বিশ্বের জনগোষ্ঠীর ১২ শতাংশই মানসিক রোগের শিকার, এ তথ্যটি উদ্বেগের কারণ না হয়ে উপায় নেই। বিশ্বের আনুমানিক ৪৫০ মিলিয়ন মানুষ অথবা বিশ্বজুড়ে প্রতি চারজনে একজনের অসুস্থতা রয়েছে-এ পরিসংখ্যানটি সংশ্লিষ্ট মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করা উচিত।
অথচ এ ধরেনর মানসিক অসুখের অধিকাংশের রোগ নির্ণয় ও সঠিক চিকিৎসা হলে সুফল আসবে এতে সন্দেহ নেই। মানসিক স্বাস্থ্য এবং মানসিক অসুখ হলো প্রতিটি দেশ, সংস্কৃতি, বয়স ও আর্থসামাজিক অবস্থার অংশ।
অথচ এদিকে সংশ্লিষ্ট মহলের নজর কম, অর্থ বরাদ্দ ও সাহায্যও কম। তাই মানসিক স্বাস্থ্য এবং মানসিক অসুখ সম্পর্কে ক্রমাগত অ্যাডভোকেসি করা, এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করা, তাগিদ দেওয়া, মানসিকভাবে অসুস্থ লোকদের জন্য চিকিৎসা, পুনর্বাসন ও সামাজিক মর্যাদার ব্যাপারটিও জোরালোভাবে বলা প্রয়োজন।
মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করা, অ্যাডভোকেসি-এগুলো হলো মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারে উন্নতি সাধন ও অগ্রগতির জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বিষয়।
এ ব্যাপারে পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছিলেন ১৮০০ সালের দিকে ডরোরিয়া ডিক্স এবং ১৯০০ সালের দিকে এলিজাবেথ প্যাকার।
প্রসঙ্গত, আমেরিকার একজন সাবেক ফার্স্টলেডি রোজালিন কার্টারের একটি বক্তব্য উল্লেখযোগ্যঃ ‘১৯৭১ সালে যখন আমি মানসিক ও আবেগজনিত রোগে আক্রান্ত মানুষের চিকিৎসা ও সেবার উন্নয়নে কাজ করছিলাম, তখন খুব কম লোকই মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে বলত।
মানসিক স্বাস্থ্য বলতে শুধু বোঝাত মানসিক রোগ এবং এসব অসুখ, লজ্জা ও কুসংস্কারের আড়ালে এতটাই আচ্ছন্ন ছিল যে যারা এর শিকার ছিল সমাজ তাদের পরিহার ও অবহেলা করত। আজ বহুজাতিক মানসিক স্বাস্থ্য অ্যাডভোকেসি গোষ্ঠীর প্রচেষ্টায় অবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। ১৯৮০ সালের দিকে শুরু হলো পারিবারিক কনজুমার কমিউনিটি। এখন অনেক আশার সঞ্চার হচ্ছে।’
দায়িত্ব তাহলে কার ওপর বর্তাবে? সরকার ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়? এনজিও? পরিচর্যা ও সাহায্যকারী সংস্থা? বেসরকারি হাসপাতাল ও কমিউনিটি কেন্দ্র?
সম্ভবত, এদের সবাইকে মিলেই এ দায়িত্বভার নিতে হবে। আমাদের প্রত্যেকেরই মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নের আন্দোলনে ভূমিকা রয়েছে।
ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন ফর মেন্টাল হেলথের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম সভাপতি জে· আর· রিস ১৯৬১ সালে মেন্টাল হেলথ ইন ইন্টারন্যাশনাল পারসপেকটিভ গ্রন্থে বলেছিলেন, ‘ভবিষ্যতের জন্য পরিকল্পনা এবং আরও ভালো কাজ যদি করতে হয়, তাহলে এবং বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে পলিসি পরিকল্পনার জন্য পরামর্শ দিতে হলে আমাদের মতো সংস্থাকে বারবার বসে অতীত ও ভবিষ্যৎ লক্ষ্য বিবেচনা করা উচিত। আমরা অনেক বিষয়ে শীতল থাকি, যা থেকে আমাদের মুক্তি প্রয়োজন। চিকিৎসার অগ্রগতির জন্য ব্যবচ্ছেদ করে দেখা প্রয়োজন, যাঁরা মানববিজ্ঞান নিয়ে কাজ করেন, তাঁদের সাফল্য ও ব্যর্থতা-দুটিকেই সমানভাবে বিচার করতে হবে। তা হলেই ভবিষ্যৎ চিকিৎসা ও প্রতিরোধ কাজের ব্যাপারে আরও ভালো পরিকল্পনা করা সম্ভব হবে।’ কীভাবে এ লক্ষ্য সাধিত হবে? ‘অ্যাডভোকেসি’, ‘অ্যাকশন’-পরিবর্তনের জন্য এ দুটি হলো বড় চাবিকাঠি। অ্যাডভোকেসি বলতে বোঝায়, ‘অন্যদের জন্য বলা’ অথবা ‘নিজে কাজ করা অন্যের জন্য।’
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার অ্যাডভোকেসি ফর মেন্টাল হেলথ-এর গাইডেন্স প্যাকেজ বলছে, ‘অ্যাডভোকেসির উদ্দেশ্য হচ্ছে মানসিক রোগে অসুস্থ লোকদের মানবাধিকার সমুন্নত করা এবং কুসংস্কার ও বৈষম্য দূর করা। এ জন্য প্রয়োজন হবে নানা ধরনের কাজকর্ম, যার লক্ষ্য হবে জনগোষ্ঠীতে মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারে ইতিবাচক ফল পাওয়ার জন্য কাঠামোগত ও দৃষ্টিভঙ্গিজনিত যেসব বড় বড় বাধা রয়েছে তা দূর করা।’
২০০৮ সালে বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবসের অভিযানের লক্ষ্য হলো, ‘মানসিক স্বাস্থ্যকে সব দেশের সব মানুষের জন্য বৈশ্বিক অগ্রাধিকার হিসেবে গড়ে তোলা।’
মানসিক স্বাস্থ্যের অ্যাডভোকেসির জন্য যেসব কর্ম-উদ্যোগ প্রয়োজন সেগুলো হলো ১০টি শর্তঃ
১· আমাদের চাই মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য জাতীয় একাত্মতা।
২· স্থানীয় পরিচর্যা, পরিষেবা বা পারিবারিক অ্যাডভোকেসি গ্রুপ গড়ে তোলার জন্য উৎসাহ।
৩· শুধু পরিচর্যার ক্ষেত্রে নয়, সমাজের সর্বস্তরে এ ব্যাপারে কুসংস্কারের বিরুদ্ধে বলতে হবে।
৪· মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য চাই নিজস্ব ও চলমান অর্থসাহায্য ও বরাদ্দ।
৫· বর্তমান স্বাস্থ্যসেবা ও সামাজিক সেবার মধ্যে ক্ষমতা ও দক্ষতা নির্মাণ।
৬· লোকসমাজ সেবার খাতে তাৎপর্যপূর্ণ বিনিয়োগ না করলে কাঙ্ক্ষিত সফলতা পাওয়া সম্ভব নয়।
৭· চিকিৎসার নানা বিকল্প সম্পর্কে আরও অবহিত হওয়া এবং এ ব্যাপারে তথ্য লাভের অধিকার অর্জন।
৮· পরিচর্যা ও পবিষেবার সুফল পেতে হলে পরিচর্যাকারী ও রোগী-দুজনেরই আত্মনিয়োগ প্রয়োজন।
৯· পেশাগত প্রশিক্ষণ ও অংশীদারি-দুটিই প্রয়োজন।
১০· গুরুতর মানসিক অসুখ সম্পর্কে আরও ভালো উপাত্ত প্রয়োজন।
মানসিক স্বাস্থ্যকে একটি বৈশ্বিক অগ্রাধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে ভোক্তা, পরিবারের সদস্য, নাগরিক অ্যাডভোকেসি ও অ্যাকশন-এসব সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন। এতে স্বাস্থ্যসেবা ও নীতি প্রণয়নে আসবে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন। যারা মানসিক অসুখের শিকার, তাদের শ্রদ্ধা ও সম্মানের চোখে দেখতে হবে, অবহেলার দৃষ্টিতে নয়। পরিবার ও সমাজের ভূমিকা এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।
অধ্যাপক ডা· শুভাগত চৌধুরী
পরিচালক, ল্যাবরেটরি সার্ভিসেস
বারডেম হাসপাতাল, ঢাকা
সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো, অক্টোবর ০৮, ২০০৮
Leave a Reply