কারণে কার্ত্তিকস্বামী মন্দির পুণ্যার্থী ও পাহাড়প্রেমী নির্বিশেষে সবার কাছে অত্যন্ত পবিত্র ও গুরুত্বপূর্ণ স্থান হিসেবে বিবেচিত হয়।
পথের দিশা
হরিদ্বার থেকে রুদ্রপ্রয়াগ যাওয়ার পকেটদুরস্ত বাহন বাস। রুদ্রপ্রয়াগ থেকে কনৌকচৌরি পৌঁছতেও সুলভে পাওয়া যাবে বাস। ব্রেক জার্নি এড়াতে চাইলে সরাসরি হরিদ্বার থেকে কনৌকচৌরির বাসও পাওয়া যায়, যদিও তা সংখ্যায় খুবই কম। হরিদ্বার থেকে সকাল সাড়ে ৬টায় আর ওদিক কনৌকচৌরি থেকে হরিদ্বার ফেরার বাস ভোর ৬টায় রওনা দেয়। এ ছাড়া মিলবে প্রাইভেট গাড়ি।
কনৌকচৌরি থেকে কার্ত্তিকস্বামী মন্দির ৩ কিলোমিটার। গোটা পথই পাহাড়ের আঁকেবাঁকে পা ফেলে যেতে হয়। ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে প্রচুর বরফ ছিল বলে একটু অসুবিধা হলেও খুব দুর্গম বলে মনে হয়নি। তবে অনভিজ্ঞদের এ ব্যাপারে লোকাল গাইডের পরামর্শ নেওয়াই উচিত হবে।
থাকার জন্য
কনৌকচৌরি বাজারে থাকার দু’-চারটি হোমস্টে রয়েছে। স্বল্প সংখ্যক হোটেলও আছে। ঘরভাড়া ১০০০ থেকে ১৫০০ টাকার মধ্যে। কার্ত্তিকস্বামী মন্দিরের তীর্থযাত্রীরা মূলত এ সব ঠিকানাতেই ওঠেন। পোখঠা গ্রামের যে ‘হোমস্টে’ -তে ছিলাম, সেখানে প্রতিদিন থাকা-খাওয়ার জন্য মাথাপিছু ৫০০ টাকা দিতে হয়েছিল।
এ ছাড়া, কার্ত্তিকস্বামী মন্দিরের ৫০০ মিটার নীচে পুরোহিতের ঘর রয়েছে। পূজারি স্বয়ং কোনও টাকাপয়সা দাবি না করলেও থাকা-খাওয়া বাবদ সামান্য কিছু অর্থ প্রত্যেকেই দিয়ে থাকেন। মনে রাখা জরুরি, হরিদ্বার থেকে অন্তত বিকেল চারটের মধ্যে কনৌকচৌরি বাজারে না পৌঁছলে, অন্ধকার পাহাড়ি পথ বেয়ে আড়াই কিলোমিটার হেঁটে এই আস্তানায় পৌঁছনো ঝুঁকিবহুল। বরফের মরশুম এড়িয়ে যেতে পারলে দেওরিয়া তাল, চোপ্তা, তুঙ্গনাথ, কার্ত্তিকস্বামী সার্কিট একযোগে দর্শন সম্ভব।
লেখিকা সোহিনী দেবরায় বর্তমানে এক NGO-র সঙ্গে যুক্ত। তাঁর লেখার মূল বিষয় প্রধানত ভ্রমণকাহিনী। তবে রূপকথা, বিজ্ঞানবিষয়ক ও সামাজিক বিষয়ে বেশ কিছু লেখা হয়েছে। এই সময় ডিজিটালের সঙ্গে নিজের ব্যক্তিগত ভ্রমণ অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিয়েছেন সোহিনী।
Lifestyle News in Bengali, লাইফস্টাইল খবর, Health Tips, Fashion Trends and Tips in Bangla
2021-06-10 13:39:54
Source link
Leave a Reply