৬ থেকে ১১ মাস বয়সী শিশুদের ৮৫ শতাংশ রক্তস্বল্পতায় ভুগছে
* কিশোরী ও গর্ভবতী মায়েদের মধ্যে প্রকোপ অনেক
* পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারি উদ্যোগ অপ্রতুল
দেশে ছয় থেকে ১১ মাস বয়সী ৮৫ শতাংশ শিশু রক্তস্বল্পতায় ভুগছে। কিশোরী ও গর্ভবতী মায়েদের মধ্যে এই হার যথাক্রমে ৪০ ও ৪৫ শতাংশ। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ- আইসিডিডিআরবি দেশের পুষ্টি পরিস্থিতি নিয়ে সাম্প্রতিক এক পর্যালোচনায় এ তথ্য পেয়েছে।
পুষ্টিবিজ্ঞানীরা বলছেন, রক্তস্বল্পতায় ভুগলে শিশুর বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। আর প্রাপ্তবয়স্কের কর্মক্ষমতা হ্রাস পায়। সচেতন হলে এবং কিছু সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিলে রক্তস্বল্পতার প্রকোপ হ্রাস করা সম্ভব।
পৃথক তিনটি জরিপের ফলাফল পর্যালোচনার ভিত্তিতে আইসিডিডিআরবির পুষ্টি বিভাগের প্রধান ড· তাহমিদ আহমেদ রক্তস্বল্পতার প্রাদুর্ভাবের নতুন এই তথ্য দিয়েছেন। ২০০৩ সালে জাতিসংঘ শিশু তহবিল-ইউনিসেফ এবং বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর পুষ্টি পরিস্থিতি জরিপ; ২০০৪ সালে জাতীয় পুষ্টি প্রকল্পের পুষ্টি পরিস্থিতির ভিত্তিমূলক জরিপ (বেইসলাইন সার্ভে) এবং ২০০৬ সালে এনএসপির পুষ্টি জরিপ পর্যালোচনা করেছেন ড· তাহমিদ। এই তিনটি জরিপ পর্যালোচনা করে রক্তস্বল্পতার যে তথ্য পাওয়া গেছে তাকে বিজ্ঞানীরা বিপজ্জনক বলছেন।
আইসিডিডিআরবির পুষ্টি বিভাগের প্রধান ড· তাহমিদ আহমেদ পর্যালোচনা ফলাফল বর্ণনা করার সময় প্রথম আলোকে বলেন, ‘রক্তস্বল্পতা নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে কোনো জরিপ হয়নি। রক্তস্বল্পতা পরিস্থিতি সুনির্দিষ্টভাবে জানার জন্য আলাদাভাবে জাতীয় পর্যায়ে জরিপ হওয়া দরকার।’সরকারি প্রতিষ্ঠানের গবেষক, পুষ্টিবিজ্ঞানী, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকেরা বলছেন, রক্তস্বল্পতার প্রকোপ সব সময়ই ছিল এবং এখনো তা প্রবলভাবে উপস্থিত। কিন্তু শুধু রক্তস্বল্পতাকে আলাদাভাবে মোকাবিলা করার কোনো উদ্যোগ কখনো নেওয়া হয়নি। তবে উদ্যোগ নেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে বলে তাঁরা মনে করেন।
দেশের পুষ্টি পরিস্থিতি নিয়ে ১৯৯৫-৯৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট জাতীয় পর্যায়ে একটি জরিপ করেছিল। ওই জরিপের মূল তত্ত্বাবধানকারী অধ্যাপক খুরশীদ জাহান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ দেশের সব বয়সী মানুষের মধ্যেই তীব্র রক্তস্বল্পতা রয়েছে।’
১৯৯৫-৯৬ সালের জরিপে দেখা যায়, শূন্য থেকে চার বছর বয়সী ৬৯ দশমিক পাঁচ শতাংশ গ্রামীণ শিশু রক্তস্বল্পতার শিকার। ওই জরিপে আরও দেখা গেছে, ছেলেদের তুলনায় মেয়েশিশুরা বেশি রক্তস্বল্পতায় ভোগে। গর্ভবতী ও বাচ্চাদের বুকের দুধ দেয় এমন ৫৯ শতাংশ মা রক্তস্বল্পতায় ভোগে। শহরের শিশু ও মায়েদের তুলনায় গ্রামের শিশু ও মায়েরা বেশি রক্তস্বল্পতায় ভোগে।
বাংলাদেশে অপুষ্টির ধরন ও ব্যাপ্তি (ন্যাচার অ্যান্ড এক্সটেন্ট অব ম্যালনিউট্রিশন ইন বাংলাদেশ) নামে প্রকাশিত জরিপ প্রতিবেদনে দেখা যায়, সত্তর ও আশির দশকে শূন্য থেকে চার বছর বয়সী রক্তস্বল্পতায় ভোগা শিশু ছিল ৮২ এবং ৭৩ শতাংশ।
কেন গুরুত্বপূর্ণঃ ড· তাহমিদ বলেন, পৃথিবীর বেশ কিছু দেশের গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব শিশু রক্তস্বল্পতায় ভোগে তাদের মেধার বিকাশ ঘটে কম। স্কুলে এরা ভালো দক্ষতা দেখাতে পারে না। এরা লেখাপড়ায় পিছিয়ে পড়ে।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা· মুশতাক হোসেন শিশুদের রক্তস্বল্পতা নিয়ে গবেষণা করেছেন। তিনি জানান, রক্তস্বল্পতার কারণে শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়, সহজে নানা রোগে আক্রান্ত হয়। শিশুর শ্বাসজনিত সংক্রমণ ও ত্বকের সমস্যা বেশি দেখা দেয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রক্তস্বল্পতায় ভুগলে মানুষের কর্মক্ষমতা কমে যায়। ড· তাহমিদ জানান, তৈরি পোশাকশিল্পে কর্মরত নারীদের স্বাস্থ্যবিষয়ক একটি গবেষণায় দেখা গেছে, রক্তস্বল্পতায় ভুগছে এমন নারীদের উৎপাদনশীলতা তুলনামূলক কম।
রক্তস্বল্পতার কারণঃ বিশিষ্ট শিশুপুষ্টি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম কিউ কে তালুকদার বলেন, রক্তস্বল্পতার মূল কারণ লৌহের অভাব। অন্যান্য অনুপুষ্টির (মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট) অভাবের কারণেও রক্তস্বল্পতা হতে পারে। এ ছাড়া শিশুর পেটে যদি কৃমি থাকে তা হলেও রক্তস্বল্পতা দেখা দেয়।
অধ্যাপক তালুকদার বলেন, জ্নগতভাবে এ দেশের শিশুদের শরীরে লৌহের পরিমাণ কম থাকে। এর সঙ্গে যদি অন্যান্য অনুপুষ্টির অভাব দেখা দেয় তা হলে শিশু সহজে রক্তস্বল্পতার শিকার হয়।
বাংলাদেশে রক্তস্বল্পতার প্রকোপ কেন বেশি তার সুনির্দিষ্ট কারণ এখনো চিহ্নিত হয়নি বলে জানান ড· তাহমিদ আহমেদ। কারণ জানার জন্য একটি বড় আকারের জরিপের প্রস্তাব করেন তিনি। তিনি বলেন, ৫০ শতাংশ মানুষ যদি রক্তস্বল্পতার শিকার হয় তা হলে তার ২০ শতাংশ লৌহের অভাবজনিত কারণ, এটা বলা যায়। রক্তস্বল্পতায় ভুগলে কিডনিরও সমস্যা হতে পারে।
প্রতিকারঃ অধ্যাপক এম কিউ কে তালুকদার বলেন, শাক-সবজি বা ডাল থেকে আমরা লৌহ পেতে পারি। কিন্তু শাক-সবজি-ডালের যে লৌহ থাকে তা শরীরে কম গৃহীত হয় (এ্যাবজর্ভ)। কিন্তু মাংসে থাকা লৌহ শরীর বেশি গ্রহণ করতে পারে।
তিনি বলেন, বাচ্চা খেতে না চাইলে বা অন্যান্য রোগের সংক্রমণ বেশি হতে থাকলে মা-বাবাকে বুঝতে হবে শিশু হয়তো রক্তস্বল্পতার শিকার। এ ছাড়া শিশুর শরীর যদি ফেকাশে হয়ে যায় তা হলে বুঝতে হবে সে রক্তস্বল্পতায় ভুগছে।
ড· তাহমিদ বলেন, ‘শিশুরা যেন রক্তস্বল্পতার শিকার না হয় তার জন্য ছয় মাস পর্যন্ত শুধু বুকের দুধ খাওয়াতে হবে। গণমাধ্যমে আমরা জিঙ্কের বিজ্ঞাপন দেখি। কিন্তু মায়ের দুধের পক্ষে প্রচার-প্রচারণা আমাদের চোখে পড়ে না। ছয় মাস পার হলে শিশুকে সঠিক সম্পূরক খাদ্য দিতে হবে। লৌহ ও ভিটামিন-সি আছে এমন খাবার বেশি দিতে হবে। সাধারণভাবে আমরা যেসব খাবার খাই তার ১০ শতাংশ লৌহ আমরা গ্রহণ করতে পারি। এর জন্য ভিটামিন-সি বেশি করে খাওয়া দরকার।’ তিনি বলেন, প্রাণিজ আমিষে লৌহ বেশি থাকে।
ড· তাহমিদ আহমেদ বলেন, যেসব শিশুর পেটে কৃমি থাকে তারা খাবার থেকে কম পরিমাণ লৌহ গ্রহণ করতে পারে। আর তাই তারা রক্তস্বল্পতায় ভোগে বেশি। শিশুদের ছয় মাস অন্তর কৃমিনাশক বড়ি খাওয়ানো উচিত।
তিনি আরও বলেন, মাসিকের সময় মেয়েদের শরীর থেকে প্রতি মাসে প্রচুর পরিমাণে লৌহ বের হয়ে যায়। কিশোরীদের রক্তস্বল্পতার এটাই অন্যতম প্রধান কারণ। আর তাই এদের নিয়মিত আয়রন বড়ি এবং ফলিক এসিড বড়ি খেতে দেওয়া দরকার। সরকারি কার্যক্রমের আওতায় মাত্র ৫০ শতাংশ গর্ভবতী মাকে আয়রন বড়ি দেওয়া হয়। কিন্তু পরিমাণ অন্তত পক্ষে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো দরকার।
শিশুদের রক্তস্বল্পতা দূর করার জন্য জাতীয় পুষ্টি কার্যক্রম মৌলভীবাজার জেলার তিনটি উপজেলায় পরীক্ষামূলক একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। পুষ্টি কার্যক্রমের উপপরিচালক ডা· এস এম মোস্তাফিজুর রহমান জানান, ছয় মাস থেকে দুই বছর বয়সী শিশুদের শরীরে লৌহের পরিমাণ বাড়ানোর জন্য ‘মণি মিক্স’ নামের ৩০টি বড়ি দেওয়া হচ্ছে। এক দিন অন্তর বড়ি খাওয়াতে হয়। তিনি জানান, শিশুর দেহে লৌহের অভাব দূর করার জন্য এ ধরনের বড়ি বহু দেশে ব্যবহার করা হয়।
সূত্রঃ প্রথম আলো, অক্টোবর ০৫,২০০৮
Leave a Reply