চলমান অর্থনৈতিক সংকটের প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক পণ্যের দাম কমে গেছে। বাংলাদেশের মতো আমদানিনির্ভর দেশের ভোক্তাদের জন্য নিঃসন্দেহে এটি একটি সুখবর। কিন্তু এ রকম একটি খবরেও খুব একটা স্বস্তিতে নেই জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। কারণ, আমদানি পণ্যের দাম কমার সঙ্গে সঙ্গে রাজস্ব আয়ের সবচেয়ে বড় খাত শুল্ক আদায় কমতে থাকে। আর শুল্ক আদায় কম হওয়ায় সামগ্রিক রাজস্ব আহরণ ব্যাপকভাবে কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে এনবিআরের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদ নিজেও এ রকম আশঙ্কা প্রকাশ করেন। ওই সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, বিশ্ববাজারে জিনিসপত্রের দাম কমে যাওয়ায় অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আহরণে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। সম্ভাব্য এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার কৌশল হিসেবে আয়কর আদায় ও মূল্য সংযোজন করের (ভ্যাট) আওতা বাড়ানোর ওপর জোর দেন তিনি। আর এর অংশ হিসেবে আয়কর বিভাগকে শক্তিশালী করার প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করা হয় ওই সংবাদ সম্মেলনে।
অভ্যন্তরীণ সম্পদ বাড়ানোর লক্ষ্যে সম্প্রতি আয়কর বিভাগকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যদিও বলা হচ্ছে, এনবিআরকে শক্তিশালী করার অংশ হিসেবে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, এর সঙ্গে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সংকটের কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু অনেকেই এটিকে দেখছেন সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার পদক্ষেপ হিসেবে।
সম্প্রতি এনবিআর আয়কর বিভাগকে ঢেলে সাজানোর একটি খসড়া প্রস্তাব অর্থ উপদেষ্টার সম্মতির জন্য পাঠিয়েছিল। ওই প্রস্তাবনায় কিছু সংশোধনী এনে এনবিআরের কাছে আবার তা ফেরত পাঠানো হয়। এরই মধ্যে সংশোধনীসহ প্রস্তাবটি চূড়ান্ত করা হয়েছে, যা এখন অর্থ উপদেষ্টার অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।
এর আগে এনবিআরকে আধুনিক ও দক্ষ সংস্থায় পরিণত করতে একটি মহাপরিকল্পনা হাতে নেয় সরকার। ওই পরিকল্পনার আওতায় আয়কর বিভাগের কাঠামোতে বড় ধরনের পরিবর্তনের প্রস্তাব আনা হচ্ছে। অপর দুটি বিভাগ ভ্যাট ও শুল্ক বিভাগকেও পর্যায়ক্রমে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
জানা গেছে, নতুন প্রস্তাবে আয়কর বিভাগকে ঢেলে সাজাতে বোর্ডের অভ্যন্তরে এবং মাঠপর্যায়ে কাঠামোগত সম্প্রসারণের কথা থাকছে। একই সঙ্গে জনবল বাড়ানোরও প্রস্তাব রয়েছে এতে। প্রস্তাবনায় বিসিএস কর ক্যাডারভুক্ত বোর্ডের সর্বোচ্চ পদমর্যাদার সদস্যসংখ্যা চারটি থেকে বাড়িয়ে সাতটিতে উন্নীত করার কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ সদস্য পর্যায়ে আরও তিনটি নতুন পদ সৃষ্টি করা হচ্ছে। এগুলো হলো সদস্য আইসিটি, সদস্য অডিট ও সদস্য এলটিইউ। এ ছাড়া বোর্ডের বাইরে মাঠপর্যায়ে নতুন করে অতিরিক্ত ১২টি কর অঞ্চল সৃষ্টির প্রস্তাব করা হয়েছে। বর্তমানে সারা দেশে এনবিআরের অধীনে কর অঞ্চলসহ ২৬টি বিভাগ ও সংস্থা রয়েছে। এর মধ্যে সরাসরি আয়কর আদায় করে এমন কর অঞ্চলের সংখ্যা ১৮টি। এ ছাড়া কর একাডেমি, কর পরিদর্শন পরিদপ্তর, পাঁচটি আপিলাত কমিশনারেট ও একটি কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল রয়েছে। তবে প্রস্তাবনায় শুধু অঞ্চলের সংখ্যা বাড়ানোর কথাই বলা হয়েছে। বর্তমানে ১৮টি কর অঞ্চলের আওতায় সারা দেশে ৩৬০টি কর সার্কেল কার্যালয় রয়েছে। প্রস্তাবনায় আরও ১০০টি নতুন কর কার্যালয় সৃষ্টির কথা বলা হয়েছে।
সূত্র বলেছে, আয়কর বিভাগকে ঢেলে সাজাতে যে পরিকল্পনার প্রস্তাব করা হয়েছে, তা বাস্তবায়ন করতে বাড়তি প্রায় পাঁচ হাজার জনবলের প্রয়োজন হবে। বর্তমানে আয়কর বিভাগে ক্যাডার ও নন ক্যাডার মিলে মোট জনবলের সংখ্যা সাড়ে পাঁচ হাজার। এর মধ্যে ক্যাডারভুক্ত কর্মকর্তা পাঁচ শতাধিক।
আয়কর বিভাগকে সর্বশেষ ১৯৯২ সালে একবার সম্প্রসারণ করা হয়েছিল। এরপর তেমন কোনো কাঠামোগত পরিববর্তন করা হয়নি। ১৯৯২-৯৩ অর্থবছরে দেশে মোট রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ ছিল প্রায় আট হাজার কোটি টাকা, যার মধ্যে আয়কর খাতের অবদান ছিল দুই হাজার কোটি টাকার নিচে। কিন্তু গত ২০০৭-০৮ অর্থবছরে কেবল আয়কর খাতেই আদায় হয় ১১ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা। আয়কর আদায়ের সঙ্গে সঙ্গে সামগ্রিক কর্মকাণ্ড বাড়লেও কর বিভাগের জনবল সে হারে বাড়েনি। এ বাস্তবতায় অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোয় নতুন কর কার্যালয় খোলার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেছে এনবিআর। গত দশকের পর দেশের অনেক স্থান অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলেও সেখানে কোনো রাজস্ব্ব কার্যালয় গড়ে ওঠেনি। তাই সময়ের চাহিদায় এখন কর বিভাগকে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে এনবিআর।
হাসান ইমাম রুবেল
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ডিসেম্বর ১৫, ২০০৮
Leave a Reply