ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মেহতাব খানম দীর্ঘদিন ধরে কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিষয়টি পড়াচ্ছেন। তিনি আপনার মানসিক বিভিন্ন সমস্যার সম্ভাব্য সমাধান দেবেন। অল্প কথায় আপনার সমস্যা তুলে ধরুন। আপনার সঠিক পরিচয় না দিতে চাইলে অন্য কোনো নাম ব্যবহার করুন। —বি.স.
সমস্যা: আমি এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছি। গত আগস্টের প্রথম সপ্তাহে আমার রুমমেটের মাধ্যমে (ফোনে) পরিচয় হয় তার এক বড় ভাইয়ের সঙ্গে। সে এবার মাস্টার্স পরীক্ষার্থী। ২০ আগস্ট ওই ছেলের সঙ্গে প্রথম দেখা হয়। আমি তার কাছ থেকে জানতে পারি, সে অন্য এক মেয়েকে ভালোবাসত এবং মেয়েটির বিয়ে হয়ে গেছে। সেদিন রাতে সে আমাকে জানায়, সে আমাকে ভালোবাসে। তখন আমিও তার কথায় সাড়া দিই। কেননা, আমার সবসময় ভালো লাগে ব্যথিতের সাহচর্যে যেতে। আমার ইচ্ছা ছিল, আমি তার কষ্ট কিছুটা হলেও ভোলানোর চেষ্টা করব। কিন্তু কিছুদিন ভালোভাবে কথা বলার পর সে আমাকে জানায়, তাকে নিয়ে তার পরিবারের অনেক স্বপ্ন। তাই আমাকে সে দূরে থাকতে বলে। কিন্তু এখন আমি রুমমেটের মাধ্যমে জানতে পারি, সে আমাকে আবার ভালোবাসতে চায়। আবারও আগের মতো হতে চায়। আমি কী করব?
নাম-ঠিকানা প্রকাশে অনিচ্ছুক।
পরামর্শ: খুব অল্প সময়ের পরিচয়ে তোমরা ভালোবাসার সম্পর্ক তৈরি করেছিলে। ছেলেটিকে ভালো করে না জেনেই তুমি তার দুঃখ-কষ্ট ভুলিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে নিলে। এভাবে যে সম্পর্কগুলো শুরু হয়, সেগুলোতে অনেক ঝামেলার সৃষ্টি হতে পারে। অনেক সময় কারও সহানুভূতি লাভের উদ্দেশ্যে নিজের অসহায়ত্ব তুলে ধরে এ ধরনের সম্পর্কের সূত্রপাত ঘটানো হয়। তোমার দিক থেকে যে ভুলটি হয়েছে, তা হচ্ছে ছেলেটির দুঃখ দূর করার জন্য ভালোবাসার সম্পর্কে প্রবেশ করা। কারও সাহায্য নিয়ে নয়, ছেলেটি সত্যিই যদি মানসিক আঘাত পেয়ে থাকে, তাহলে তাকে নিজের মনের সঙ্গে বোঝাপড়া করে এই কষ্ট থেকে সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায় বেরিয়ে আসতে হবে। সে তোমার মনে ভালোবাসা বা ভালোলাগার অনুভূতি তৈরি করে তারপর হঠাৎ করেই তোমাকে দূরে থাকতে বলে দিল। যদি তাকে নিয়ে সবার অনেক স্বপ্ন থাকে, তোমাকে বিয়ে না করার সম্ভাবনা থাকে, তাহলে তো তোমার সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করারই কোনো অধিকার সে রাখে না, তাই না? এরপর তোমার দিক থেকে দুর্বলতা আছে জেনেও শুধু নামমাত্র একটি সম্পর্ক বজায় রেখেছে। কিন্তু এতে তো তোমার অনেক কষ্ট পাওয়ার এবং ওর ওপরে রাগ করারও কথা ছিল। এভাবে তোমাকে নিজের ইচ্ছেমতো ব্যবহার করে আবার সে অন্তরঙ্গ হওয়ার প্রস্তাব দিচ্ছে। তোমার সরলতা ও ভালোবাসার সুযোগ নিয়ে সে যে আবার তোমাকে কষ্ট দেবে না, এর কোনো নিশ্চয়তা কিন্তু নেই। তুমি খুব ভালো করে ভেবে দেখ, তোমার জন্য এখন কোন রাস্তাটি বেছে নেওয়া বেশি জরুরি। নিজেকে যদি তুমি সত্যিই ভালোবাস এবং শ্রদ্ধা কর, তাহলে তোমার ভবিষ্যতকে গড়ে নেওয়ার প্রতিই কিন্তু বেশি মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। এইচএসসিতে এত ভালো ফলাফল করেছ, তোমার তো বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি ভালোভাবে সম্পন্ন করতে হবে। ছেলেটির প্রস্তাবে রাজি হবে কি না এই সিদ্ধান্তটি এই মুহূর্তে না নিলে ভালো হয়। তুমি ওর কাছে আরও সময় চাইতে পার। ছেলেটি যখন যেভাবে বলছে, সেভাবে তুমি সবকিছু করতে থাকলে তোমার আত্মসম্মানবোধ ক্ষুণ্ন হবে কি না সেটাও তোমাকে খুব ভালোভাবে ভেবে দেখতে হবে।
সমস্যা: আমরা তিন ভাইবোন। বাবা চাকরিজীবী, মা গৃহিণী। আমরা একটি ভাড়া বাসায় থাকি। আমি এইচএসসি পরীক্ষায় দুবার খারাপ করেছি। আমাদের পারিবারিক অবস্থা বেশি ভালো নয়, আগে ভালো ছিল। আমার বড় ভাই বিদেশে থাকেন, তার পরের ভাই মাস্টার্সে পড়েন। আমার বাবার ক্যানসার হলে তাঁকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসা করানো হয়। আর তাতে পারিবারিক অবস্থা খারাপ হয়ে পড়ে এবং আমরা ঋণগ্রস্ত হয়ে যাই। এখন নিজের কথা বলি, আমি আমাদের বাড়িওয়ালার ছেলেকে খুব ভালোবাসি। সে পড়ে একটি বেসরকারি কলেজে আইন বিভাগে। আমি আর সে একই ক্লাসে পড়তাম। সে পাস করে আর আমি ফেল করি। আমি তাকে অনেক দিন ধরে ভালোবাসি। এ কথা যখন তাকে জানানোর সিদ্ধান্ত নিই, তখনই জানতে পারি সে তার মামাতো বোনকে ভালোবাসে। সে মেয়েটি অষ্টম শ্রেণীতে পড়ে।
আমার জানামতে, সে এর আগে কারও সঙ্গে সম্পর্ক করেনি আর আমিও কারও সঙ্গে সম্পর্কে জড়াইনি। এ জন্য তাকে খুব ভালোবাসি। কিন্তু সে অন্য মেয়েকে ভালোবাসে এ কথা জানার পর আমার মনের অবস্থা এমন হলো যে আমার চোখের পানি আর থামে না। একদিকে আমার পরীক্ষার ফল খারাপের চিন্তা অন্যদিকে আমরা অনেক টাকার ঋণগ্রস্ত—সবকিছুই হার মেনেছে ওকে নিয়ে আমার চিন্তাভাবনা করার কারণে। এতে আমি অনেক ভেঙে পড়ি।
মাঝেমধ্যে ওর জন্য আমার বুকের ভেতর এমন যন্ত্রণা শুরু হতো, মনে হতো বুকের ভেতর জ্বলেপুড়ে সব ছাই হয়ে গেছে। আবার মনে হচ্ছিল ক্ষতবিক্ষত ও রক্তাক্তও হয়ে গেছে। বেঁচে থেকেও আমি মরণের সাজা পাচ্ছি এমন মনে হচ্ছিল। আর তাই হাত পুড়িয়েছি। একটা ক্ষত বড়, আরেকটা ছোট। ছোট ক্ষতটা তাকে ভুলে যাওয়ার জন্য আর বড় ক্ষতটা মরণের একমুহূর্ত আগ পর্যন্ত তাকে মনে রাখার জন্য। যত কষ্ট-যন্ত্রণা নিজের ভেতরই লুকিয়ে রাখতে চাই। কারণ তাদের পথের কাটা কিংবা ব্যথার কারণ হতে চাই না। ভালোবাসা তো আর জোর করে হয় না। আর তাই জোর করিওনি এবং বলিওনি যে আমি তাকে ভালোবাসি। আমার চেহারা খারাপ নয়। তবুও সে আমার দিকে তাকিয়েও দেখে না।
নাম-ঠিকানা প্রকাশে অনিচ্ছুক।
পরামর্শ: তোমাদের পুরো পরিবারটি বাবার অসুস্থতার কারণে যেভাবে বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়েছে, সেটি খুব দুঃখজনক। তবে তোমার ভাইয়েরা যেহেতু কিছুটা স্বাবলম্বী হয়েছে, আশা করি তোমাদের বাবার ঋণ শোধ করায় তারা সহায়তা করতে পারবে। তবে তুমি দুবার পরীক্ষা দিয়েও কী কারণে সাফল্য পেলে না, সেটা কি বুঝতে পারছ? যে সব বিষয়ে তোমার দুর্বলতা রয়েছে, সে বিষয়গুলোতে শিক্ষকের সাহায্য নিয়ে কি উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব? যদি মনে কর তুমি এরপর আর পরীক্ষা দিতে চাও না, তাহলে অন্য কোনো কাজের প্রশিক্ষণ নিতে পার। কারিগরি কোনো শিক্ষা বা সৃজনশীল কোনো কাজে প্রশিক্ষণ নিয়ে তুমি নিজের একটি আয়ের পথ খুঁজে নিতে পার। যে ছেলেটিকে তুমি ভালোবেসেছ সে যদি অন্য কারও প্রতি অনুরক্ত থাকে, তাহলে তো কিছু করার নেই। কিন্তু ছেলেটির প্রতি অফুরন্ত ভালোবাসা যদি নিজের প্রতি তোমাকে ভালোবাসাহীন করে ফেলে তাহলে চলবে না। এভাবে নিষ্ঠুরের মতো নিজের হাত পুড়িয়ে কিন্তু নিজের প্রতি অত্যন্ত অন্যায় করেছ। এভাবে হাতে পোড়া দাগ দিয়ে কাউকে একই সঙ্গে ভুলে যাওয়া এবং মনে রাখা কি আদৌ সম্ভব? তা ছাড়া ওকে ভোলার প্রয়োজনই বা কী? তারচেয়ে বরং ওর প্রতি মমত্ববোধ ধরে রেখে, ওকে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারটুকু দিয়ে দাও। অনেক বেশি কষ্ট হলেও তুমি যদি বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে ছেলেটির সুখের জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করো, তাহলে তোমার এই উদারতার জন্য নিজেকে অনেক বেশি শ্রদ্ধা করতে পারবে। সৃষ্টিকর্তা মানুষকে ভালোবাসার অনুভূতি দিয়েছেন। তা আমরা কতটুকু, কার প্রতি এবং কতদিন ধরে রাখব সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাও সৃষ্টিকর্তা আমাদের দিয়েছেন। কাজেই এভাবে অন্ধের মতো এই অনুভূতিটি ধরে না রেখে, তুমি মনের শক্তি আর ক্ষমতাগুলোকে কাজে লাগাও, কেমন?
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, নভেম্বর ২৭, ২০১০
Leave a Reply