সূর্যের তেজ তখনো খুব একটা ছড়ায়নি। হালকা হিমেল কুয়াশা ভাবটা আস্তে আস্তে কেটে যাচ্ছিল। শিউলি ঝরানো শরৎকালটা বিদায়ঘণ্টা বাজিয়ে চলে গেল। অগ্রহায়ণ মাসের ১ তারিখ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বকুলতলায় সেই কুয়াশা মোড়ানো ভোর থেকেই জড়ো হতে শুরু করেছে লোকজন। ঠিক সে সময়টাই, যখন একজন কৃষক কাস্তে হাতে মাঠে ধান কাটতে যান। উৎসবমুখর পরিবেশ চারুকলা ও তার আশপাশের প্রাঙ্গণে।
প্রতিবছরের মতো এবারও উদ্যাপিত হয়ে গেল নবান্ন উৎসব। ‘নিজের গোলায় তুলব ধান, গাইব গান, ভরবে প্রাণ’-এই ছিল এবারের প্রতিপাদ্য।
আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম
গ্রামের মাঝখান দিয়ে এঁকেবেঁকে যাওয়া ধুলো ওড়া মাটির রাস্তা। দুই তীরের বিস্তীর্ণ ধানক্ষেত। বেশির ভাগই হলদে বর্ণ। সকাল থেকেই কৃষক গিন্নির যারপরনাই ঘর-গেরস্থালি আর প্রকৃতিতে ঝকঝকে মেঘহীন আকাশ। এমনটাই হেমন্তের প্রকৃত রূপ। সকাল থেকে কৃষকের ধান কাটা। বাড়ির উঠোনে সেগুলো স্তূপ করে রাখা, মাড়াই করা। তারপর গোলা ভর্তি করে নিজের শ্রমের ঘামের ফসলটুকু ঘরে তোলা। পুরোপুরি না হলেও এমন কিছু স্বাদ পেল যান্ত্রিক শহর ঢাকার মানুষজন।
অনুষ্ঠানের মঞ্চ সাজানো হয়েছে ব্যানার আর নানা রঙের কাগজ দিয়ে। বাঁশির সুরে অনুষ্ঠানের শুরুটা মোহমুগ্ধের মতো উপভোগ করছিলেন অনুষ্ঠানে আসা সবাই। এরপর ঢোল, বাঁশি, মন্দিরা, ঘণ্টা-সবকিছুর তালে তালে বাজানো যন্ত্রসংগীতের আওয়াজে সবাই যেন কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে গিয়েছিল বাঙালিয়ানায়, আমার ভেতরের আমিতে।
ছেলেদের পরনে ছিল পায়জামা আর পাঞ্জাবি। মেয়েদের পরনে ছিল এক প্যাঁচে পরা একরঙা বা চেকের তাঁতের শাড়ি। পালাগানের আসরের মতো করে মাদুর বিছিয়ে দিয়ে অনুষ্ঠান মঞ্চের সামনে আসন তৈরি করা হয়েছিল বসার জন্য। অনুষ্ঠানটি উদ্বোধন করেন শিল্পী গোলাম কিবরিয়া।
আহা! কী আনন্দ আকাশে-বাতাসে
উদ্বোধনী ঘোষণার মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হয়। এরপর হেমন্তবিষয়ক কবিতা আবৃত্তি করে শোনান ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর ভরাট কণ্ঠের আওয়াজ মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিল উপস্থিত সবাই। মিতা হক গেয়ে শোনান রবীন্দ্রনাথের হেমন্তের গান। এরপর নজরুলগীতি, লোকগীতি, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, অতুলপ্রসাদের গান পরিবেশিত হয়। সব গানই হেমন্তকাল আর নবান্নকে ঘিরে রচনা করা। ‘আমার মাইজা ভাই, সাইজা ভাই কই গেলা রে···’ গানটি পরিবেশনের সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত শ্রোতাদের মধ্যে কেউ হাত-পা ছুড়ে, কেউ বা মাথা দুলিয়ে একাত্মতা ঘোষণা করছিল।
নাচ পরিবেশন করে স্পন্দন ও নৃত্যম শিল্পীগোষ্ঠী। অনুষ্ঠানের মাঝামাঝি সময়ে পড়ে শোনানো হয় ‘নবান্ন কথন’। এই কথনে নবান্ন ও নবান্ন উৎসব কীভাবে আমাদের কৃষ্টি আর ঐতিহ্যে জায়গা করে নিল তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়। এরপর আবারও নানা রকম গানে মাতিয়ে রাখেন শিল্পীরা। এরই একপর্যায়ে ঘোষণা করা হয় ‘নবান্ন উৎসব’ আনন্দ শোভাযাত্রার। অনুষ্ঠান মঞ্চের সামনে থেকে শুরু হয় এ শোভাযাত্রা।
মিঠে রোদে ভাপা পিঠা
নবান্ন মানে কি শুধুই গোলাভরা ধান? না এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে নানা রকমের পার্বণ। গাঁয়ের বধূ শ্বশুরবাড়ি থেকে বাপের বাড়িতে বেড়াতে আসা। তাকে ঘিরে নানা আয়োজন, বিশেষ করে পিঠার উৎসব। নানা রকমের পিঠা-পুলি তৈরি হয়। আর এসব তৈরির নানা কাজের সহযোগিতায় এগিয়ে আসে পাড়া-প্রতিবেশীরা। সেই রকমের পিঠা-পুলির স্বাদ মানুষ আবার পেল নবান্ন উৎসবে এসে।
ছবি আঁকব কখন
‘আমি ছবি আঁকতে পালি···আম্মুনি, আমি ছবি আঁকব কখন?’ এভাবেই নিজের ভাব প্রকাশ করছিল তিন বছরের নাজিয়া। ওর পরনে ছিল এক প্যাঁচে পরা শাড়ি আর লম্বা চুলের ঝুঁটি। নবান্ন উৎসবে আয়োজন করা হয়েছে শিশুদের ছবি আঁকার প্রতিযোগিতা। আঁকার বিষয় ছিল ‘রঙ-তুলিতে নবান্ন’।
গুণীজন কহিলেন···
নবান্ন উৎসবে এসেছিলেন বিশিষ্ট নৃত্যশিল্পী শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বললেন, ‘আমার ছেলেবেলা কেটেছে চট্টগ্রামে। বিভিন্ন রকম উৎসবের সময়গুলোতে আমরা আমাদের গ্রামের বাড়িতে যেতাম। বিশেষ করে, পিঠা-পুলির এ উৎসবগুলোতে। এ ধরনের উৎসব এ প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের তাদের সংস্কৃতি সম্পর্কে সচেতন করবে। এ ধরনের উৎসবে সমাজের সব ধরনের মানুষের অংশগ্রহণ ও সহযোগিতা একান্ত প্রয়োজন।’ জাতীয় নবান্ন উৎসব উদ্যাপন পর্ষদের চেয়ারম্যান লায়লা হাসান শুরু থেকে ছিলেন অনুষ্ঠানে। তিনি জানান, ‘আজ আমরা হাঁটি হাঁটি পা পা করে ১০ বছরে পা দিলাম। এ নবান্ন উৎসব যেন সবার প্রাণে প্রাণ নিয়ে আসে। সব দুঃখ, ব্যথা ভুলে নতুন করে যেন পথ চলতে পারি।’ অনুষ্ঠান নিয়ে কথা বললেন নবান্ন উৎসব ১৪১৫-এর আহ্বায়ক শাহরিয়ার সালামও।
দুপুর বারোটায় প্রথম পর্বে অনুষ্ঠান শেষ হয়। তিনটায় আবারও অনুষ্ঠান শুরু হয়। চলতে থাকে নাচ, গান আর কবিতা পাঠ। জারি, সারি, ভাটিয়ালি ও ভাওয়াইয়ার তালে যেন মুখর হয়ে ওঠে বকুলতলা, যেন ছোট এক টুকরো গ্রাম। একটানা অনুষ্ঠান চলে রাত আটটা পর্যন্ত।
নাজমুল হাসান
সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো, নভেম্বর ১৮, ২০০৮
Leave a Reply