নজরুলের গানে প্রেম-বিরহের বর্ণনায় নানা রকম ফুলের কথা এসেছে বারবার। আজকের আধুনিক মেয়েটি যদি সেই বকুল, জবা, বেলি কিংবা মাধবীলতায় সাজে, তবে কেমন দেখাবে তাঁকে?
শিউলিগুলো অপেক্ষা করছে সেই ভোর ফোটার আগে থেকেই। গাছের তলাজুড়ে সাজিয়ে-গুছিয়ে বসে আছে ফুলকুড়োনির আশায়। অবশেষে দেখা মিলল তার। কচি কোমল হাতের ছোট্ট ফুলকুড়োনি একে একে কুড়িয়ে নিল সব ফুল। সু্ঁই আর সুতোয় গেঁথে তাকে করে তুলল মালা। কিছু সময় পর তাকে পাওয়া গেল খোঁপায়। মিষ্টি হাসছে তারা! ওদিকে শিউলির মতো ঝুমকো জবা অপেক্ষায় আছে এলোচুলে ঠাঁই পাওয়ার, বেলি আর চাঁপারা বিনুনিতে দোলার, বকুলেরা হতে কণ্ঠহার।
বকুল, শিউলি, চাঁপা, বেলিরা যখন সেজে উঠতে এত আকুল, তাদের কেন বঞ্চিত করবেন? কাজী নজরুল ইসলামের গানে অনেকবার এসেছে এই ফুলগুলোর কথা। এসব ফুলকে কবি নিয়ে এসেছেন মেয়েদের নানান সাজে। আজকের মেয়ের সাজেও এই ফুলগুলো দারুণ মানিয়ে যায়। ফুলের সাজ আজকাল আর শুধু গায়েহলুদ বা বিয়ের অনুষ্ঠানে সীমাবদ্ধ নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করতে আসা কারও কানে গোঁজা ফুলটা অথবা সাঁঝের আলোয় অফিস থেকে ফেরার পথে কারও হাতে জড়িয়ে থাকা বেলি ফুলের মালাটা কিন্তু দেখতে বেশ ভালোই লাগে। ফুলের এ সাজ যেন বাঙালি নারীর চিরন্তন সাজ।
নজরুলসঙ্গীতশিল্পী ফাতেমা-তুজ-জোহরা বলেন, ‘কবি নজরুল তাঁর গানে মেয়েদের সাজিয়েছেন বকুল, চাঁপা, টগর, বেলফুল, পলাশ, রঙ্গন দিয়ে। বেলি, কদম্ব, গোলাপ, জবা দিয়ে সাজিয়েও তাঁর সাধ মেটেনি। আকাশের তারাটাকেই ফুল বানিয়ে পরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন প্রিয়ার খোঁপায়। একবার সব বন্ধু মিলে বেশ আড্ডা জমিয়েছিলেন। কার প্রিয়াকে কে কীভাবে সাজাবেন তাই নিয়ে চলছিল আলোচনা। কেউ সাজিয়েছিলেন সোনার হার দিয়ে, কেউ বা হীরের দুল। নজরুল তখন গেয়ে উঠেছিলেন, ‘মোর প্রিয়া হবে এসো রানী, দেব খোঁপায় তারার ফুল…।’
সবার বেশ বাহবা কুড়িয়েছিলেন তখন। নজরুল তাঁর কল্পনার নারীকে সাজিয়েছিলেন এভাবেই।’
শিল্পী সুজিত মোস্তফা বলেন, ‘নজরুল তাঁর গানের মাঝে ফুলে ফুলে মনের মাধুরী মিশিয়ে এঁকেছিলেন তাঁর প্রিয়া প্রতিমাকে। কল্পনার রঙে সাজিয়েছিলেন নারীমূর্তিকে নানান রূপে। কখনো পরিয়েছেন চাঁপা রঙের শাড়ি আর খয়েরি টিপ, খোঁপায় জড়িয়ে দিয়েছেন হলুদ গাঁদার মালা; মেঘনীল শাড়ির সঙ্গে জুড়ে দিয়েছেন ধানি রঙের চুনারিয়া আর নিম ফুলের মৌ; কখনো খুলে দিয়ে খোঁপা, এলোচুলে গুঁজে দিয়েছেন ঝুমকো-জবা অথবা বিনুনিতে মাধবীলতা। প্রিয়াকে দেখেছেন কখনো দোলনচাঁপার বনে, প্রিয়ার নামে ডাকিয়েছেন কুহু, পাপিয়া; নীলাম্বরী শাড়ির সঙ্গে পরিয়ে দিয়েছেন গলায় নীপমালা। বকুল-চাঁপার বনে হয়েছেন চাঁদের স্বপন আবার ভোরবেলায় শিউলিতলায় পল্লিবালার শেফালি গোঁজা খোঁপাতে হয়েছেন উতলা। কখনো রেশমি শাড়ি আর যূথিক মালা পরা প্রিয়ার পা রাঙিয়েছেন রাতুল আলতায়। দেখিয়েছেন চামেলি-চাঁপার জন্য প্রিয়ার চুল না বাঁধার অভিমান। কখনো মালা গাঁথার বাসনায় প্রিয়াকে ফুল ভেবে নিজেই হয়ে পড়েছেন সুতো। ফুলমালীর জন্য অপেক্ষা করতে করতে নিজেই বিলিয়েছেন টগর, যূথি, চামেলি।’
রূপবিশেষজ্ঞ কানিজ আলমাস খান জানান, নজরুলের সাজের ঘরানায় আধুনিক সাজটা কিন্তু বেশ ভালোই লাগবে। নজরুল যে ফুলে তাঁর কল্পনার প্রিয়াকে সাজিয়েছেন, পথে হাঁটতে হাঁটতে হয়তো পাশের ঝোপটাতেই তাদের কারও না কারোর দেখা পাবেন। চট করে কানে একটা ফুল গুঁজে নিন না, দেখবেন আপনার সাজটাই বদলে গেছে। শুধু তাই নয়, যেকোনো উৎসব, জমকালো অনুষ্ঠানেও সাজের সঙ্গে একটা ফুল যোগ করে স্নিগ্ধতা ফুটিয়ে তোলা যায়। শাড়ি পরলে একটা বেণি করে তাতে গুঁজে দিতে পারেন বকুল অথবা শেফালির মালা। হাতাকাটা কামিজের সঙ্গে চুল খানিকটা পনিটেইল করে ঝুঁটিটা একগুচ্ছ বেলির মালায় সাজিয়ে নিতে পারেন। কোনো বন্ধুর গায়েহলুদে যাচ্ছেন? গয়নার পরিবর্তে মাধবীলতার দুলটা কানে কিন্তু বেশ ভালো লাগবে।
হালফ্যাশনের ফতুয়া, জিনস পরেছেন তাতে কী? চুল খুলে একটু এলোমেলো ভাব এনে কানে গুঁজে দিন না একটা স্বর্ণচাঁপা অথবা কানের নিচে ঘাড়ের কাছে ঝুলিয়ে দিন একটা ঝুমকো-জবা। দেখবেন ফুলের মতোই সবার মাঝে কেমন আলাদা হয়ে ফুটে উঠেছেন আপনি।
শান্তা তাওহিদা
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মে ২৫, ২০১০
Leave a Reply