তোমার বন্ধুটি এসএসসি পরীক্ষায় খারাপ ফল করেছে। ওর মন খারাপ। একসঙ্গেই পড়াশোনা করেছ তোমরা। একই স্কুলে কাটিয়েছ দিনের পর দিন। সবার পরীক্ষার ফলই ভালো হবে, এ রকমই ভেবেছিলে। কিন্তু হঠাৎ তোমাদের মতো জিপিএ-৫ পেল না ও। মন খারাপ তো হবেই।
ফল খারাপ হয়েছে বলেই ওর মন খারাপ, তা কিন্তু নয়। চারদিক থেকে সবাই ওর দিকে তাকিয়ে ফেলছে দীর্ঘশ্বাস। ‘উহু, আহা’ করে সান্ত্বনা দিচ্ছে কেউ কেউ। তাতে বরং ওর মেজাজ আরও খারাপ হচ্ছে। মনে হচ্ছে, কাটা ঘায়ে দেওয়া হচ্ছে নুনের ছিটা। ‘তোমার বন্ধু আর তুমি তো একই রকম পড়াশোনা করেছিলে, তোমার রেজাল্ট খারাপ হলো কেন?’ কেউ কেউ এই প্রশ্ন করে বিষিয়ে দিচ্ছে ওর মন। তোমরাও বুঝতে পারছ না, ওর সঙ্গে কী কথা বলবে। বুঝতে পারছ না, তোমাদের একসারিতে ডেকে নিয়ে কীভাবে ভালো করবে ওর মন।
তোমার এই প্রিয় বন্ধুটির মন ভালো করা, তার মন শক্ত করানোর কাজটি কিন্তু তোমাদের। তোমরাই পারো ওকে এই দুঃসহ অবস্থা থেকে মুক্তি দিতে। বুঝিয়ে দিতে পারো, কাঙ্ক্ষিত ফল না পাওয়াটা জীবনের এমন কোনো বড় ঘটনা নয়। লেগে থাকলে সামনের দিনগুলোয় আরও অনেক ভালো ফল বের করে আনতে পারবে ও।
মিথিলার কথা বলি। কুষ্টিয়া সরকারি বালিকা বিদ্যালয় থেকে এবার এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছিল মেয়েটা। ছুটিতে এসেছে ঢাকায়। বাণিজ্য বিভাগ থেকে জিপিএ ৪.২৫ পেয়েছে। ওর বন্ধুদের অনেকেই পেয়েছে জিপিএ-৫। শুরুতে একটু মন খারাপ হয়েছিল মিথিলার। কিন্তু ওর বন্ধুরাই ওর দিকে বাড়িয়ে দিয়েছে সাহায্যের হাত। আড্ডায় সবাই মিলেছে, ওর কাছে এসে বলেছে, ‘দোস্ত, আরেকটু ভালো করে পড়বি। দেখবি এইচএসসিতে আমাদের চেয়েও ভালো ফল হবে তোর।’ স্কুলের শিক্ষকদের কাছেও দল বেঁধে গেছে ওরা। তাঁরাও খুব ভালো ব্যবহার করেছেন। বলেছেন, এটা তো কেবল শুরু। সামনে পড়ে রয়েছে অনেক পথ। সে পথ পাড়ি দেওয়ার জন্য নিজেকে তৈরি করো।
সবার ভাগ্য নিশ্চয় মিথিলার মতো ভালো নয়। অনেকের বাড়িতেই মা-বাবা, আত্মীয়স্বজন মন খারাপ করছেন। ভালো ফল করতে না পারায় দীর্ঘশ্বাস ফেলছেন। তাতে মনটা আরও খারাপ হয়ে যাচ্ছে। সামনের দিনগুলোকে বিবর্ণ বলে মনে হচ্ছে।
মুশকিল হলো, পড়াশোনার বই নিয়ে সারা দিন পড়ে থাকতে হয় বলে অনেক সময়ই পড়ায় মন বসে না। একটু বিনোদনের জন্য খুলে বসবে টেলিভিশন, কিন্তু সেখানে যা দেখছ, তার অনেক কিছুই তোমার বয়সের উপযোগী নয়। বিশেষ করে, এই যে এখন হিন্দি সিরিয়ালগুলো জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে, তাতে কি সত্যিকার বিনোদন আছে? অর্থের জৌলুশ, একে অন্যের পেছনে লেগে থাকা আর ভোগবাদী চিন্তাই উগড়ে দিচ্ছে সেগুলো। তোমার যদি কম্পিউটার থাকে আর তাতে যদি থাকে ইন্টারনেটের সুবিধে, তাহলেও তো তুমি সেখানে পেয়ে যাচ্ছ অবাধ সাঁতারের সুযোগ। কিন্তু সেখানে মজে গেলে পড়াশোনার বারোটা বাজতে দেরি হবে না। রাজধানীর শিক্ষার্থীদের জন্য খেলার মাঠ তো এখন দুর্লভ বিষয়। সত্যি সত্যি খেলার মাঠের সঙ্গে সখ্য আছে কজনের?
তাই, পড়াশোনার মধ্যেই কেটে যায় দিন-রাত। বন্ধুদের মধ্যে যে আড্ডা, তারও বিষয় ঘুরেফিরে পড়াশোনাই। ফলে পরীক্ষা, ফলাফল ইত্যাদি নিয়েই শৈশব-কৈশোর। অন্য স্বপ্নগুলো আর বেড়ে উঠতে পারে না। মনের ভেতর গড়ে দিতে পারে না ওড়ার ঠিকানা। এ রকম অবস্থায় এসএসসি পরীক্ষার হলে বসো তোমরা, পরীক্ষা দাও। কারও ফল ভালো হয়, কারও খারাপ। যারা একটু খারাপ করলে, তাদের ব্যর্থতাকে ব্যর্থতা মনে না করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা দেওয়া হলেই সবকিছু ভালোর দিকে যায়।
মা-বাবা, অভিভাবকদের আচরণটাও এ সময় গুরুত্বপূর্ণ। তাঁরা নিজের সন্তানের ব্যর্থতায় হতাশ হন, অন্যের সঙ্গে তুলনা করে সন্তানের মনের ক্ষত বাড়িয়ে দেন আরও। শিক্ষকেরাও মেতে থাকেন ভালো ফল করা শিক্ষার্থীদের নিয়ে। যে পারল না লক্ষ্যে পৌঁছতে, তাকে অগ্রাহ্য করেই চলে আনন্দ-উৎসব। তোমরাও যদি এ সময় তোমার কাছের বন্ধুটির পাশে না দাঁড়াও, তাহলে হতাশা ওকে মারাত্মক কোনো সিদ্ধান্তের দিকে নিয়ে যেতে পারে। তুমি ওকে বুঝিয়ে বলো, ফলাফল তোমাদের বন্ধুত্বের মাঝে ফাটল ধরায়নি। আগে যেভাবে মুঠোফোনে ওর সঙ্গে কথা বলতে, সেভাবেই বলতে থাকো। আগে যেভাবে একসঙ্গে ঘুরতে বেরিয়ে পড়তে, সেভাবেই বেরিয়ে পড়ো। তুমি যদি নিজের গর্বে আচ্ছন্ন থাকো, তাহলে তোমার বন্ধুটি নিজেকে গুটিয়ে নেবে। ওর মনে শ্রেষ্ঠত্বের প্রশ্নটিই আসতে দিয়ো না। ওকে নিয়েই এগিয়ে যাও তুমি।
যে ছেলে বা মেয়েটি পরীক্ষায় খারাপ করেছ, তাকে বলি: সবার আগে বুঝতে হবে, অন্যের সঙ্গে তুলনা মানুষকে নিঃশেষ করে দেয়। তুলনা হবে নিজের সঙ্গে নিজের। তুমি বাংলা আর রসায়নে ৫ পয়েন্ট করে পেয়েছ, পদার্থবিজ্ঞানে পেয়েছ একটু কম। তোমার প্রতিযোগিতা হবে পদার্থবিজ্ঞানেও ফলের চূড়োয় ওঠার। তোমার প্রতিভাবান বন্ধুটি অসাধারণ ফল করেছে, তাতে তুমি গর্বিত হবে, কষ্ট পাবে না। তুমি নিজের প্রতি বিশ্বাস রেখেই করবে পড়াশোনা। তাতে যে ফল আসবে, সেটাই তুমি। সেটা যদি খারাপও হয়, তাতে ভেঙে পড়লে চলবে না। মন শক্ত করে প্রস্তুত হও সামনের বাধাগুলো অতিক্রম করার জন্য।
সেন্ট গ্রেগরী হাইস্কুলের বাংলার শিক্ষক হুমায়ূন কবীর শোনালেন আশার কথা। এ বছর তাঁদের স্কুলের প্রধান শিক্ষক যারা পরীক্ষা দিল, তাদের মনস্তাত্ত্বিক দিকটির দিকেও নজর দিয়েছেন। যারা পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পায়নি, তাদের তুলে দিয়েছেন মঞ্চে। কেন ফল খারাপ হলো, ভবিষ্যতে কীভাবে ভালো করা যাবে—এ বিষয়গুলো ওরা বলেছে মঞ্চে দাঁড়িয়ে। জীবনের প্রথম বড় পরীক্ষায় একটু খারাপ করেছে বলেই ওরা পরিত্যাজ্য, তা তো নয়। সব জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীই কি এইচএসসিতে উঠে ভালো ফলাফল করে? যারা এসএসসিতে জিপিএ-৫ পায়নি, তারা কি এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পায় না? হুমায়ূন কবীর বললেন, ‘আমি ওদের বলেছি, তোমরা পারবে। সামনে এইচএসসি, বিশ্ববিদ্যালয়, কতগুলো ধাপ! প্রথম দরজায় হোঁচট খেয়েছ বলে পরেও পিছিয়ে থাকবে, এমন ভাবছ কেন? তুমি পারবে। বন্ধুরাও তোমাদের উৎসাহ দেবে।’
ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের বাংলার শিক্ষক পারভীন বানু বললেন, ‘দু-তিন বছর ধরে এত বেশিসংখ্যক শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পাচ্ছে যে প্রত্যেকেরই প্রত্যাশা এখন জিপিএ-৫ পাওয়া। কিন্তু শুধু জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীরাই কেবল ভবিষ্যতে ভালো করবে, এমন কোনো কথা নেই।
আমরা ওদের বলি, মন খারাপ কোরো না। সামনে ভালো করো। পাঠ্যবইয়ের বাইরের জগতের সঙ্গেও পরিচিত হও। পড়াশোনাও চালিয়ে যাও। দেখবে, ভালো করছ।’
পরীক্ষায় খারাপ করেছ বলে সব শেষ হয়ে গেল—এমন ভাবাটাই বোকামি। বরং যে আঘাত পেয়েছ, তার রেশ থাকতে থাকতেই নতুন করে প্রস্তুত করো নিজেকে। বন্ধুতা শুধু একই রকম ফলের ওপর নির্ভর করে না, এতটা যান্ত্রিক নয় জীবন। তাই হতাশাকে ঝেড়ে ফেলে নিজেকে নিজের যোগ্য করে তোলো, তবেই দেখবে সামনে অন্ধকার নয়, ঝকঝকে রোদ্দুর।
জাহীদ রেজা নূর
মডেল: সুকৃতি, মৌ, নাহিয়ান, শ্রাবণী ও আপন
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুন ০১, ২০১০
Leave a Reply