সমস্যাঃ আমি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি। এক বছর আগে এক ছাত্রীর সঙ্গে পরিচয় হয় এবং তাকে ভালো লাগে জানালে সে ইতিবাচক সাড়া দেয়। মোবাইল ফোনে বেশ কয়েক মাস আলাপ এবং দেখা-সাক্ষাৎ নিয়মিত হয়েছিল। আমার স্বপ্ন ছিল পড়াশোনা শেষে চাকরি পেলে তাকে বিয়ে করব। কিন্তু এখন সে আমাকে এড়িয়ে চলে, আমার সঙ্গে কথা বলে না। আমার মাকে অনেক শ্রদ্ধা করি ও ভালোবাসি কিন্তু নি্নোক্ত কারণে নারী জাতির প্রতি আমার প্রচণ্ড ঘৃণা হয়। মেয়েদের প্রত্যাশা পুরুষের চেয়ে বেশি। যেমন-শিক্ষিত ও চাকরিজীবী মেয়েরা তার থেকে কম শিক্ষিত ও কম মর্যাদা বা বেকার ছেলেকে বিয়ে করে না। কিন্তু ছেলেরা তা করে। যেসব ছেলে মেয়েদের পণ্য হিসেবে দেখে, মেয়েরা সেসব ছেলেকেই বেশি পছন্দ করে। বেশির ভাগ মেয়ে বিয়ের পর স্বামী ও সংসার একান্ত তার করে পেতে চায় এবং শ্বশুর-শাশুড়ি ও অন্য সদস্যদের মূল্যায়ন করে না। মেয়েরা খুব কৃপণ হয়। বেশির ভাগ পারিবারিক অশান্তি ও দ্বন্দ্বের জন্য মেয়েরাই দায়ী। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমি আর বিয়ে করব না, বাকি জীবনটা সামাজিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে আত্মনিয়োগ করব।
মাহফুজ
পরামর্শঃ কেবল একটি মেয়ের কাছ থেকে দুঃখ পেয়ে মেয়েদের প্রতি এতটা নেতিবাচক ধারণা পোষণ করছ, নাকি আগে আরও কোনো ঘটনা ঘটেছে, তা বুঝতে পারিনি। নারী জাতির প্রতি ঘৃণা বুকে নিয়ে তুমি সমাজসেবামূলক কী ধরনের কাজ করতে পারবে, সে বিষয়েও আমি সন্দিহান। কারণ, সমাজের অবহেলিত গোষ্ঠী কিন্তু নারী ও শিশুরাই। শুধু পুরুষদের নিয়ে তো সমাজ তৈরি হয়নি, সেখানে তো অর্ধেকই নারী। তুমি কি তাদের বাদ দিয়ে সমাজের সেবা করতে চাও? তোমার মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলতে চাই, তোমার সঙ্গে আমি একমত নই। কিছু উদাহরণ টেনে সমাজের সব নারী বা পুরুষকে এক কাতারে দাঁড় করানোটা খুব যুক্তিযুক্ত নয়। তুমি বলতে চেয়েছ, ছেলেরা কম যোগ্যতাসম্পন্ন বেকার মেয়েদের বিয়ে করে। এটা কি সমাজেরই প্রত্যাশা নয়? একটি মেয়ে খুব উচ্চশিক্ষিত হলে এবং অনেক বেশি উপার্জন করলে কিন্তু অনেক ছেলেও তাকে বিয়ে করতে চায় না। কারণ, সমাজ আশা করে মেয়েটি ছেলেটির চেয়ে সব দিক থেকে কম যোগ্যতাসম্পন্ন হবে। সব মেয়েই রুচিহীন ছেলেদের বেশি পছন্দ করে, এ ধারণাটিও আমি সমর্থন করতে পারছি না বলে দুঃখিত। হ্যাঁ, মেয়েরা স্বামীকে একান্ত করে পেতে চায় এ কথাটি সত্য। কারণ, বেশির ভাগ মেয়ের মনের গভীরে ভীষণ রকমের নিরাপত্তাহীনতা কাজ করে। আমার মতে, এর মূল কারণ, বোধশক্তি হওয়ার পর থেকেই মেয়েদের মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়-যে ঘরে তার জন্ম হয়েছে সেই ঘরটি তার নয়, তাকে চলে যেতে হবে অন্য কোনো ঘরে। এ কারণেই মেয়েরা একটু হিসাব করে চলতে চায়। পৃথিবীর বেশির ভাগ অশান্তি বা যুদ্ধ যদি মেয়েদের কারণে হয়ে থাকে, পুরুষ তাহলে যুদ্ধ করেছিল কেন? আমার একটা অনুরোধ থাকবে, এভাবে সাধারণীকরণ না করে তুমি যদি একটু বস্তুনিষ্ঠ হও, তাহলে কিছুটা স্বস্তি পাবে। আর নারী জাতি, পুরুষ জাতি এভাবে না ভেবে মানবজাতি হিসেবে সবাইকে দেখতে পার কি না, দেখো।
সমস্যাঃ আমি ‘সম্ভবত’ একটা ছেলেকে পছন্দ করি। সম্ভবত এই কারণে যে আমি নিজেও বুঝতে পারি না। ফোনে আমাদের পরিচয়, তাও প্রায় দুই বছরের। প্রথম থেকেই আমি আমার ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সমস্যার কথা তার কাছে বলতাম। তার সঙ্গে কথা বলার জন্য পরিবারের মানুষের কাছে আমাকে ছোট হতে হয়। তার সম্পর্কে আমি প্রায় কিছুই জানি না। সে অনেক সময় মিথ্যা কথা বলে। তার পরিবারের কারও সম্পর্কে কিছু বলতে আগ্রহী নয়। একদিন তার সঙ্গে কথা না বলার জন্য অনেক মানসিক যুদ্ধ করতে হয়। যখন ঝগড়া হয়, তখন ছেলেটা খুব সহজেই বলে তাকে ফোন না করতে। আমিও মনে করি, ফোন করব না। অনেক প্রতিজ্ঞা করেও রাখতে পারিনি। যেহেতু সে জানে আমি কথা না বলে থাকতে পারব না, তাই সে এমন কিছু আবদার করে, যা দিতে গেলে আমার সমস্যা হয়। এসব কারণে আমার পড়ালেখা খারাপ হচ্ছে। এখন এই অবস্থায় এসে নিজেকে খুব ছোট মনে হয়। অন্য দশটা মেয়ের মতো আমি ছেলেদের সঙ্গে মিশতে পারি না। বিভিন্ন কারণে আমি ছেলেদের ভয় পাই এবং ঘৃণা করি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
পরামর্শঃ নিজের সম্পর্কে তোমার সচেতনতার ব্যাপারটি চমৎকার। এভাবে নিজের ব্যক্তিত্বকে বিশ্লেষণ করে নিজেকে বোঝার প্রচেষ্টাটি অবশ্যই তোমাকে সাহায্য করবে মানসিকভাবে আরও স্থিতিশীল হতে। ব্যক্তিগত সমস্যার কথা তার সঙ্গে দীর্ঘদিন আলোচনা করার ফলে তার প্রতি আবেগীয়ভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছ। যাকে তুমি ভালো করে চেনো না, যার পরিবার সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণা নেই, তাকে এত কথা বলা কি ঠিক হয়েছে? এতে তোমার মনটা হালকা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু আমরা এমন মানুষকেই তো মনের কথা বলব, যাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করা যায়, তাই না? ছেলেটি এখন তোমার এই নির্ভরশীলতার সুযোগ গ্রহণ করছে-অযাচিত আবদার করে। তুমি এটিকে একটি ভুল হিসেবে দেখে ওর প্রতি নির্ভরশীলতা কমানোর জন্য অন্য ধরনের সুস্থ চর্চায় নিজেকে ব্যস্ত রাখো। পড়ালেখার পাশাপাশি যদি কিছু কোর্স করতে পারো, তাহলে ভালো হয়। বাস্তব সিদ্ধান্ত গ্রহণের বেলায় আবেগতাড়িত না হয়ে যদি বেশি যুক্তিবাদী হতে পারো, তাহলে ভালো হয়। ছেলেদের প্রতি তোমার এই মনোভাবের কী কারণ, তা জানি না। তবে ‘সব ছেলেই খারাপ’, এ ধারণাটি নিয়ে না চললে ভালো হয়। পরিবারের নানা সমস্যার কারণে তোমার মানসিক শক্তিটা হয়তো কম থাকতে পারে, তবে এর জন্য তুমি মোটেও দায়ী না এবং তুমি মানসিক রোগীও না।
পরামর্শ দিয়েছেন-
অধ্যাপক ড· মেহতাব খানম
মনোবিজ্ঞান
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সূত্রঃ প্রথম আলো, জুলাই ১১, ২০০৯
Leave a Reply