বর্তমানে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে ইনফারটিলিটি বা বন্ধ্যত্বের সমস্যা বেড়ে যাচ্ছে। বন্ধ্যত্ব কেন হয়, এর প্রতিকারই বা কী? কীভাবে টেস্টটিউব বেবি নিতে হয়—এসব বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন স্কয়ার হাসপাতালের গাইনি, অবস অ্যান্ড ইনফারটিলিটি বিভাগের অ্যাসোসিয়েট কনসালট্যান্ট ডা. রেহনুমা জামান। ৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৫ এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২১৪১তম পর্বে এই আলাপচারিতা প্রচারিত হয়।
প্রশ্ন : ইনফারটিলিটি বা বন্ধ্যত্ব বলতে আমরা কী বুঝি?
উত্তর : যখন এক দম্পতি, যেখানে স্ত্রীর বয়স ৩০ বছরের নিচে, তারা যদি এক বছর কোনো জন্মনিয়ন্ত্রক পদ্ধতি গ্রহণ না করে সন্তান নিতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়, অর্থাৎ যদি সন্তান ধারণ করতে না পারে, সে ক্ষেত্রে এটিকে আমরা বন্ধ্যত্ব বা ইনফারটিলিটি বলি। আর যদি স্ত্রীর বয়স ৩০ বছরের বেশি হয়, সে ক্ষেত্রে ছয় মাস চেষ্টা করার পরও যদি গর্ভধারণে সক্ষম না হয়, তখন আমরা তাকে বন্ধ্যত্ব বলে থাকি।
প্রশ্ন : এই সমস্যা কেন হয়? এর পেছনে কোনো নির্দিষ্ট কারণ রয়েছে কি না?
উত্তর : অবশ্যই এর পেছনে কিছু কারণ রয়েছে। ছেলেদের ক্ষেত্রে আমরা বলতে পারি, তাদের শুক্রাণুর স্বল্পতা বা শুক্রাণু একদমই না থাকা এসব কারণে হতে পারে। মেয়েদের ক্ষেত্রে দেখা যায়, প্রতি মাসে অভুলশেন (ডিম্বোস্ফোটন) হওয়ার কথা, ডিম বের হওয়ার কথা—তবে এই ডিম্বোস্ফোটনে সমস্যা হলে, টিউবাল ব্লকেজ থাকলে, জরায়ুতে সমস্যা থাকলে, কোনো টিউমার বড় হয়ে গিয়ে জরায়ুতে থাকলে এর ধারণক্ষমতা কমে গিয়ে অথবা কিছু হরমোনাল সমস্যার কারণে বন্ধ্যত্ব হতে পারে। সবকিছু মিলিয়ে এ রকম কিছু কারণে বন্ধ্যত্বের সমস্যা হতে পারে।
প্রশ্ন : যখন অনেক দিন ধরে সন্তান না হওয়ার সমস্যা নিয়ে কোনো দম্পতি আসছে, প্রাথমিকভাবে আপনারা কী পরামর্শ দিয়ে থাকেন?
উত্তর : প্রাথমিকভাবে আমরা তাদের ইতিহাস জেনে নিই, তাদের বয়স কেমন সেটা জেনে নিই। কোনো মেডিকেল ইতিহাস আছে কি না, সেটাও দেখতে হয়। কোনো পুরোনো ইতিহাস আছে কি না, মামস, টিউবার কোলোসিস—এ রকম কিছু হয়েছে কি না। এর পর কোনো অস্ত্রোপচারের ইতিহাস আছে কি না। তার পর স্ত্রীর ঋতুস্রাবের ইতিহাস সম্পর্কে খোঁজ নিই। নিয়মিত ঋতুস্রাব হচ্ছে কি না। এগুলো থেকে আমরা মোটামুটি ধারণা করতে পারি সমস্যাটা কোথায় আছে। তার ওপর ভিত্তি করেই অনুসন্ধান করে থাকি। যদি দেখি ডিম ঠিকমতো ফুটছে না, সে অনুযায়ী অনুসন্ধান করে থাকি।
আর প্রাথমিক কিছু বিষয় আছে, ছেলেদের ক্ষেত্রে আমরা সিমেন অ্যানালাইসিস করি। একটা সিমেন অ্যানালাইসিসে অনেক কিছু বোঝা যায়। আর মেয়েদের ক্ষেত্রে আমরা কিছু হরমোনাল পরীক্ষা করে থাকি। কোনো থাইরয়েড হরমোনের সমস্যা আছে কি না। অথবা ডিম ফুটতে কোনো অসুবিধা হচ্ছে কি না, জরায়ু ভালো আছে কি না—এ রকম কিছু দেখে থাকি। আমরা বন্ধ্যত্বকে দুটো ভাগে ভাগ করি—প্রাইমারি (প্রাথমিক) ও সেকেন্ডারি (দ্বিতীয়)।
প্রশ্ন : এটা কীভাবে ভাগ করেন?
উত্তর : যখন কখনোই হয়তো গর্ভধারণই করে না, সে রকম ক্ষেত্রে আমরা প্রাইমারি ইনফারটিলিটি বলে থাকি। আর সেকেন্ডারি ইনফারটিলিটি বলি সেটাকে, যেখানে আগে হয়তো অ্যাবরশনের ইতিহাস রয়েছে, প্রসবের ইতিহাস রয়েছে। কিন্তু আবার দীর্ঘদিন ধরে গর্ভধারণ হচ্ছে না। সেসব ক্ষেত্রে আমরা সেকেন্ডারি ইনফারটিলিটি বলি। সেসব ক্ষেত্রে টিউবাল ব্লকেজ আছে কি না, সেটা খোঁজার চেষ্টা করি।
প্রশ্ন : যখন নিশ্চিত হয়ে যান কী কারণে সমস্যাটি হচ্ছে, তখন আপনাদের চিকিৎসা কী থাকে, পরামর্শ কী থাকে?
উত্তর : ছেলেদের ক্ষেত্রে যদি শুক্রাণু গণনায় কম আসে, তখন এটি বাড়ানোর জন্য ওষুধ দিয়ে দিই। অনেক সময় একেবারে শুক্রাণু না থাকার সমস্যা থাকে, অনেক সময় এ রকম হয় যে ব্লকেজের কারণে আসতে পারছে না, আবার অনেক সময় দেখা যায় শুক্রাণু তৈরিই কম হচ্ছে—তখন আমরা কিছু পরামর্শ দিই। বলি, ইউরোলজিস্টের কাছে যান। তাঁরা কিছু সার্জারি করতে পারেন। অথবা এখানে আইভিএফ বা টেস্টটিউব বেবি পদ্ধতি খুব ভালো কাজে দেয়।
আর মেয়েদের ক্ষেত্রে যদি ডিম ফোটা না হয়, তবে হওয়ার জন্য ওষুধ দিই। ডিম্বোস্ফোটন না হওয়ার খুব প্রচলিত একটা কারণ হচ্ছে পলিসিসটিক অভারি। এখানে রোগীকে বাড়তি ওজন কমাতে বলি, সমস্যা অনুযায়ী চিকিৎসা দিই।
মেটফরমিন-জাতীয় কিছু ওষুধ দিই। মোটামুটি দেখা যায়, এতে সমস্যা দূর হয়ে যায়। শুরুতে আমরা মুখে খাওয়ার ওষুধ দিই। এতে না হলে ইনজেকশন দিই। তাতে না হলে আরো বিভিন্ন পদ্ধতি রয়েছে, সেগুলোতে যেতে পারি।
আর যদি জরায়ুতে কোনো সমস্যা থাকে, হয়তো টিউমার আছে, অনেক সময় দেখা যায় টিউমার ফেলে দিলেই গর্ভধারণ হয়ে যাচ্ছে। আর যাদের বাইলেটারাল টিউবার ব্লকেজ আছে, ওদের ক্ষেত্রে সরাসরি টেস্টটিউব বেবিতে চলে যেতে হয়।
প্রশ্ন : যাঁরা বন্ধ্যত্বের সমস্যায় ভুগছেন, তাঁরা সন্তান চান। তবে অনেক ক্ষেত্রে টেস্টটিউব বেবি—এ পদ্ধতিতে চান না। এটিকে হয়তো সে রকম আপন করে নিতে পারেন না। এ রকম একটা বিষয় রয়েছে। আপনার এ ক্ষেত্রে অভিমত কী?
উত্তর : মেয়েদের ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হচ্ছে বয়স। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মেয়েদের যেমন ডিম ফোটা কমতে থাকে, এর মানও কমতে থাকে। সেটার কথা মাথায় রেখেই আসলে সবকিছু করতে হবে। আমাদের দেশে অনেকের ধারণা, টেস্টটিউব বেবি একেবারে শেষে করব। আসলে শেষে করে লাভ নেই। এটারও একটা সফলতার বিষয় রয়েছে। এটা নির্ভর করে ডিমের মান কেমন, শুক্রাণুর মান কেমন, জরায়ু কেমন, জরায়ু একে ধরে রাখতে পারবে কি না, পাশাপাশি ল্যাব টেকনোলজি এসবের ওপরে। তাই দেখা যায়, বয়স বড়লে ডিমের মান খারাপ হয়ে যায়। তখন সফলতার হার একদমই কমে যায়। আর মেয়েদের তো ৩০ বছরের পর ডিমের মান খারাপ হতে থাকে, সংখ্যাও কমে যায়। এ জন্য আমরা বলি, সবাইকে ৩০ বছরের মধ্যে পরিবার পূর্ণ করার জন্য। ৩৫-এর মধ্যে যেন সব চিকিৎসা শেষ করে। ৩৫ বছরের পর সফলতার হার কমে যায়। সে জন্য সময় থাকতে আইভিএফ বা টেস্টটিউব বেবি নেওয়া উচিত। যদি আপনি সিদ্ধান্ত নেন আইভিএফ করবেন, তবে অবশ্যই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে করতে হবে।
প্রশ্ন : বন্ধ্যত্বজনিত সমস্যা আসলে বাংলাদেশে ধীরে ধীরে বাড়ছে। সারা বিশ্বেই বাড়ছে। এটি কেন হচ্ছে এবং কী অবস্থা এর?
উত্তর : আসলে আমাদের দেশে এর সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। সারা বিশ্বে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ দম্পতি বন্ধ্যত্বের সমস্যায় ভুগছে। আর এটা বাড়ার অনেক কারণ আছে। একেক জায়গায় আসলে কারণ একেক রকম। যেমন শহরাঞ্চলে মেয়েরা সন্তান নিতে দেরি করে ফেলছে, ক্যারিয়ারে সময় দিতে গিয়ে বয়সটা বেড়ে যাচ্ছে। আর গ্রামে দেখা যাচ্ছে, সংক্রমণের কারণে সমস্যা হচ্ছে। সংক্রমণের জন্য টিউবাল ব্লক হয়ে যাচ্ছে। সঠিক সময়ে ওরা চিকিৎসা নিচ্ছে না—মোটামুটি এগুলোই কারণ।
এ ছাড়া ছেলেদের ক্ষেত্রে মানসিক চাপ একটি বড় ব্যাপার। ছেলেদের ক্ষেত্রে দেখা যায়, তারা হয়তো দীর্ঘ সময় বাইরে কাজ করছে, হয়তো পরিবেশটা সে রকম নয়, আঁটসাঁট কাপড় পরছে, যেগুলোতে শুক্রাণু ধ্বংস হয়ে যাওয়ার যথেষ্ট আশঙ্কা থাকে। ধূমপান, দূষণ সবকিছু মিলিয়ে বন্ধ্যত্বের প্রকোপ আসলে বেড়ে যাচ্ছে আমাদের দেশে।
প্রশ্ন : আবার একটু চিকিৎসার দিকে ফিরে যাই। সাধারণত এই চিকিৎসাটা কখন শুরু করা উচিত বলে আপনি মনে করেন? অনেকে আছেন যাঁরা বুঝে যান, এর পরও একটু চেষ্টা করতে চান। এটি কি আসলে খুব যৌক্তিক?
উত্তর : আমি যে বললাম, এক বছরের যেই সময়টা। এই সময়ে না হলে অবশ্যই তাকে অনুসন্ধান করতে হবে, যে কেন হচ্ছে না। তখন কোনো একটা কারণ পাওয়া গেলে সেভাবে চিকিৎসা করতে হবে। আবার ২০ শতাংশ ক্ষেত্রে কোনো কারণ ছাড়াই বন্ধ্যত্ব হয়। কোনো কারণ নেই, তবুও গর্ভধারণ হচ্ছে না। ওদের ক্ষেত্রে দেখা যায় পর্যায়ক্রমে চিকিৎসা করতে হয়। প্রথমে ডিম ফোটার, এর পর পর্যায়ক্রমে মুখে ওষুধ খেয়ে, এর পর না হলে আইইউআই পদ্ধতি রয়েছে—এসব পদ্ধতি দিয়ে চিকিৎসা করতে হয়। এর পরও না হলে তাদের ক্ষেত্রেও দেখা যায় অনেক সময় আইভিএফ চিকিৎসায় যেতে হয়।
প্রশ্ন : আইভিএফ বা টেস্টটিউব বেবি কীভাবে হচ্ছে, একটু বিস্তারিত বলবেন?
উত্তর : আইভিএফ কোনো জটিল পদ্ধতি নয়। এখানে স্ত্রীকে ঋতুস্রাবের শুরু থেকে কতগুলো ইনজেকশন দিতে থাকি। যাতে তার ডিমগুলো বড় হয়, পরিপক্ব হয়। মাঝেমধ্যে একটু ফলোআপ করি। আলট্রাসাউন্ড করি। রক্ত পরীক্ষা করে দেখি যে বড় হচ্ছে কি না। যখন ডিমগুলো পরিপক্ব হয়, সেগুলোকে আমরা বাইরে নিয়ে আসি। বাইরে এনে স্বামীর শুক্রাণুর সঙ্গে মিলিয়ে ল্যাবে এম্ব্রোয়স (ভ্রূণ) তৈরি করে, সেই এম্ব্রোয়স (ভ্রূণ) জরায়ুতে প্রতিস্থাপন করে দিই। এটা খুব বড় কিছু আমি বলব না। খুব ছোট পদ্ধতি। স্বাভাবিক বাচ্চাদের মতোই এটি হচ্ছে।
প্রশ্ন : অনেকের ধারণা থাকে টেস্টটিউব বেবি, তাই সম্পূর্ণ বিষয়টিই বোধ হয় টেস্টটিউবে হয়…
উত্তর : আসলে বাইরে হচ্ছে না। কেবল ফার্টিলাইজেশন বাইরে হচ্ছে, এরপর আবার জরায়ুর মধ্যে সে স্বাভাবিক শিশুর মতো বড় হচ্ছে। এবং জন্মের পরও সে বাচ্চাটি স্বাভাবিক বাচ্চাদের মতোই হচ্ছে। জন্মগত কোনো ত্রুটি নেই, একই রকমই হচ্ছে। স্বাভাবিক বাচ্চা যে রকম হয়, টেস্টটিউব বেবিও সে রকম হয়।
প্রশ্ন : বন্ধ্যত্ব যেন সহজে ধরা পড়ে এবং সে অনুযায়ী যাতে চিকিৎসা নেয়, এ জন্য দম্পতিদের প্রতি আপনার কোনো পরামর্শ আছে কি না?
উত্তর : পরামর্শ হচ্ছে, অনেক দম্পতি জানেন না কোন নির্দিষ্ট সময়ে সহবাসে গেলে গর্ভধারণের সম্ভাবনা থাকে। সেটি জেনে সময় অনুযায়ী চেষ্টা করতে হবে। এর পরও যদি গর্ভধারণ না হয়, এক বছর চেষ্টা করে তাদের অবশ্যই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
Leave a Reply