সমস্যা: আমি সম্মান চতুর্থ বর্ষে পড়ছি। আমার এক সহপাঠীর সঙ্গে ফোনে অনেক কথা হয়, তারপর গড়ে ওঠে খুব ভালো বন্ধুত্ব। কোনো একসময় আমি তাকে ভালোবেসে ফেলি। তার কথায় মনে হতো, সেও আমাকে ভালোবাসে। একসময় জানতে পারি, তার অন্য মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক আছে। তাকে বললে সে বলে, সে আমাকেই ভালোবাসে। কিন্তু সে ওই মেয়েকে না বলতে পারবে না, কারণ মেয়েটির তো কোনো দোষ নেই। কিন্তু আমাকে ছাড়া সে এখানে চলতে পারবে না। আমি মাঝখানে তার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিই; কিন্তু তাতে সে বিপথে চলে যায়। আমাকে অনুরোধ করে ভালোভাবে কথা বলার জন্য। আমি কথা বলি, চাই সে ভালো করুক। সেও সব সময় চায় আমার সান্নিধ্যে আসতে। সে বলে, আমাকে ছাড়া তার চলবে না। আমি চাই সে ভালো করুক, কিন্তু এমন সম্পর্কে জড়াতে চাই না। মনের দিক থেকে ভেঙে পড়ছি। আমি ভালোভাবে কথা না বললে সে পড়ে না। আমি এখন কী করব?
শ্রেয়সী
খুলনা।
পরামর্শ: যে মানুষটি তোমাকে ভালোবাসে, অথচ অন্য একটি মেয়ের সঙ্গে ভালোবাসার অভিনয় করছে, তার নৈতিক মূল্যবোধ নিয়ে প্রশ্ন এসে যায়। বোঝা যাচ্ছে, ছেলেটির আবেগীয় বিকাশ ঠিকমতো হয়নি। অন্য মেয়েটির কোনো দোষ নেই বলেই বরং তাকে মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে রাখাটা মোটেও ঠিক হচ্ছে না। আমি অত্যন্ত দুঃখিত যে, তোমার প্রিয় মানুষটির ব্যাপারে খুব ইতিবাচক কিছু বলতে পারছি না। তোমার এতে মন খারাপ হতে পারে। কারণ, তুমি হয়তো তার ভালো দিকগুলো বেশি দেখতে পাও। আমি তোমাকে ভেবে দেখতে অনুরোধ করব, তুমি দিনের পর দিন একটা ‘বুড়ো খোকা’কে অতিরিক্ত সময় দিয়ে নিজের লেখাপড়ার ক্ষতি করবে, নাকি যে অভিভাবকেরা তোমার ওপর অনেক প্রত্যাশা নিয়ে বসে রয়েছেন, তাঁদের স্বপ্ন পূরণে মনোযোগী হবে? আজকাল মেয়েরা নিজের পায়ে দাঁড়াতে না পারলে অত্যন্ত কঠিন এই সময়ের সঙ্গে তাল মেলানো সম্ভব নয়। আর তা ছাড়া ভালো কিছু ব্যক্তিগত অর্জন আমাদের কিন্তু অনেক আত্মবিশ্বাসীও করে তোলে। আমি আশা করব, তুমি সবচেয়ে প্রথমে নিজের জীবনকে মূল্য দেবে এবং ছাত্রজীবনের প্রধান দায়িত্বটিকে মাথায় রেখে আগামী দিনগুলোর মুখোমুখি হবে। আমরা কাউকে এভাবে সময় দিতে থাকলে তাকে কিন্তু আরও বেশি পঙ্গু করে রাখা হয়। তারা নিজেদের ভুল থেকে শিখতে পারে না এবং এতে তাদের বরং অপকারই করা হয়—এ কথাটি মনে রেখো, কেমন? অনেক শুভ কামনা রইল।
সমস্যা: আমার এক নারীর সঙ্গে এক বছরের গভীর সম্পর্ক। ওই নারী বিবাহিত। তার এক মেয়ে ও এক ছেলে আছে। স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া করে গত নভেম্বরে স্বামীকে তালাক দেয় এবং আমার কাছে ঢাকায় আসে। আমার কাছে তার স্বামীর সঙ্গে সম্পর্ক আর থাকবে না বলেও জানায়। আমিও তার রূপে, কথায় দুর্বল হয়ে পড়ি। তাকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়ে তার সঙ্গে আরও গভীরভাবে জড়িয়ে পড়ি। কয়েক মাস পর জানতে পারি, সে আবার তার স্বামীর সঙ্গে ঘুরে বেড়ায়। কারণ খুঁজতে আমি চট্টগ্রামে যাই সিটি করপোরেশনের সালিসি আদালতে। সেখানে দেখি, তাদের কাবিন না থাকায় তালাক স্থগিত রাখা হয়েছে। তার পরও সে আমার কাছে এবং ঢাকায় থাকতে চায়। আমি বিবাহিত। আমার একটি সন্তান আছে। আর তার স্বামীর ওপর প্রতিশোধ নিতে যা করেছি, এখন মনে করি ভুল করেছি। দুটি সন্তানের জন্য তার স্বামী আমার কাছে ভিক্ষা চেয়েছেন তার সংসার ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য। আমিও এখন এই নারী থেকে দূরে থাকতে চাই।
মোহাম্মদ আমিনুল
ঢাকা।
পরামর্শ: তুমি যে শেষ পর্যন্ত তোমার ভুল বুঝতে পেরেছ, সে জন্য ধন্যবাদ। আশা করি, এ থেকে তুমি শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতে সতর্ক থাকবে এবং তোমার নিরপরাধ স্ত্রী এবং সন্তানের প্রতি কর্তব্য পালনে ব্রতী হবে। বিয়ে একটি পবিত্র বন্ধন এবং এই সম্পর্কের ক্ষেত্রে অনেক বেশি দায়িত্বশীল ও অঙ্গীকারবদ্ধ থাকা অত্যন্ত জরুরি। বিবাহিত থাকা অবস্থায় অন্য একটি সম্পর্কে জড়িয়ে গেলে স্ত্রী ও সন্তানের প্রতি শুধু অন্যায় করা হয় না, এতে করে নিজের বিবেকের কাছেও জবাবদিহির প্রশ্ন এসে যায়। সন্তানদের তো আমরা নিজেদের স্বার্থেই পৃথিবীতে নিয়ে আসি, তাই না? তাদের জন্ম দেওয়ার পর যত দিন পর্যন্ত তারা জীবনে একা চলতে সক্ষম না হয়, তত দিন কিন্তু তাদের মূল চাহিদাগুলোর দায়িত্ব নেওয়া শুধু নয়, তাদের একজন মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্বও মা-বাবাকে নিতে হবে। অভিভাবকদের কোনো কার্যকলাপ দেখে তারা যদি মনে কষ্ট পায় বা অনৈতিক কিছু শেখে, তার সম্পূর্ণ দায়িত্ব বর্তায় অভিভাবকদের ওপরই। ওই নারী ও তোমার যে সন্তানেরা রয়েছে, তারা কিন্তু ভালো ‘রোল মডেল’ দেখে বড় হচ্ছে না। আমরা মনে করি, শিশুরা তো অনেক ছোট, তারা কিছুই বুঝতে পারছে না, কিন্তু বিয়ের বাইরের প্রেমের সম্পর্কের কারণে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যে মনোমালিন্য হয়, সন্তানদের ওপর তার প্রভাব অত্যন্ত নেতিবাচকভাবে পড়ে। তা ছাড়া তাদের সুস্থ মানসিকতা গড়ে তোলার জন্য মা-বাবাকেও বিবেকসম্পন্ন এবং সুস্থ মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের অধিকারী হতে হবে। সমাজের প্রতিও আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে, সব দিক থেকে যতটুকু সম্ভব সুন্দর মানুষ উপহার দেওয়া। তারা যেহেতু দেশের ভবিষ্যত্ নাগরিক, তাই তাদের সুস্থ বিকাশ নিশ্চিত করার কাজটি অভিভাবকদের অবশ্যই করতে হবে। জীবন কিন্তু নাটক-সিনেমা নয়, এখানকার বাস্তবতা এবং সামাজিক আদর্শগুলোকে অবহেলা করলে অনেক বেশি মূল্য দিতে হয়। ওই নারীর কাছ থেকে দূরে থাকার সিদ্ধান্ত তুমি যদি সত্যিই নিয়ে থাক, তাহলে তো ভালো কথা। এরপর সে কী করবে সেটা কিন্তু সম্পূর্ণ তার ব্যাপার। আমরা কেউ কারও কাজের জন্য দায়ী নই। কারণ, প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ শেষ পর্যন্ত নিজের সিদ্ধান্তেই সব কিছু করে। আশা করি, যা কিছু ঘটেছে তা পেছনে ফেলে রেখে তুমি স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হবে। কারও বাইরের সৌন্দর্যে অভিভূত না হয়ে যে মানুষগুলো মনের দিক থেকে সুন্দর, তাদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবে।
অধ্যাপক ড. মেহতাব খানম
কাউন্সেলিং সাইকোলজি
মনোবিজ্ঞান বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জানুয়ারী ০২, ২০১০
Leave a Reply