অর্থনৈতিক সংকটের প্রতিক্রিয়ায় দুনিয়াজুড়ে একধরনের মন্দা পরিস্থিতি বিরাজ করছে। একদিকে কমছে উৎপাদন, অন্যদিকে কমছে ভোগ। এতে আবার কমে যাচ্ছে উৎপাদিত পণ্যের চাহিদা। ভোক্তার হাতে অর্থের টানাটানিই এই ভোগ কমার কারণ।
আর যেহেতু ভোগ নেই, তাই পণ্যের দামও নেই। অর্থনীতির ভাষায় যাকে বলে মূল্য সংকোচন। আর এই মূল্য সংকোচনই জন্ম দেয় মন্দার। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপানসহ বড় বড় অর্থনীতির দেশ এখন মন্দার কবলে। পণ্যের চাহিদা কমে যাওয়ায় এ দেশগুলোকে আমদানি কমাতে হয়েছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে চীন, ভারত ও ব্রাজিলের মতো বড় উন্নয়নশীল দেশগুলো।
চীনের ওপর বৈশ্বিক মন্দার প্রভাব সবচেয়ে বেশি। রপ্তানি ও আমদানি দুটোই তাদের কমছে। অতি সম্প্রতি চীন সরকারের সর্বশেষ প্রকাশিত তথ্যে দেখা যাচ্ছে, গত মাসে (নভেম্বর) গত বছরের একই সময়ের তুলনায় রপ্তানি কমেছে ২·২ শতাংশ। ১৯৯৯ সালের এপ্রিলের পর এটা সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হ্রাস।
গত ২০ বছরে মূলত রপ্তানি এবং বৈদেশিক বিনিয়োগ-এ দুটোই চীনের অর্থনীতির চাকা সচল রাখে। কিন্তু উদ্বেগের খবর, গত এক বছরে দেশটির বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে অন্তত ৩৬·৫ শতাংশ। আর রপ্তানি চাহিদা কমে যাওয়ায় বন্ধ হয়ে গেছে দক্ষিণ চীনের নদী তীরবর্তী শত শত কলকারখানা। চাকরি হারিয়েছে লাখো শ্রমিক। বকেয়া বেতনের দাবিতে শ্রমিক বিক্ষোভে উত্তাল হয়েছে পুরো শিল্পাঞ্চল। পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, আগামী দিনগুলোয় অর্থনীতিকে স্বাভাবিক ছন্দে রাখা বেইজিংয়ের জন্য খুব কঠিন হবে। ব্যয় হ্রাস করতে হয়তো আরও শত শত কারখানায় তালা ঝুলাতে হবে। এতে খুবই চিন্তিত চীনা প্রেসিডেন্ট হু জিনতাও।
রপ্তানি কমে যাওয়ার প্রভাব পড়েছে অন্যান্য দিকে। পুঁজিবাজার ও আবাসন খাত হুমকির মধ্যে রয়েছে। গত মাসে চীনা সরকার ৫৮৬ বিলিয়ন ডলারের পুনরুদ্ধার পরিকল্পনা ঘোষণা করে। ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে এই অর্থ ঋণ দেওয়া হবে, যাতে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আবার আশার সঞ্চার হয়। এ ছাড়া সুদের হার কমিয়ে ঋণগ্রহীতাদের সুবিধা দেওয়া, শেয়ার ব্যবসা থেকে কর কর্তন, অভ্যন্তরীণ ব্যয় কমানো-এসব পদক্ষেপ তো আছেই।
চীনের আমদানি যে কমবে, তা কিন্তু কেউ আশঙ্কাও করেনি। কিন্তু বাস্তবতা হলো, চীনের ভোক্তারা ভোগ কমিয়েছেন। তাঁরা খাওয়াদাওয়া, জীবনযাপন, বেড়ানো-এসব থেকে খরচ কমিয়েছেন। এ কারণে গত মাসে দেশটির আমদানি কমেছে ১৭·৯ শতাংশ। এতে দেশটির বাণিজ্য উদ্বৃত্তও কমেছে। বাণিজ্য উদ্বৃত্ত অক্টোবরে যেখানে রেকর্ড সংখ্যা ৪০ বিলিয়ন ডলারে ছুঁয়েছিল, নভেম্বরে তা ৩৫·২ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে।
রপ্তানি বাড়ানোর জন্য চীন সরকার ডলারের তুলনায় তাদের মুদ্রা ইউয়ানের মূল্য কমায়। যাতে রপ্তানিকারকেরা আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা করতে পারে। কিন্তু বিশ্বে যখন মন্দা আসে, তখন সব পদক্ষেপগুলোই ব্যর্থ হয়।
২০০১ সালে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় যোগ দেওয়ার পর থেকেই চীনের রপ্তানি কয়েক গুণ বেড়ে যায়। উপচে পড়ে বিদেশি বিনিয়োগ এবং তা চীনকে পরিণত করে বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতির দেশে।
কাজী আলিম-উজ-জামান
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ডিসেম্বর ১৫, ২০০৮
Leave a Reply