শীত চলে এসেছে। শুরু হয়েছে বেড়ানোর মৌসুম। অনেকেই এখন দেশের ভেতর বেড়াতে যায় সুন্দর সুন্দর জায়গায়। ইদানীং ঝামেলা এড়াতে অনেকে বেসরকারি পর্যটন সংস্থার (ট্যুর অপারেটর) মাধ্যমে বেড়াতে যায়। এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বেড়াতে গেলে যাতায়াত, হোটেল-কোনো কিছু নিয়েই আর ভাবতে হয় না। সঙ্গে থাকে একজন গাইড-যিনি বেড়ানোর পুরো সময়ে সহযোগিতা করেন।এই ট্যুরিস্ট গাইড বা পর্যটন গাইড হিসেবে নিজের পেশা শুরু করা যায়। বাংলাদেশেও এখন এ পেশার ভালো চাহিদা। বিদেশে তো বটেই।
বেসরকারি পর্যটন সংস্থাগুলোর সংগঠন ট্যুর অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-টোয়াবের সভাপতি ও গাইড ট্যুরস প্রাইভেট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাসান মনসুর জানান, সারা বিশ্বে কর্মসংস্থানের দিক থেকে পর্যটনশিল্পই সবচেয়ে এগিয়ে, প্রায় ১১ শতাংশ। পর্যটক গাইড, হোটেল ব্যবস্থাপনা, রেস্তোরাঁ ব্যবস্থাপনা, রান্নাশিল্প, দোভাষী, পরিবহন ব্যবস্থাপনা-এ রকম অনেক কাজ পর্যটনশিল্পের মধ্যে পড়ে। তবে গাইডের কাজটাই সবচেয়ে আকর্ষণীয় আর উপভোগ্য বলেমনে করেন তিনি।
কাজেই যাঁরা ঘুরতে ভালোবাসেন, পথঘাট-নিয়মকানুন সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখেন, পছন্দ করেন মানুষের সঙ্গে মিশতে-এমন যে কেউ বেছে নিতে পারেন এ পেশা। প্রশ্ন হলো, কেন বাছতে হবে? এ ক্ষেত্রে সম্ভাব্য উত্তর অনেক-অন্য অনেক পেশার চেয়ে উপভোগ্য, প্রকৃতি ও মানুষের সঙ্গে মেশা ও জানার সুযোগ, আকর্ষণীয় আর্থিক নিশ্চয়তা, সহজ কর্মসংস্থান প্রভৃতি।
গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের পর্যটনশিল্পের পরিধি উল্লেখযোগ্যভাবে বিস্তৃত হয়েছে। অনেকে এখন ঈদে বা ছুটিছাটায় সুটকেস গুছিয়ে দেশের বাড়ি যাওয়ার বদলে কক্সবাজার-রাঙামাটি যেতে পছন্দ করে। নিদেনপক্ষে ঈদের পরে তো যায়ই।কিছু অবকাঠামো তৈরি হওয়ায় বিদেশি পর্যটকদেরও আনাগোনা বেড়েছে। পর্যটন-সংশ্লিষ্ট প্রত্যেকেই তাই একবাক্যে বলল-বাংলাদেশে দক্ষ পেশাদার গাইডের এখন বিশাল চাহিদা। ভালো গাইড মানেই শুধু পর্যটন-মৌসুম নয়, সারা বছরই কঠিন ব্যস্ততা।
কাজটা কেমন
ট্যুরিস্ট গাইডের কাজের ধরন নয়টা-পাঁচটায় বাঁধা নয়। পর্যটকদের সঙ্গে ঘুরে বেড়ানো এ পেশার একটি বড় কাজ হলেও দায়িত্বের পরিধি আরও বড়। পর্যটকের যাওয়া-আসা, থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা তো এমন কোনো কঠিন কাজ নয়। পর্যটক নিজেও কাজটা করতে পারে। কিন্তু বাড়তি কিছু সেবা ও নিশ্চিন্ত ভ্রমণ উপভোগ করার জন্যই পর্যটক গাইডের সহায়তা নেয়। অর্থাৎ পর্যটককে সন্তুষ্ট করার মধ্যেই গাইডের সাফল্য নিহিত। আর প্রতিযোগিতামূলক পরিস্থিতিতে, যিনি সবচেয়ে ভালো সেবা দিতে পারবেন, পর্যটক তো তাঁর কাছেই যাবে-এটাই স্বাভাবিক। সাদা চোখে গাইডের মূল দায়িত্বগুলো দেখা যাক-
* পর্যটকদের পছন্দ বা সুবিধা অনুযায়ী ভ্রমণের পরিকল্পনা করা।
* পরিকল্পনা অনুযায়ী ব্যবস্থাপনা, যেমন-হোটেল, খাবার ও পরিবহন বুকিং কিংবা অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার আয়োজন।
* সংশ্লিষ্ট জায়গা সম্পর্কে আগাম পড়াশোনা, খোঁজখবর ও জানা তথ্য ঝালিয়ে নেওয়া। সম্ভব হলে আগেভাগেই সংশ্লিষ্ট স্থানটি ঘুরে আসা, বুকিং ও অন্যান্য বিষয় নিশ্চিত করা।
* ভ্রমণের সময় পর্যটকের জন্য সম্ভাব্য সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
* ভ্রমণের সময় পর্যটকদের চাহিদা অনুযায়ী যুক্তিসংগত সেবা দেওয়া।
* উপস্থিত বুদ্ধি খাটিয়ে আক্নিক সমস্যার তাৎক্ষণিকভাবে সমাধান।
* পর্যটককে সংশ্লিষ্ট সঠিক তথ্যটি দেওয়া।
* পর্যটকের পছন্দ, আগ্রহ ও পরিস্থিতি বুঝে তাৎক্ষণিকভাবে কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে সেবার মান নিশ্চিত করা।
গাইড মানে পথপদর্শক। গাইড যা বলবেন বা যেভাবে বলবেন, পর্যটক তা-ই করবে। ভ্রমণের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত গাইডই পুরো ভ্রমণের নিয়ন্ত্রক। পর্যটকের ভালোমন্দ, নিরাপত্তা, উপভোগ-এগুলো খেয়াল রাখা গাইডের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। দেখা গেল যে বাস ছাড়তে দেরি করছে, রেস্তোরাঁয় মেনু অনুযায়ী খাবার মিলছে না কিংবা চলার পথেই একজন হয়তো অসুস্থ হয়ে পড়েছে, আশপাশে হাসপাতাল বা চিকিৎসক নেই। ভ্রমণের সময় এত সব বিষয় যেহেতু একসঙ্গে পাওয়া যায় না, ফলে এগুলোর সমন্বয় বা সমাধানও করতে হয় ধৈর্য আর কুশলীপনার সঙ্গে। এগুলো ঠিকঠাক করতে পারাটাই গাইডের কাজ।
তবে শুধু এসব ব্যবস্থাপনা নয়-পর্যটক যেখানে বেড়াতে যাচ্ছে, সে বিষয়ে তাকে ধারণা দেওয়া, তার কৌতূহল মেটানো, সেখানকার বিশেষ বিষয় বা বস্তুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া এবং শেষ পর্যন্ত পর্যটক যেন ইতিবাচক একটা ধারণা নিয়েই বাড়ি ফেরে, সেটা নিশ্চিত করাও গাইডের কাজ। কারণ পর্যটক সন্তুষ্ট হলেই ফিরে গিয়ে আরও ১০ জনের কাছে গল্প করবে, তাতে তৈরি হবে আরও ১০ জন নতুন পর্যটক।
যোগ্যতা কী কী চাই
বেঙ্গল ট্যুরস লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক
মাসুদ হোসেন বললেন, গাইড হওয়ার জন্য আগ্রহটাই সবচেয়ে জরুরি। এর সঙ্গে দরকার বুদ্ধি, পড়াশোনা আর বাংলা-ইংরেজিতে কথা বলার দক্ষতা। তিনি আরও কিছু যোগ্যতার কথা বললেনঃ
* দেশপ্রেম আর প্রকৃতিপ্রেম।
* ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা আর নিয়মিত পড়াশোনার অভ্যাস। সাম্প্রতিক ও সাধারণ বিষয়গুলোর ওপর দখল থাকলেই পর্যটকদের আস্থা অর্জন করা সহজ হবে।
* বাংলা ও ইংরেজির ওপর দখল তো লাগবেই। এর বাইরেও অন্য কোনো ভাষা জানা থাকলে তা প্লাস পয়েন্ট। তবে জাপানি, স্প্যানিশ, ফরাসি, রুশ, চীনা-এসব ভাষার যেকোনো একটা শিখে রাখা যেতে পারে। একটা ভাষা জানেন, এমন পর্যটকেরা যেহেতু বেশি আসে, কাজেই এগুলোর একটা শিখে নেওয়া যায়।
* স্বচ্ছ ভৌগোলিক জ্ঞান থাকা দরকার আর সেই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সঠিক তথ্যগুলোও।
* পরিমিত ্নার্টনেস। সবার কাছে গ্রহণযোগ্য, হাসিখুশি, কনভিন্সিং ব্যক্তিত্ব দরকার।
* সদালাপী, সৎ, সময়ানুবর্তী।
* দীর্ঘ সময় মন দিয়ে কাজ করার আগ্রহ আর ধৈর্য আর কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা।
* দেশীয় সংস্কৃতি, রীতিনীতি, আইনকানুন ও সাম্প্রতিক পরিস্থিতি বিষয়ে ভালো ধারণা।
* কিছু কারিগরিবিদ্যা জানা থাকা, যেমন-গাড়ি চালানো, ছবি তোলা ও কম্পিউটার চালানো, ই-মেইল করা ইত্যাদি।
গাইড হয়ে ওঠার আগে
বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের ন্যাশনাল হোটেল অ্যান্ড ট্যুরিজম ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে বিভিন্ন মেয়াদে প্রশিক্ষণ কোর্সের ব্যবস্থা আছে। এ ছাড়া আজকাল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও তৈরি হয়েছে পর্যটন-সংশ্লিষ্ট নানা বিষয়ে পড়াশোনার সুযোগ। এ বিষয়ে হাসান মনসুর বললেন, এসব প্রতিষ্ঠানে তাত্ত্বিক বিষয়গুলোর ওপর জোর দেওয়া হয়। গাইড হওয়ার জন্য মাঠপর্যায়ে কাজের অভিজ্ঞতাই বেশি কাজে দেয়। আর মাসুদ হোসেন বললেন, গাইড হতে গেলে তাত্ত্বিক জ্ঞান দরকারি বিষয়। তবে তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো ব্যবহারিক জ্ঞান। কোনো পর্যটন সংস্থায় শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ করা গেলে পেশাজীবনের শুরু থেকেই দক্ষতা বাড়ানোর কাজ শুরু হবে। মাসুদ হোসেন জানালেন, সরাসরি হাতে-কলমে কাজ শিখলে এ কাজের প্রতিবন্ধকতা বা সমাধানের বিষয়ে দক্ষতা চলে আসে।
গাইড ট্যুরস, বেঙ্গল ট্যুরস, অবকাশ পর্যটন, জার্নি প্লাস, সিলভার ওয়েভ ট্যুরস, সাফারি প্লাসসহ বেশকিছু সংস্থায় এভাবে কাজের সুযোগ আছে।
কোথায় কেমন কাজের সুযোগ
পর্যটন-সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে বোঝা গেল, দক্ষ গাইডের কাজ ও কাজের জায়গার কোনো অভাব নেই। বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন, ট্যুর অপারেটর, হোটেল, রেস্তোরাঁ, রিসোর্ট, ট্রাভেল এজেন্ট, ক্রুজ অপারেটর, পরিবহন অপারেটর-এ রকম সরাসরি পর্যটন-সংশ্লিষ্ট কর্মসংস্থানের সুযোগ তো আছেই; বিদেশি মিশন, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা আর বিভিন্ন প্রকল্পেও দক্ষ গাইডের খুব কদর।
সম্ভাবনার সবিশেষ
১০-১৫ বছর আগেও বাংলাদেশে গাইডের পেশাটা ছিল অনেকটা খণ্ডকালীন। সারা বছর কোনো কাজ নেই, শুধু শীতকালে ভরা পর্যটন মৌসুমে টানা তিন-চার মাস ব্যস্ততা। কিন্তু এখন পরিস্থিতি বদলেছে। বরং এখন এক-দুই মাস বাদ দিলে সারা বছরই পেশাদার গাইড মানেই কাজ আর কাজ। মাসুদ হোসেন বললেন, দিন দিন পর্যটনশিল্প আরও বিকশিত হচ্ছে, সেই সঙ্গে বাড়ছে কাজের সুযোগ। যেহেতু দেশি-বিদেশি নানা ধরনের মানুষের সঙ্গে কাজ করতে হয়, ফলে শিক্ষিত আর চৌকস তরুণেরাই এ পেশায় আসছে বেশি। একই সঙ্গে অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা, সম্মান ও কাজের ধরন কিছুটা উপভোগ্য হওয়ায় পেশা হিসেবেও সবার কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে এটি। হাসান মনসুর শুধু একটা কথা যোগ করলেন, গাইড হিসেবে দেশপ্রেমিক তরুণদেরই আসা উচিত, কারণ নিজের দেশটাকেই তো ওই তরুণরাই পর্যটকদের কাছে উপস্থাপন করবে।
সফল গাইডের কথা
নয় বছর জাপানে কাটিয়ে মোহাম্মদ ওয়াহিদউল্লাহ দেশে ফিরে ভাবছিলেন-কী ব্যবসা করা যায়। মন স্থির করতে পারছিলেন না। এ সময় যোগাযোগ হলো বেঙ্গল ট্যুরসের সঙ্গে। জাপানে থেকে জাপানি ভাষাটা যেহেতু রপ্ত হয়ে গেছে, তো এটাই কাজে লেগে গেল-বেঙ্গল ট্যুরসের একদল জাপানি পর্যটককে নিয়ে ঘুরতে হবে। তাঁরা জাপানের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন। বাংলাদেশে এসেছেন এখানকার এনজিওগুলোর ওপর গবেষণা করতে।
‘২০০২ সালের ফেব্রুয়ারির ওই ট্যুরটা করেই পেশাটাকে ভালোবেসে ফেললাম,’ বললেন ওয়াহিদ। ‘এ পেশায় নিজের দেশটা চেনা যায়, চেনানো যায় ভিনদেশি মানুষের কাছে, আবার নিজেরও বেড়ানো হয়। সেই সঙ্গে বিদেশি ভাষাটাও চর্চার মধ্যে থাকে।’ ওয়াহিদ এরপর বেঙ্গল ট্যুরসেই পুরোদস্তুর গাইড হিসেবে কাজ করেছেন অনেক বছর। এরপর দুই বছর আগে ‘সিলভার ওয়েভ ট্যুরস’ নামে নিজেই শুরু করেছেন আরেকটি ট্যুর অপারেটর সংস্থা। এখন তিনি একই সঙ্গে গাইড ও পর্যটককেন্দ্রিক উদ্যোক্তা। পর্যটকদের জন্য ভ্রমণ-পরিকল্পনা সাজাচ্ছেন, মাথা ঘামাচ্ছেন কীভাবে সেবার মান বাড়ানো যায়, এরপর নিজেই যাচ্ছেন পর্যটকদের সঙ্গে গাইড হিসেবে।
এখনই গাইড হতে আগ্রহী, এমন তরুণদের জন্য ওয়াহিদ দারুণ এক তথ্য দিলেন-চীনা পর্যটকেরা আজকাল বাংলাদেশে বেশি আসছে। কাজেই চীনা ভাষা জানা থাকলে গাইড হিসেবে কদর মিলবে।
ফারহানা আলম
সূত্রঃ প্রথম আলো, ডিসেম্বর ০৬, ২০০৮
Md. Mikail Hossain
Very good for us.