সবচেয়ে বড় ঘাতক রোগ হিসেবে হৃদরোগ ও মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রতিবছর এসব রোগে ১৭ দশমিক ৫ মিলিয়ন লোক প্রাণ হারাচ্ছে। আর এ জন্যই বিশ্বজুড়ে পালিত হয় বিশ্ব হার্ট দিবস (সেপ্টেম্বর ২৮)। এ দিবস পালনের উদ্দেশ্য হলো হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকিগুলো সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করা এবং প্রতিরোধের উপায়গুলো জানানো।
আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশনের ২০০৭ সালের অক্টোবরের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০২৫ সালের মধ্যে ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন মানুষ অথবা এমন বলা যায়, ২৫ বছরের ঊর্ধ্ব পূর্ণবয়স্ক তিনজনে একজনের উচ্চ রক্তচাপ হবে বলে অনুমান। আর পৃথিবীর এক নম্বর ঘাতক রোগ হৃদরোগ ও স্ট্রোকের সবচেয়ে বড় একক ঝুঁকি হলো উচ্চ রক্তচাপ।
যা জানা দরকার
উচ্চ রক্তচাপের স্পষ্ট কোনো উপসর্গ থাকে না, তাই এ সম্পর্কে জানার একমাত্র উপায় হলো চিকিৎসক বা চিকিৎসা-পেশাজীবীদের দিয়ে চেকআপ করানো। এ কথা জোর দিয়ে বলার জন্য এ বছরের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো ‘নিজের ঝুঁকি জেনে নিন’।
চিকিৎসক ও চিকিৎসাকর্মী দিয়ে রক্তচাপ মাপিয়ে ঝুঁকি আছে কি না জেনে নিন।
উচ্চ রক্তচাপকে নীরব ঘাতক বললে অত্যুক্তি হবে না। তেমন কোনো উপসর্গ নেই, অথচ নীরবে হৃৎপিণ্ড ও রক্তনালির সর্বনাশ ঘটে যায়, হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়তেই থাকে। স্বাভাবিক রক্তচাপ থাকলে যে পরিমাণ ঝুঁকি, এর তিনগুণ বেশি ঝুঁকি হয়ে ওঠে উচ্চ রক্তচাপে। আর উচ্চ রক্তচাপ থাকলে প্রতিদিন শরীরের ক্ষতি চলতেই থাকে।
এর মধ্যে সুসংবাদ আছে। স্বাস্থ্যসেবাকর্মী ও চিকিৎসকেরা সহজেই রক্তচাপ চিহ্নিত করতে পারেন এবং রোগীকে জীবনযাপনের পরিবর্তনের পরামর্শ দিয়ে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণও করতে পারেন। প্রয়োজনে ওষুধও দেওয়া যেতে পারে। তাই নিজের ঝুঁকি কী পরিমাণ আছে তা জানতে পারলে উচ্চ রক্তচাপে শরীরের ওপর যে প্রভাব পড়তে পারে তা থেকে নিজেকে রক্ষা করা যায়।
নিজের রক্তচাপ কত তা জানা থাকলে এবং সেই সঙ্গে রক্তের সুগার ও কোলেস্টেরল মান জেনে নিলে; সেই সঙ্গে আরও যা, তা হলো দেহের উচ্চতা, ওজন ও কোমরের মাপ জেনে নিলে ডাক্তার পরামর্শ দিতে পারেন হৃদরোগ ও স্ট্রোক থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এবং ঝুঁকি কমানোর জন্য কী কী করা যেতে পারে।
বিশ্ব হার্ট ফাউন্ডেশনের সভাপতি অধ্যাপক শাহরিয়ার শেখ বলেন, ‘সো ইউ ক্যান হ্যাভ এ হার্ট ফর লাইফ।’
হেলথ কেয়ার প্রফেশনালদের দায়িত্ব তো সবচেয়ে বেশি।
তারা বিশ্ব হার্ট দিবস পালন করে এবং বিশ্বব্যাপী এ আন্দোলনকে সহযোগিতা দিয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে পারে এবং জনগণকে উৎসাহিত করতে পারে হৃদরোগের ঝুঁকি কমানোর জন্য উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে।
রোগীদের জন্য হৃদস্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে, ঝুঁকির মান ও মাত্রা সম্পর্কে রোগীকে জানানো এবং কী করে একে প্রতিহত করা যায়, বিশেষ করে জীবনযাপনে কী কী পরিবর্তন আনা যায় তাও রোগীকে শেখানো উচিত।
আমাদের দেশে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের মতো সংস্থা এসব কাজ করছে। খোলাখুলি পরামর্শ দিলে জীবনযাপনে পরিবর্তনের জন্য যথেষ্ট প্রণোদনা মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয়। হৃদরোগের জন্য স্ক্রিনিং চালু করা যায়, যাদের মধ্যে এসব রোগের পারিবারিক ইতিহাস থাকে তারা এই স্ক্রিনিংয়ে বেশ উপকৃত হয়।
অধ্যাপক শাহরিয়ার শেখ বলেন, ‘হৃদরোগ হলো একবিংশ শতাব্দীতে প্রধানতম বিশ্ব স্বাস্থ্য ইস্যুর একটি। তবে এটি এমন এক রোগ, যাকে মোকাবিলা করার মতো জ্ঞান ও ক্ষমতা দুটোই আমাদের আছে।’
হৃদরোগ ও স্ট্রোক প্রতিরোধ করার উপায় হলো, নিয়মিত ব্যায়াম, ধূমপান না করা এবং স্বাস্থ্যকর খাবার, যাতে নুন ও চর্বি থাকবে কম এবং আঁশ, তাজা সবজি ও ফল থাকবে বেশি।
তাই নিজের ঝুঁকি নিজে জেনে স্বাস্থ্যকর জীবন যাপনে অভ্যস্ত হওয়াই হলো বিশ্ব হার্ট দিবসের মূল বাণী।
হৃদরোগের ঝুঁকি মাপা হোক আরও সাশ্রয়ী
এককালে হৃদরোগকে বিত্তশালীদের রোগ বলে মনে করা হলেও উন্নয়নশীল বিশ্বে হৃদরোগ বাড়ছে ৮০ শতাংশ। হৃদরোগে মৃত্যু এখন ঘটছে স্বল্প আয় ও মধ্য আয়ের দেশগুলোতে আর সে জন্য পৃথিবীজুড়ে স্বাস্থ্যকর্মী ও এপিডেমিওলজিস্টরা হৃদরোগকে স্ক্রিন করার, একে অনুসরণ করার এবং চিকিৎসার আরও উন্নত উপায় বিবেচনা করছে।
দেখা যাচ্ছে, অন্তত এ রোগের স্ক্রিনিংয়ের কাজটি অনেক বেশি সস্তা ও দ্রুত হতে পারে। ২০০৮ সালের মধ্য মার্চের ইস্যু ল্যানসেট নামের বিখ্যাত মেডিকেল জার্নালে একদল আমেরিকান গবেষক প্রতিবেদন করেছে যে একটি স্কেল, একটি টেপ মেজার ও রক্তচাপ মাপার যন্ত্রের সাহায্যে ১০ মিনিটে হৃদরোগের ঝুঁকি অত্যন্ত কম খরচে করলে যে ফলাফল আসে, তার কার্যকারিতা ব্যয়বহুল ল্যাবরেটরি টেস্টসহ অন্যান্য পরীক্ষার ফলাফলের প্রায় সমান। একে ঠিক ‘নিজে করি’ পরীক্ষার মতো মনে না হলেও এতে চিকিৎসকেরা রোগীকে অনেক দ্রুত স্ক্রিন করতে পারে এবং ফলে উন্নত ও উন্নয়নশীল দুটো বিশ্বেই অনেক বেশি কার্যকর চিকিৎসাও দিতে পারে।
গবেষণাটি পরিচালনা করেছেন হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুল এবং ব্রিগহাম অ্যান্ড ওমেন্স হসপিটাল, বোস্টনের গবেষকেরা। নেতৃত্ব দিয়েছেন থমাস গাজিয়ানো। আমেরিকার ন্যাশনাল হেলথ অ্যান্ড নিউট্রিশন এগজামিনেশন সার্ভেতে যে ছয় হাজার ১৮৬ জন আমেরিকান পূর্ণবয়স্ক লোক অংশ নিয়েছিল, তাদের ওপর পরীক্ষার ফলাফলের উপাত্ত একত্র করে এমন একটি ধারণা হয়েছে গবেষক দলের।
এসব অংশগ্রহণকারী লোককে ১৯৭০ সালের গোড়ার দিকে প্রথম পরীক্ষা করা হয়েছিল, তাদের হৃদরোগের কোনো ইতিহাস ছিল না। তাদের অনুসরণ করা হলো ২১ বছর, এর মধ্যে এক হাজার ৫২৯ জন লোকের হলো হৃদরোগ ও রক্তবাহক রোগ (হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, এনজাইনা বা হৃদ নিষ্ত্র্নিয়া), সে সঙ্গে হৃদরোগে মারা গেল ৫৭৮ জন।
হৃদরোগের ঝুঁকি পরিমাপের প্রচলিত জিনিসগুলোঃ বয়স, সিসটোলিক রক্তচাপ, ধূমপানের অভ্যাস, রক্তে কোলেস্টেরল, ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপের কোনো চিকিৎসা-এগুলো রোগীদের মধ্যে কেমন আছে তা দেখা।
তারা দেখল রক্তে কোলেস্টেরল মাপার বদলে রোগীদের বিএমআই (বডিমাস ইনডেক্স-রোগীর উচ্চতা ও ওজনের অনুপাত) মাপলে রোগীর হৃদরোগের পাঁচ বছর ঝুঁকি একই রকম অনুমান করা সম্ভব।
গাজিয়ানো ও সহকর্মীদের এই ফলাফল থেকে বলা যায়, বিএমআইয়ের মতো সহজ পরিমাপ উন্নয়নশীল দেশের চিকিৎসকদের হৃদরোগের ঝুঁকি যাচাইয়ের ক্ষেত্রে যে ফল দিচ্ছে তা ধনী দেশগুলোর ব্যয়বহুল পরীক্ষার ফলাফলের প্রায় সমতুল্য, অন্তত হৃদরোগের প্রাথমিক ঝুঁকি নিরূপণের ক্ষেত্রে তো বটেই।
তবে একটি প্রশ্ন থেকে যায়, আমেরিকার জনগোষ্ঠীর মধ্যে যে ফলাফল পাওয়া গেল, এটি অন্য জনগোষ্ঠীর জন্য যথাযথ প্রযোজ্য কি না। যেমন বিএমআইয়ের ক্ষেত্রে ককেশিয়ানদের তুলনায় এশিয়ানদের দেহের মেদ অনুপাত বেশি এবং অনেক ক্ষেত্রে ১৯৭০ সালের আমেরিকানরা বর্তমান বিশ্বের অন্যত্র অনেক জনগোষ্ঠীর চেয়ে খুব বেশি ভিন্ন নয়।
সত্তরের দশকে আমেরিকানরা আজকালকার চেয়ে অনেক বেশি ধূমপান করত, উচ্চ রক্তচাপের জন্য বা উচ্চমান কোলেস্টেরলের জন্য তেমন চিকিৎসা নিত না। গাজিয়ানোর বক্তব্য এই ব্যাপারটি একুশ শতকের রাশিয়ান পূর্ব ইউরোপের লোকদের চেয়ে তেমন ভিন্ন নয়।
বিখ্যাত ল্যানসেট মেডিকেল জার্নালে একই ইস্যুতে আরেকটি নিবন্ধে দেখানো হয়েছে যে হৃদরোগের ঝুঁকিগুলো অনেক দ্রুত বিশ্বজুড়ে একই রকম, সমান তালে এগিয়ে চলেছে। এমনকি সাব সাহারান আফ্রিকায়, যেখানে সংক্রমণ রোগ বড় ঘাতক হিসেবে কথিত।
স্বল্প আয়ের দেশগুলোতে ল্যাবের ব্যয়বহুল পরীক্ষার বদলে প্রায় বিনা খরচে পরীক্ষায় যদি একই ফল পাওয়া যায়, তাহলে চিকিৎসা অনেক সাশ্রয়ী হবে তো বটেই। আফ্রিকার প্রত্যন্ত অনেক অঞ্চলে যেখানে ল্যাব বা টেকনিশিয়ান পাওয়া প্রায় অসম্ভব, সেখানে এ ধরনের পরিমাপ অনেক সুফলপ্রদ।
বাস্তব সত্য হলো, অনেক উন্নয়নশীল দেশে স্বাস্থ্য পরিচর্যা খাতে প্রতিবছর জনপ্রতি ব্যয় হয় মাত্র ৩০ আমেরিকান ডলার বা এরও কম। অবশ্য ধনী লোকেরা হাজার হাজার ডলার খরচ করতে দ্বিধা বোধ করে না।
নি্ন আয় ও মধ্য আয়ের দেশগুলো রোগীদের চিকিৎসার খরচ তো আছেই, কর্মস্থল থেকে ছুটি নিয়ে পরীক্ষা করতে আসা এবং এ জন্য ব্যয় করার খরচ ও এর ফলাফল নেওয়ার জন্য আবার ক্লিনিকে যাতায়াতের খরচ সব মিলিয়ে চিকিৎসা গরিব মানুষের জন্য বড় বোঝা হয়ে দাঁড়ায়।
সে কারণে যেসব অঞ্চলে ল্যাব-সুবিধা নেই বা খুব কম, সেখানে হৃদরোগের ঝুঁকি যাচাই করার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইড লাইন অনুযায়ী রক্তে কোলেস্টেরল মাপা বাদ দেওয়া হয়েছে।
নতুন এসব ফলাফল শেষে অনেক সাশ্রয়ী উপায়ের ইঙ্গিত দিতে পারে, অনেক নতুন চিন্তাভাবনার উদ্রেক করতে পারে-এমনকি আমেরিকার মতো শিল্পসমৃদ্ধ দেশেও, যেখানে চিকিৎসার খরচ গত দুই দশকে আকাশচুম্বী হতে চলেছে।
চিকিৎসক বা রোগী কেউই কোলেস্টেরল পরীক্ষা করা একেবারে বাদ দিতে চান না। কারণ, যত বেশি তথ্য পাওয়া যায় ততই ভালো, বিশেষ করে যেখানে হার্ট অ্যাটাকের মতো রোগ নির্ণয় যদি লক্ষ্যভেদ না করা যায়, তাহলে এর পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে।
একটি বাস্তব শিক্ষা এ থেকে পাওয়া যাবে, রক্তে কোলেস্টেরল যাদের মাপতে হবে, তাদের সংখ্যা এর মাধ্যমে কমানো যাবে।
যাদের হৃদরোগের অন্য সব ঝুঁকি রয়েছে, তাদের রক্ত টেনে কোলেস্টেরল মাপা সার্বিক ঝুঁকিতে কী-ই বা এমন যোগ করতে পারবে? একইভাবে যে রোগীর হৃদরোগের কয়েকটি ঝুঁকি রয়েছে তাদের কোলেস্টেরল যা-ই হোক চিকিৎসা তো করতেই হবে। তাই যাদের ঝুঁকি যাচাই হচ্ছে না, তাদের রক্ত পরীক্ষা করে ও চিকিৎসা করে চিকিৎসাটি কিছুটা সাশ্রয়ী করতে পারলে ক্ষতি কী। ব্যাপারটা ভাবার মতো।
অধ্যাপক ডা· শুভাগত চৌধুরী
পরিচালক, ল্যাবরেটরি সার্ভিসেস
বারডেম হাসপাতাল, ঢাকা
সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো, সেপ্টেম্বর ২৪, ২০০৮
Leave a Reply