শাহ মো· কেরামত আলী
অধ্যাপক, ক্লিনিক্যাল নিউট্রিশন বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বিশ্বে হৃদরোগের পরই ক্যান্সারে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যায়। তাই ক্যান্সার নিয়ে বিশ্বব্যাপী নানা ধরনের গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা চেষ্টা করছেন ক্যান্সারের প্রকৃত কারণ নির্ণয়ের। তারা বেশ কিছু উপাদানকে ক্যান্সারের সম্ভাব্য কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এ ধরনের উপাদানগুলোর মধ্যে রয়েছে-
— বংশগত, অর্থাৎ ত্রুটিপূর্ণ জিন
— পরিবেশগত কারণ
— ধূমপান
— আয়োনাইজিং রেডিয়েশন
— বিভিন্ন ওষুধের প্রতিক্রিয়া
— খাদ্যদ্রব্য ও খাদ্যে ভেজাল, যেমন-ম্যাইক্রোটনিকস ও নাইট্রোসামাইনস
— মদ্যপান
— বিভিন্ন পেশাগত কারণ
— রাসায়নিক
— ভাইরাসজনিত কারণ প্রভৃতি।
যুক্তরাষ্ট্রের দুজন চিকিৎসাবিজ্ঞানী ডল ও পেটো, তাঁদের গবেষণালব্ধ ফলাফলে ১০ থেকে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত ক্যান্সারজনিত কারণ হিসেবে খাদ্যাভ্যাসকে চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু তাঁরা সুনির্দিষ্টভাবে কোন কোন খাদ্য উপাদান ক্যান্সার ঘটিয়ে থাকে তা উল্লেখ করেননি। ডল ও পেটোর গবেষণার পর থেকে বিভিন্ন খাদ্যোপাদান ও ক্যান্সার সম্পর্ক নিয়ে নানা ধরনের গবেষণা পরিচালিত হচ্ছে।
খাদ্যোপাদানগুলো দুই ভাগে ভাগ করা যায়, যেমন-ক· ম্যাক্রোনিউট্রিয়েনস, যেমন-শর্করা, আমিষ ও চর্বিজাতীয় খাবার।
খ· ম্যাইক্রোনিউট্রিয়েনস, যেমন-ভিটামিন ‘এ’ এবং বিটা ক্যারোটিন ভিটামিন ‘বি’ কমপ্লেক্স, ভিটামিন ‘সি’ ও ভিটামিন ‘ই’ সেলিনিয়াম, দস্তা ও ক্যালসিয়াম, এলকোহল প্রভৃতি।
শর্করা
শর্করাজাতীয় খাবার খাওয়ার সঙ্গে ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কা সম্পর্কে খুব কমই গবেষণা হয়েছে। দুজন চিকিৎসাবিজ্ঞানী তাঁদের একটি গবেষণার ফলাফলে যকৃতের ক্যান্সারের সঙ্গে খুব বেশি পরিমাণে আলু খাওয়ার একটি সম্পর্ক থাকতে পারে বলে উল্লেখ করেছেন। আরেকটি গবেষণায় বলা হয়েছে, পাকস্থলীর ক্যান্সারের সঙ্গে অতিরিক্ত শর্করা গ্রহণের একটি সম্পর্ক থাকতে পারে। আলু, ভাত বা রুটি পুড়ে তার মধ্যে ক্যান্সার উৎপাদক কারসিনোজেন বেড়ে গিয়ে এ ঘটনা ঘটায় বলে অনেকেই বলেছেন।
আমিষ
আমিষজাতীয় খাবারের সঙ্গে আমরা চর্বিও গ্রহণ করে থাকি, ফলে এ দুটি উপাদানের কোনটি কতটুকু পরিমাণ খাওয়া নিরাপদ, সে সম্পর্কে সচেতন হওয়া উচিত। দৈনিক যতটুকু পরিমাণ খাদ্যশক্তি গ্রহণ করা দরকার, তার চেয়ে বেশি যারা খান তাদের বেশি পরিমাণে মাংসজাতীয় খাবার খাওয়ার সঙ্গে স্তন ক্যান্সার হওয়ার একটি সম্পর্ক রয়েছে। আবার যারা পরিমিত খাবার খান, তাদের মধ্যে এ আশঙ্কা থাকে না। বলা হয়েছে, মাংস খেলে অগ্ন্যাশয়ের ক্যান্সারের ঝুঁকি বেড়ে যায়, অবশ্য এর সঙ্গে বেশি পরিমাণ চর্বিজাতীয় খাবার খাওয়ায় দায়ী। আমিষজাতীয় খাবার খাওয়ার সঙ্গে ক্যান্সার হওয়ার আদৌ কোনো সম্পর্ক রয়েছে কি না, সে সম্পর্কে এখনো কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি।
চর্বি ও শক্তি
উন্নত দেশগুলোয় পরিচালিত বিভিন্ন সমীক্ষার ফলাফলে বেশি পরিমাণে চর্বিজাতীয় খাবার খাওয়াকে বিভিন্ন রকম ক্যান্সারের একটি সম্ভাব্য কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে। অধিক পরিমাণে চর্বিজাতীয় খাবার খেলে স্তন কোলন ও প্রোস্টেটের ক্যান্সার বেশি হয় বলে ধারণা করা হচ্ছে। অবশ্য বিজ্ঞানী বার্গ কোনো একটি একক খাদ্য উপাদানকে চিহ্নিত না করে বলেছেন, প্রয়োজনের বেশি পুষ্টি গ্রহণই কোনো কোনো ক্যান্সারের সম্ভাব্য কারণ হতে পারে।
চিকিৎসাবিজ্ঞানী রোজারস এবং লং নেকার বলেছেন, বেশি পরিমাণে চর্বি বা চর্বিপ্রধান খাদ্য গ্রহণে স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ে। আবার আমেরিকার জাতীয় স্বাস্থ্য ও পুষ্টি সমীক্ষার ফলাফলে চর্বিজাতীয় খাদ্য গ্রহণের সঙ্গে স্তন ক্যান্সারের কোনো সম্পর্ক নেই বলে উল্লিখিত হয়েছে। অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় বিজ্ঞান পরিষদের খাদ্য, পুষ্টি ও ক্যান্সারবিষয়ক গবেষণার ফলাফলে দৈনিক খাদ্যশক্তির ৩০ শতাংশ চর্বিজাতীয় খাবার থেকে গ্রহণের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
আঁশযুক্ত খাবার
বারকিটস সর্বপ্রথম কোলন ক্যান্সারের সম্ভাব্য কারণ হিসেবে অল্প পরিমাণে আঁশযুক্ত খাবার গ্রহণকে চিহ্নিত করেছেন।
এ সম্পর্কে এখনো সুনির্দিষ্ট কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি, তবে নানা ধরনের গবেষণা চলছে। স্টকস ও কান নামে দুজন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী সর্বপ্রথম কোলন ক্যান্সারের সঙ্গে বিভিন্ন খাদ্য উপাদানের সম্পর্ক নিয়ে গবেষণা করেন। তাঁরা বলেন, রুটি, শাক-সবজি ও দুধ বেশি খেলে কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমে। আবার কোনো কোনো চিকিৎসাবিজ্ঞানী বলেন, মাংস, চর্বি ও আমিষজাতীয় খাদ্যের চেয়ে রুটি, শাকসবজি, দুধ ও দুধজাতীয় খাদ্য বেশি খেলে কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমে। অর্থাৎ শর্করা, খাবারের আঁশও সম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিড বেশি গ্রহণ করলে ক্যান্সারের ঝুঁকি কমে। এক গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে, শস্যজাতীয় খাবারের চেয়ে ফল ও শাকসবজিজাতীয় আঁশ বেশি খেলে ক্যান্সারের ঝুঁকি কমে।
নানা খাদ্য উপাদানের সঙ্গে বিভিন্ন রকম ক্যান্সার হওয়ার একটি যোগসূত্র থাকতে পারে-এমন মতামত ব্যক্ত করেছেন বেশ কয়েকজন চিকিৎসাবিজ্ঞানী। তাই এ ধরনের ক্যান্সারের ঝুঁকি এড়ানোর জন্য কিছু পরামর্শ রয়েছে, এগুলো হলো-
— শরীরের ওজন ঠিক রাখুন
— শাকসবজি, ফলমূল ও উদ্ভিজ্জ খাদ্য বেশি পরিমাণে খান
— দৈনিক খাদ্যশক্তির সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ পর্যন্ত চর্বিজাতীয় খাদ্য গ্রহণ করুন এবং সঙ্গে অন্যান্য খাদ্য উপাদানও পরিমাণমতো গ্রহণ করুন।
সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো, জুন ২৫, ২০০৮
Leave a Reply