‘আম্মু, দ্যাখো, প্লেনটা কী সুন্দর! আমাকে এটা কিনে দাও না আম্মু, প্লিজ!’
আট বছরের ছেলে মৃদুলকে নিয়ে লাবণী এসেছেন ধানমন্ডির একটি শপিং মলে, একটা বিয়ের দাওয়াতের উপহার কিনতে। কিন্তু উপহার কেনা মাথায় উঠল ছেলের চিৎকারে। তাকে প্লেন কিনে দিতে হবে। প্লেনের দাম শুনে তো লাবণীর আক্কেল গুড়ুম। চার হাজার টাকা। ছেলেকে লাবণী যতই বোঝাতে চেষ্টা করেন, সে ততই জেদ ধরতে থাকে—তাকে এই প্লেনটাই কিনে দিতে হবে। শেষে বাধ্য হয়ে লাবণী শুধু প্লেন কিনেই বাড়ি ফেরেন।
এ ধরনের বিব্রতকর পরিস্থিতিতে অনেক শিশুর মা-বাবাকেই পড়তে হয়। শিশুদের নিয়ে কোনো শপিং মলে গেলে তারা কিছু না কিছু কিনে দেওয়ার বায়না জুড়বেই। মাঝেমধ্যে তারা এমন দামি জিনিস আবদার করে ফেলে, দেখা যায় সেই পরিমাণ টাকা সঙ্গে থাকে না। সে ক্ষেত্রে মা-বাবাকে পড়তে হয় অস্বস্তিতে।
অনেক সময় পছন্দসই জিনিস কিনে না দিলে তারা অন্য মা-বাবার উদাহরণ টেনে রীতিমতো অপ্রস্তুত করে তোলে। শিশুদের এই অতিরিক্ত খরচের প্রবণতা কমিয়ে তাদের সঠিকভাবে অর্থের ব্যবহার শেখানোর দায়িত্ব কিন্তু মা-বাবারই। এ বিষয়ে গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের শিশুবর্ধন ও পারিবারিক সম্পর্ক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাহমুদা সুলতানা বলেন, ‘শিশুকে টাকা-পয়সার ব্যাপারে শেখানোর কোনো বিশেষ বয়স চিহ্নিত করা সত্যিই মুশকিল। কিন্তু যত তাড়াতাড়ি শুরু করা যায়, ততই ভালো। শিশুরা নতুন কিছু দেখলে আকৃষ্ট হবে, সেটা কিনতে চাইবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সব সময় তার চাওয়াতে ‘হ্যাঁ’ বলা যাবে না। তাহলে সে এটাতে অভ্যস্ত হয়ে যাবে। আবার তাকে সরাসরি ‘না’ বলাও যাবে না। তার ইচ্ছেটাকে আমলে রেখে তাকে ভালোভাবে বুঝিয়ে নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিশুমনোবিদ এস এম ফাতেমা ফেরদৌসী জানান, ছোট থেকেই যদি শিশুর সব চাওয়া পূরণ করা হয়, তবে এটাই সব সময় চলবে এমনটাই সে ধরে নেবে। এমনটি না করে তাই তার ভালো কাজের জন্য কোনো পুরস্কার দিতে হবে। যেমন পড়াশোনায় ভালো করলে তার পছন্দের কিছু কিনে দেওয়া যেতে পারে। তাহলে ভালো কাজ করে কিছু অর্জন করতে হয়—এই প্রবণতা শিশুদের মনে আস্তে আস্তে গড়ে উঠবে।
বয়ঃসন্ধিকালীন ছেলেমেয়েদের ব্যাপারে বাবা-মাকে অনেকখানি সতর্ক থাকতে হবে। কেননা, সে সময় তাদের মধ্যে অনেকখানি পরিবর্তন আসে। সে ক্ষেত্রে তার বয়স, প্রয়োজন, শখ ইত্যাদি বিবেচনা করে সে অনুযায়ী টাকা-পয়সা দিতে হবে।
মনে রাখুন
আপনার সন্তান টাকা-পয়সার ব্যবহার বুঝতে পারার সঙ্গে সঙ্গেই ওকে পরিচিত করুন অর্থ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে। আপনি অফিসে কাজ করেন, সেই কাজের বিনিময়ে বেতন পান, সেই টাকা দিয়ে যে ওর পছন্দের জিনিস কেনা হয়, আর বাকি টাকা ব্যাংকে জমা থাকে—এভাবে টাকা রোজগার, খরচ ও সঞ্চয়ের গুরুত্ব ওকে বুঝিয়ে বলুন সহজ ভাষায়।
ছেলেবেলা থেকেই আপনার সন্তানকে ‘শখ’ ও ‘প্রয়োজন’-এর মাঝে যে সূক্ষ্ম পার্থক্য আছে তা শেখান। দুটি আলাদা কার্ডে ‘শখ’ ও ‘প্রয়োজন’-এর একটা তালিকা বানান। প্রয়োজনের মধ্যে পড়বে বাজার খরচ, বাড়িভাড়া, স্কুলের বেতন, যাতায়াতভাড়া ইত্যাদি। আর শখের তালিকায় আসবে খেলনা, রেস্টুরেন্টে খাওয়া, শৌখিন উপহার ইত্যাদি। কিন্তু সীমিত টাকার মধ্যে কীভাবে শখ আর প্রয়োজনের মধ্যে ভারসাম্য আনা যায়, সে ব্যাপারে সন্তানের সঙ্গে আলোচনা করে তাকে বিভিন্ন সুযোগ দেখাতে পারেন; যেমন—বন্ধুর জন্মদিনে নিজেই উপহার তৈরি করা, কাছাকাছি দূরত্বে রিকশা না নিয়ে হেঁটে যাওয়া ইত্যাদি।
সন্তানের জন্মদিনে টাকা জমানোর একটা সুন্দর ব্যাংক উপহার দিন। অন্যদের উপহার দেওয়া টাকাও চটপট খরচ না করে ব্যাংকে ফেলে জমিয়ে রাখতে বলুন। আপনার কিনে দেওয়া কোনো জিনিস নষ্ট হলে ওকে বলুন ওর জমানো টাকা থেকে ঠিক করে নিতে।
মাসে একটা নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা সন্তানের প্রয়োজন অনুযায়ী হাতখরচ হিসেবে দিন। এ ব্যাপারে অন্য বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে কোনো তুলনা করা ঠিক নয়। কোনো কারণে বাড়তি টাকার প্রয়োজন হলে কেন প্রয়োজন জেনে তবে টাকা দেবেন। শুধু বায়না বা জেদের বশবর্তী হয়ে চাইলে তাকে টাকা দিলে তা সন্তানেরই ক্ষতি করবে।
আপনার সন্তান বয়ঃসন্ধিতে পা রাখলে বাড়ির ছোটখাটো কাজ (যেগুলো লোক রেখে করান) ওকে করতে বলুন। যে টাকাটা বাইরের লোককে দিতে হয়, তা ওকেও দিন। তবে ব্যক্তিগত কাজ যেমন ঘর গুছিয়ে রাখা, পড়ার টেবিল পরিষ্কার করা—এসবের জন্য কখনোই টাকা দেবেন না। কেননা, এটা ওর নিজের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। তবে সিঁড়ি, বাগান পরিষ্কার করা, বিল জমা দেওয়া ইত্যাদি কাজের জন্য পারিশ্রমিক দিলে পরিশ্রম করে রোজগার করার একটা স্বাদ পাবে।
স্কুল পেরোনোর পর থেকেই সন্তানকে আয় করতে উৎসাহ দিন। পড়ানো, পত্রপত্রিকায় লেখালেখি বা ছবি তোলার মতো কাজ পড়াশোনার পাশাপাশি চালানো খুব একটা কঠিন নয়। এতে অভিজ্ঞতা ও হাতখরচ দুই-ই জমা হয়।
ছেলেমেয়ে রোজগার করতে শুরু করলে প্রয়োজন না হলেও তারা যেন পরিবারের কিছু খরচ বহন করে, সে ব্যাপারে জোর দিন। কেননা, এতে সন্তানের দায়িত্ববোধ গড়ে উঠবে।
রওশন আক্তার
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুন ১৫, ২০১০
Leave a Reply