জীবনে চলতে-ফিরতে যেসব আইনি জটিলতায় পড়তে হয়, পাঠকের উকিল বিভাগে ১৫ দিন পরপর তারই সমাধান পাওয়া যাবে।পাঠকের উকিল বিভাগে আইনি সমস্যার সমাধান দেবেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট এবং ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল নাহিদ মাহতাব। স্পষ্ট করে নিজের সমস্যাটি লিখে পাঠান। প্রয়োজনীয় কাগজের অনুলিপি দিন।
খামের ওপর লিখুন :
পাঠকের উকিল, নকশা, দৈনিক প্রথম আলো
সিএ ভবন, ১০০ কাজী নজরুলইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা
২০০৮ সালের আগস্টে শুধু কাবিনে আমার বিয়ে হয়। দুই লাখ ৫০ হাজার টাকা দেনমোহরের মধ্যে এক লাখ টাকা উসুল ছিল। চাকরি সম্পর্কে সে আমাদের পরিবারকে অনেক মিথ্যা বলেছে। এই মিথ্যা নিয়েও আমাদের কোনো মাথাব্যথা ছিল না। বিয়ের দুই মাস পর দুপক্ষে আমাকে ছেলের বাড়িতে আনুষ্ঠানিকভাবে উঠিয়ে নেওয়ার কথাবার্তা হয়। কথাবার্তা শেষ হওয়ার পর ছেলেরা আমার বাবার কাছে যৌতুক হিসেবে একটি গাড়ি দাবি করে, যা আমার পরিবারের পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। তাই আমার বাবা ও ভাইয়েরা চিন্তা করে দেখলেন, আমাকে উঠিয়ে নেওয়ার আগেই যে ছেলেটি যৌতুক দাবি করতে পারে সেই ছেলের হাতে আমাকে তুলে দেওয়া সম্ভব নয়। আমিও চিন্তা করে দেখলাম বাবা ও ভাইদের সিদ্ধান্তই সঠিক। তাই আমি গত ১৫ অক্টোবর কোর্টের মাধ্যমে তাকে তালাক দিই। তালাকের কাগজপত্র এখনো ছেলে ও চেয়ারম্যানের কাছে পাঠাইনি। এ কাগজ পাঠানোর পর কী আমার তালাক কার্যকর হয়ে যাবে? না এখনই কার্যকর হয়ে গেছে। এখন আমার কথা হচ্ছে, যেহেতু তাকে ডিভোর্স দিয়ে ফেলেছি, তাই আমি কী কাবিনের বা উসুলের টাকা তার কাছ থেকে পাব? যে উকিলের মাধ্যমে ডিভোর্স দিয়েছি সেই উকিল আমাকে বলেছেন, আপনি কি কাবিনের টাকাটা নেবেন না? আমি বলেছি নেব। পরে আমি বললাম, আমাকে কী করতে হবে। তিনি বলেছেন, শুধু কোর্টে মামলা করলেই চলবে। আমার ভাই ও উকিলের মাধ্যমেই কি টাকাটা পাওয়া যাবে?
উল্লেখ্য, আমার আবার দুই মাসের মধ্যেই অন্য জায়গায় বিয়ে ঠিক হয়ে যাবে। আমি কি ডিভোর্স লেটার পাঠানোর পর ৯০ দিনের আগে এবং দুই মাসের মধ্যে বিয়ে করতে পারব?
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক।
মুসলিম পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ ১৯৮৫ মতে, তালাকের নোটিশ সংশ্লিষ্ট চেয়ারম্যান অথবা সিটি করপোরেশনের মেয়রকে পাঠাতে হবে। ওই নোটিশের ৯০ দিন পর আপনার তালাক কার্যকর হবে। চিঠির বক্তব্য অনুযায়ী, আপনার তালাক কার্যকর হয়নি। সুতরাং দুই মাসের মধ্যে আপনার বিয়ে করা সম্ভব নয়। দেনমোহরের বাকি অর্থের জন্য আপনি পারিবারিক আদালতে মামলা করতে পারেন। ভাইকে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দিলে তিনি আপনার পক্ষে মামলা পরিচালনা করতে পারবেন। কিন্তু আইন অনুযায়ী সমঝোতার মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে আপনাকে মামলা চলাকালীন নির্দিষ্ট সময়ে কোর্টে উপস্থিত হতে হবে।
২০০২ সালের ১৩ আগস্ট আমি বিয়ে করি। বিয়ের তিন বছর পর স্ত্রীকে ঘরে আনি। চুক্তি ছিল, স্ত্রী এসএসসি পাস করার পর শ্বশুরপক্ষ তুলে দেবে। পরে আমি তাঁকে উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি করাই। এতে তাঁর ভাই, মা-বাবা রাজি ছিলেন না। নিজের ইচ্ছায় সব করি। উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পর আমার স্ত্রীর মধ্যে কিছুটা পরিবর্তন দেখা যায়। তাঁর বড় ভাইকে বিষয়টি বলি। এরপর স্নাতক শ্রেণীতে ভর্তি করাই। বেশ ভালো ফলাফল করছে সে। কিন্তু এখন স্ত্রী আমার কোনো কথা শোনে না। আমি একটি এনজিওতে ছোট চাকরি করি। বেতন সাড়ে ছয় হাজার টাকা। আমি রাগ করলে সে আমাকে মারতে আসে। এবং মা-বাবা, ভাই-বোন তুলে বকা শুরু করে। সে আমার গায়েও হাত তোলে। প্রায়ই আমাকে আত্মহত্যা করতে বলে। আমি সহজে গায়ে হাত তুলি না। কেননা, আমি এনজিওতে চাকরি করি। এ অবস্থায় আমি কী করতে পারি? স্ত্রীর ভাইয়ের কাছে বিচার দিয়েছি, তাতে কোনো কাজ হয়নি। আমার তিন বছরের একটি ছেলে আছে। আমি কী তাকে ডিভোর্স দিতে পারি? স্ত্রী বলে, আমি ডিভোর্স দিলে যৌতুকের মামলা করবে। কিন্তু আমি কোনো যৌতুক নিইনি। তবে আমি ১০ কাঠা জমি রেখেছি, তাতে স্ত্রীর ভাই ৪০ হাজার টাকা দিয়েছেন। আমি বলেছিলাম, টাকাটা ফেরত নিয়ে নিন, অন্যথায় পুরো জমির দাম দিয়ে দিন। ওই চিঠিটি তাঁরা রেখে দিয়েছেন। ওখানে নাকি এক লাখ টাকা আমি যৌতুক চেয়েছি, তা লেখা আছে।
আমি যে জমি কিনেছি তা আমাদের দুজনের নামে। তালাক দিলে দেনমোহরের টাকা কি ওই জমির টাকা দিয়ে শোধ করা যাবে এবং আমার ছেলে কি আমার কাছে রাখতে পারব?
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
চট্টগ্রাম।
আপনি চিঠিতে স্ত্রীর ঔদ্ধত্য ও অত্যাচারের কথা উল্লেখ করেছেন। পুরুষশাসিত সমাজে এ ধরনের সমস্যা সমাধানের জন্য নির্দিষ্ট কোনো আইন নেই। তবে সাধারণ আইন ও দণ্ডবিধিতে আপনি স্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা করতে পারেন। কিন্তু এ ধরনের মামলা দায়েরের কারণে আপনি সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন হতে পারেন। সুতরাং আপনাকে ভেবে-চিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এ ছাড়া আপনি বিভাগীয় মহিলা অধিদপ্তরের কাউন্সেলিং শাখায় যোগাযোগ করতে পারেন। কাউন্সেলিং শাখা নোটিশের মাধ্যমে আপনার ও আপনার স্ত্রীর কাউন্সেলিংয়ের নির্দিষ্ট তারিখ এবং সময় জানাবে। এ ধরনের কাউন্সেলিংয়ে আপনাদের সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটতে পারে। স্ত্রীকে ডিভোর্স দিতে আপনার কোনো বাধা নেই। সে ক্ষেত্রে আপনাকে দেনমোহরের টাকা পরিশোধ করতে হবে। যেহেতু আপনারা দুজনের নামে জমি কিনেছেন, সেহেতু জমির মূল্য থেকে দেনমোহরের টাকা কর্তন করা যাবে না। তবে আপনি যদি প্রমাণ করতে পারেন যে, আপনার নিজস্ব উপার্জিত অর্থ দ্বারা আপনি ওই জমির মূল্য পরিশোধ করেছেন, সে ক্ষেত্রে ওই জমির ক্রয়মূল্য থেকে দেনমোহরের অর্থ কর্তন করা সম্ভব। আপনার বিরুদ্ধে কোনো মামলা হলে আপনার উচিত ওই মামলায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা। বিবাহ বিচ্ছেদের পর আপনি আপনাদের সম্পত্তি সমঝোতার মাধ্যমে রেজিস্টার্ড বাটোয়ারা দলিলে ভাগ করতে পারেন। বিবাহ বিচ্ছেদের পর মুসলিম আইনে একজন মা তাঁর পুত্রসন্তানকে সাত বছর বয়স পর্যন্ত লালন-পালন করতে পারেন।
আমার বাবার দুটি সংসার। প্রথম স্ত্রীকে তালাক দিলেও গত কয়েক বছর ধরে তিনি সেখানে যাতায়াত করছেন। আমার বাবার দ্বিতীয় সংসারে দুই ছেলে। আমরা দুই ভাই-বোন। আমার বয়স ১৭ বছর আট মাস। আমার বাবার কাছ থেকে গত কয়েক বছর হলো পড়াশোনার খরচ পাচ্ছি না। খাওয়ার খচরও ঠিকমতো পাচ্ছি না। স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের দিয়ে বলেছি, কোনো প্রতিকার পাইনি। এ বিষয়ে আমি জেলার এক জ্যেষ্ঠ আইনজীবীর কাছে গিয়েছিলাম। তিনি আমাকে মামলা করতে বলেন। মামলার জন্য পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে যেতে বলেন। কিন্তু আমার পক্ষে চার-পাঁচ শ টাকাও জোগাড় করা অসম্ভব। তিনি আমার মাকেও নিয়ে যেতে বলেছেন। আমি বাসায় গিয়ে মাকে সব বলি, মা রাজি হন না। কারণ মামলা করলে তিনিসহ আমরা যেটুকু খরচ পাই সেটুকুও পাব না। যা করার আমাকে একা করতে বলেন। মা আরও বলেন, আমার নামে বাল্যকালে কিছু সম্পত্তি লিখে দেওয়া হয়েছে। আমি এখন সেই সম্পত্তি পাব কি না, তা আইনজীবীর কাছে ভালোভাবে শুনতে বলেন। আমি তারপর এক আইনজীবীর কাছে যাই। তিনি বলেন, ২১ বছর বয়সের আগে আমি খাওয়া ও লেখাপড়ার খরচসহ সম্পত্তির কোনো কিছুই পাব না। এরপর আমি এ বিষয়ে অপর এক আইনজীবীর কাছে গেলে তিনি বলেন, খাওয়া-দাওয়া ও সম্পত্তিসহ যাবতীয় খরচ আমার মা পাবেন। আমি পাব না। তিনি একটু পর আবার বললেন, আমার মা নয়, আমার বোন পাবে। এরপর আমি দুটি মানবাধিকার সংস্থার কাছে যাই। তারা বলল, আমি সব পাব। তবে আমার বয়স ১৮ বছর পূর্ণ হতে হবে। বিভিন্ন জনের বিভিন্ন কথায় আমি চিন্তিত ও বিভ্রান্ত হয়েছি। আমার বাবা আমার নামে নানা রকম অপবাদ দেন এবং মিথ্যা অভিযোগ করেন। আমার বাবা একজন বিত্তশালী এবং মামলাবাজ। তিনি কখনো মামলায় হারেন না। আমি লেখাপড়ার খরচ ও ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়ার দাবি করলে তিনি আমাকে বিনা অপরাধে জেলে পাঠাতে চান, পুলিশের ভয় দেখান। আমি জানতে চাই, আমার বাবা কি আমাকে বিনা অপরাধে পুলিশে দিতে পারবেন এবং বাবার কাছ থেকে আমি খাওয়া ও লেখাপড়ার খরচসহ তাঁর বর্তমান সম্পত্তি কীভাবে পেতে পারি?
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
দিনাজপুর।
আপনি চিঠিতে উল্লেখ করেছেন, বাল্যকালে আপনাকে কিছু সম্পত্তি লিখে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ওই সম্পত্তি দান বিক্রি অথবা অন্য কী মাধ্যমে দেওয়া হয়েছে তা উল্লেখ করেননি। ওই সম্পত্তি যদি আপনার নামে ক্রয় করা হয়ে থাকে এবং তা ১৯৮৩ সালের পরে হয়, তাহলে আপনি ওই সম্পত্তির মালিক। কিন্তু যেহেতু আপনি নাবালক সেহেতু সেই সম্পত্তি বিক্রয় বা হস্তান্তর করা আপাতত আপনার পক্ষে সম্ভব নয়। অপরাপর প্রশ্নে আপনি জানতে চেয়েছেন, আপনি বাবার কাছ থেকে ভরণপোষণসহ সম্পত্তি পাবেন কি না। ভরণপোষণের জন্য আপনার মা ও নাবালক ভাইবোনেরা পারিবারিক আদালতে মামলা করতে পারেন। আপনার বাবার সম্পত্তিতে তাঁর জীবিত অবস্থায় আপনার কোনো অধিকার নেই। একমাত্র বাবার মৃত্যুর পর তাঁর উত্তরাধিকারী হিসেবে তাঁর স্ত্রী, পুত্র-কন্যা সম্পত্তির অধিকারী হবেন। আপনার বক্তব্য থেকে এটুকু প্রতীয়মান হয়, বাবার সঙ্গে আপনার সম্পর্কে টানাপোড়েন চলছে। এসব ক্ষেত্রে শুধু আইনের সাহায্যে সমস্যার সমাধান হয় না, ব্যক্তিগত সম্পর্ক উন্নয়নের মাধ্যমে প্রকৃত সমাধান সম্ভব। আইনানুগ পদক্ষেপ নেওয়ার আগে বাবার সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করুন।
আজ থেকে দেড় বছর আগে আমার একটি ছেলের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়। সে আমাকে ভালোবাসতে শুরু করে, আমিও দুর্বল হয়ে পড়ি। কিছুদিন পর আমি অনেক ভেবে-চিন্তে তাকে বুঝিয়ে ফিরে আসি। আমার ফিরে আসাটা মেনে না নিয়ে সে আমাকে, আমার পরিবারের সবাইকে এমনকি আত্মীয়স্বজনকে মোবাইলফোনে মিসডকল, অশ্লীল এসএমএস এবং সরাসরি ফোন করে বিরক্ত করছে। বিরক্তি সইতে না পেরে পরিবারের সবাই আমার মতামত চান। আমি বলি, আমি মরে যাব তবুও এই ছেলেকে বিয়ে করব না। ছেলের মোবাইল ফোনে আমার ছবি ছিল, সেগুলো বিকৃত করে আমার সব আত্মীয়স্বজনের কাছে পাঠিয়েছে। এতে করে আমি পারিবারিক নির্যাতনে আছি। এখনো বিরক্ত করে। এখন আমার মনে হয়, মরে যাওয়া ছাড়া কোনো পথ নেই। আমি কি নিজেকে, পরিবারকে, আত্মীয়স্বজনকে ওই ছেলের হাত থেকে রক্ষা করতে পারব না?
এ ব্যাপারে আমার পরিবারের কেউই আমাকে সাহায্য করতে চায় না। আমি মেয়ে, তাই কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছি না পরামর্শের অভাবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
দিনাজপুর।
আপনি মোবাইল ফোনে মিসড কল ও এসএমএসের কথা উল্লেখ করেছেন। সে ক্ষেত্রে স্থানীয় র্যাব কর্তৃপক্ষকে জানালে তারা দোষী ছেলেটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে। নিরাপত্তাহীনতার কারণে আপনি থানায় আপনার সমস্যা উল্লেখ করে সাধারণ ডায়েরি করতে পারেন। থানা কর্তৃপক্ষ আপনার সমস্যা ডায়েরিভুক্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারে। আপনার উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ নেই। ওপরের যেকোনো একটি ব্যবস্থা গ্রহণ করলে আপনার সমস্যার সমাধান হবে। আবেগপ্রবণ হয়ে আত্মহত্যার চিন্তা করবেন না। আমাদের সমাজে মেয়েদের হয়রানি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে এই ব্যাধির নিরাময় সম্ভব। এসব ক্ষেত্রে নিজেকে সচেতন থাকতে হবে। ভবিষ্যতে এ ধরনের সম্পর্ক গড়ার ক্ষেত্রে আপনাকে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, নভেম্বর ১১, ২০০৯
Leave a Reply