ডা· ইকবাল কবীর
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও রোগতত্ত্ববিদ
বেশির ভাগ সময়ই মা-বাবা বুঝতে পারেন না তাঁদের সন্তান কখন কী অবস্থায় মাদকনির্ভর হয়ে যাচ্ছে। একেবারে শেষ পর্যায়ে যখন তীব্র শারীরিক লক্ষণ দেখা দেয়, তখনই কেবল বুঝতে পারেন।
অথচ একটু সচেতনভাবে লক্ষ রাখলে মা-বাবা বা পরিবারের লোকজন প্রাথমিক অবস্থায়ই বুঝে ফেলতে পারবেন তাঁদের সন্তান বা পোষ্য নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে কি না। মা-বাবাই যেহেতু সন্তানকে সব সময় কাছ থেকে দেখার সুযোগ পান, তাই তাঁদের পক্ষে সহজেই পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব সন্তান মাদকদ্রব্য গ্রহণ করছে কি না।
কারণ, মাদকদ্রব্য গ্রহণ করলে কিছু না কিছু লক্ষণ তার মধ্যে প্রকাশ পাবেই। কাজেই মাদকনির্ভরতার লক্ষণ এবং নমুনাগুলো যদি প্রাথমিকভাবে ধরে ফেলা যায়, তাহলে খুব সহজেই সন্তানকে স্মেহ-ভালোবাসা এবং প্রয়োজনীয় পরিচর্যা দিয়ে সুস্থ করে তোলা যায়। কারণ, উঠতি বয়সী তরুণেরা সাধারণত নেশা করে কৌতূহলবশত।
স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণদের বেশির ভাগই মাদক নেয় বন্ধুদের প্ররোচনায়, কৌতূহল মেটাতে। সিগারেট খাওয়া দিয়ে শুরু হয়। পাড়া, মহল্লা, ক্লাবের খারাপ সংসর্গ, আড্ডা থেকেও এটি ছড়িয়ে থাকে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নেশা শুরুর আগে এর ভয়াবহ পরিণতির কথা জানা থাকে না।
অভিভাবকেরা কী করবেন
শিশুবয়সে সন্তানের কোমল মনে যাতে কোনো অস্থিরতা না জ্নায়, সে ব্যাপারে সচেতন থাকা জরুরি। সব বয়সের সন্তানের প্রতিই অভিভাবকের সুদৃষ্টি থাকা প্রয়োজন।
কিন্তু উঠতি বয়সীদের প্রতি বেশি সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। কারণ, অসৎ বন্ধুর সান্নিধ্যে পড়ে অনেক ভালো ছেলেমেয়ে নতুন অভিজ্ঞতা, তাদের ভাষায় ‘ফিলিংস’, নেওয়ার জন্য এ বয়সে মাদকদ্রব্য নিয়ে থাকে। মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের ওপর চালানো এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে প্রথমবার মাদক নিয়েছিল এমন অনেকেই দ্বিতীয়বার মাদক নিতে চায়নি।
কিন্তু বন্ধুদের সামনে ছোট হওয়ার ভয়ে কিংবা বন্ধুদের চাপে মাদকদ্রব্য নিতে বাধ্য হয়েছে। পরে অভ্যস্ত হয়ে মাদকনির্ভর হয়ে পড়েছে। অনেকেই দু-একবার মজা করতে গিয়ে জড়িয়ে পড়েছে।
শিক্ষকদের ভূমিকা অনেক
মাদকদ্রব্যের কুফল সম্পর্কে স্কুল-কলেজের শিক্ষকেরা ছাত্রছাত্রীদের পরিষ্কার ধারণা দিয়ে সতর্ক করেতে পারেন। কারণ, এ বয়সে অনেকেরই মাদকের কুফল সম্পর্কে ধারণা থাকে না।
চিকিৎসা হোক সহানুভূতির সঙ্গে
যদি আপনার সন্তান বা পরিচিতজন অতিমাত্রায় মাদকনির্ভর হয়ে পড়ে এবং পারিবারিকভাবে তাকে আর কোনোমতেই নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তাহলে তার চিকিৎসার জন্য বিশেষ চিকিৎসাকেন্দ্রের শরণাপন্ন হোন।
সামাজিক দুর্নাম কিংবা সম্মানহানির গ্লানিতে না ভুগে হাসপাতাল কিংবা ক্লিনিকে চিকিৎসাধীন রাখুন।
আপনার সন্তান যদি বেশি মাত্রায় মাদকনির্ভর হয়ে যায়, তাহলে একটি বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে যে হাসপাতাল বা চিকিৎসাকেন্দ্র থেকে ফিরে আসার পরও সে আবার মাদক নিতে পারে-যাকে বলা হয় রিল্যাপস বা পুনরাসক্তি।
এটাও খুব স্বাভাবিক, যা অনেক অভিভাবকই জানেন না। ভাবেন, হাসপাতালে (১৪ দিন বা এক মাস) চিকিৎসা করানো হয়েছে; কাজেই এখন সে ভালো হয়ে গেছে।
এ রকম ক্ষেত্রে কমপক্ষে দুই বছর ফলোআপ করতে হয়।
পারিবারিকভাবে তাকে খুব কাছাকাছি পর্যবেক্ষণের মধ্যে রাখতে হবে। মাদকদ্রব্য নেওয়া থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করতে হবে।
পুরোনো মাদকাসক্ত বন্ধুদের সঙ্গে যাতে মিশতে না পারে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এর পরও ব্যর্থ হলে তাকে আবারও চিকিৎসাকেন্দ্রে পাঠাতে হবে সহানুভূতির সঙ্গে।
কীভাবে বুঝবেন কেউ নেশা করছে
পরিবারের কোনো সদস্য মাদকদ্রব্য নেওয়া শুরু করছে কি না, তা বোঝার জন্য কতগুলো বাহ্যিক লক্ষণ খেয়াল করলেই বোঝা যাবেঃ
আচরণগত পরিবর্তন
— হঠাৎ করেই স্বাভাবিক আচরণে পরিবর্তন আসতে পারে। অন্যমনস্ক থাকা, একা থাকতে পছন্দ করা।
— অস্থিরতা প্রকাশ, চিৎকার, চেঁচামেচি করা।
— অসময়ে ঘুমানো, ঝিমানো কিংবা হঠাৎ চুপ হয়ে যাওয়া।
— কারণে-অকারণে খারাপ ব্যবহার করা, অসংলগ্ন ও অস্পষ্ট কথাবার্তা বলা।
— কোথায় যায়, কার সঙ্গে থাকে-এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বিরক্ত হওয়া, গোপন করা কিংবা মিথ্যা বলা।
— ঘর অন্ধকার করে জোরে মিউজিক শোনা।
— নির্জন স্থানে, বিশেষত বাথরুম বা টয়লেটে আগের চেয়ে বেশি সময় কাটানো।
— রাত করে বাড়ি ফেরা, রাত জাগা, দেরিতে ঘুম থেকে ওঠা।
— হঠাৎ নতুন অপরিচিত বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে বেশি মেলামেশা করা।
— বিভিন্ন অজুহাতে ঘন ঘন টাকা-পয়সা চাওয়া।
— স্বাভাবিক খাওয়াদাওয়া কমিয়ে দেওয়া।
— অভিভাবক এবং পরিচিতজনদের এড়িয়ে চলা।
— স্বাভাবিক বিনোদন-মাধ্যমে ক্রমশ আগ্রহ হারিয়ে ফেলা।
— বাড়ির বিভিন্ন জায়গা থেকে ক্রমাগত টাকা-পয়সা ও মূল্যবান জিনিসপত্র হারিয়ে যাওয়া।
— ঋণ করার প্রবণতা বেড়ে যাওয়া।
মাদকাসক্তি থেকে মুক্তির উপায়
প্রথমত নিজের ভরাডুবি নিজেকেই উপলব্ধি করতে হবে; সুস্থ জীবনে ফিরে আসার বা মাদক ছেড়ে দেওয়ার ইচ্ছাশক্তি বাড়াতে হবে। অর্থাৎ নিজেকেই নিজে রাজি করাতে হবে, ভেতর থেকেই এ তাগিদ জাগাতে হবে। জোর করে কাউকে এই পথ থেকে ফেরানো কঠিন।
এখানে পারিবারিক ও সামাজিক দায়িত্ব বড় বিষয়। হাল ছেড়ে দিলে চলবে না। আসক্ত ব্যক্তিকে ঘৃণা করা চলবে না; বরং তাকে ফিরিয়ে আনার জন্য জোরালো উদ্যোগ কমপক্ষে ছয় মাস চালিয়ে যেতে হবে।
নিজে থেকে রাজি না হলে মনোরোগ চিকিৎসার মাধ্যমে রাজি করানো যায়। এ জন্য পারিবারিক দায়িত্ব হচ্ছে চিকিৎসার জন্য তাকে উদ্বুদ্ধ করা, কাউন্সেলিং সেশনগুলোতে নিয়মিত হাজির করানো।
কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে রাজি করানো সম্ভব। পরবর্তী ধাপ হচ্ছে বিশেষজ্ঞ মনোরোগ চিকিৎসকের মাধ্যমে চিকিৎসার গুরুত্বপূর্ণ পর্ব ডিটক্সিফিকেশন প্রক্রিয়া চালানো। ১৪ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। এখানেই শেষ নয়।
পরবর্তী ছয় মাস থেকে এক বছর মাদকের উৎস প্রতিরোধ করতে হবে। রোগীকে পুনর্বাসন করতে হবে। কাউন্সেলিং চলবে একটানা।
মাদকাসক্ত ব্যক্তির নৈতিক ও কর্মশক্তি বাড়াতে হবে। ক্ষেত্রবিশেষে তাকে সক্রিয় রাখার জন্য বিশেষ ধরনের থেরাপির ব্যবস্থা নিতে হবে। গবেষণার প্রতিবেদন থেকে দেখা গেছে, আসক্ত ব্যক্তিদের ৮০ শতাংশেরই আগে ধূমপানের অভিজ্ঞতা ছিল।
ধূমপায়ীরা সহজে আসক্তি ছাড়তে পারে না। মাদকাসক্তি থেকে মুক্তির জন্য ধূমপান থেকেও নিজেকে সরিয়ে রাখতে হবে। তা না হলে আবার আসক্ত হওয়ার আশঙ্কা ৯০ শতাংশেরও বেশি থেকে যাবে। প্রতিকূল অবস্থায় আবার আসক্ত হওয়ার আশঙ্কা শতভাগ!
মাদকের অবৈধ পাচার রোধ করার দায়িত্ব বড়দের।
তবে ছোটদেরও কিন্তু দায়িত্ব রয়েছে। প্রধান হাতিয়ার হচ্ছে নিজের কৌতূহলের নিরাপদ ব্যবহার এবং শত হাতছানির মধ্যেও মাদককে ‘না’ বলার শক্তি নিজের মধ্যে জাগ্রত করা।
‘না’ বলার শক্তিই মাদক প্রতিরোধের সবচেয়ে বড় উপায়।
ঘরে ঘরে শিশু-কিশোরদের মনে মাদককে ‘না’ বলার শক্তি প্রবেশ করাতে হবে আরও বেশি করে। এই দায়িত্ব আমাদের সবার-বিশেষ করে বড়দের-শিক্ষক, মা-বাবা, বড় ভাই-বোন, বন্ধু-বান্ধবদেরও।
সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো, জুন ২৫, ২০০৮
Leave a Reply