সন্তানকে নিয়ে মা-বাবার ভাবনা নানা রকম। সন্তান যখন ছোট থাকে, তখন তার খাবার-ঘুম-জ্বর-সর্দি নিয়েই তাঁদের ভাবনা। কিন্তু সেই সন্তান যখন বড় হতে থাকে, তখন ভাবনাচিন্তার ডালপালা অনেকখানি বড় হয়ে যায়। সে স্কুলে কাদের সঙ্গে মিশছে, ঠিকমতো কোচিং করছে কি? বন্ধুরা কেমন, সে কি আবার নেশার খপ্পরে পড়ছে কি না, বন্ধুদের সঙ্গে তাকে ঘুরতে যেতে দেওয়া ঠিক কি না—এমনই নানা জিজ্ঞাসা মা-বাবার মনে উঁকি দেয়। সন্তানদের এই বড় হওয়ার সময়টা বেশ সতর্কতার সঙ্গে নাড়াচাড়া করতে হবে মা-বাবাকে। এ জন্য তাঁদের প্রস্তুতি নিতে হবে সন্তানের জন্মের পরপরই। যেটাকে বলা হয় ‘গুড প্যারেন্টিং’ বা সন্তান লালন-পালনের আদর্শ কৌশল। সারা পৃথিবীতে মা-বাবারা চারটি পদ্ধতির মধ্যে যেকোনো একটি বেছে নিয়ে সন্তানকে বড় করে তোলেন। পদ্ধতিগুলো হচ্ছে:
এক. ‘তুমি অবশ্যই এটি করবে…নইলে’
এই ধরনের মা-বাবার ধরনকে বলা হয় ‘অথরিটেরিয়ান’ বা কর্তৃত্বপরায়ণ। তাঁরা সব সময় কড়া শাসন আর আদেশের বেড়াজালে শিশুকে আটকে রাখেন। ‘এটা করতে পারবে না, ওখানে যেতে পারবে না, তোমাকে অবশ্যই এটি করতে হবে’ ইত্যাদি বাক্যজালে তাঁরা সন্তানের মনোজগৎকে বেঁধে ফেলেন। পান থেকে চুন খসলে শুরু হয় বকা বা শারীরিক নির্যাতন; ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ আর অন্য শিশুর সঙ্গে চলে তুলনা। তাঁরা ভাবেন, ‘আমি যা কিছু করছি, সন্তানের ভালোর জন্যই করছি’, কিন্তু বাস্তবে এ ধরনের মা-বাবার সন্তানের মনোজগৎ হয়ে ওঠে সংকীর্ণ। ভবিষ্যতে তারা বিষণ্নতাসহ নানা সমস্যা, যেমন মাদকাসক্তিতে আক্রান্ত হতে পারে।
দুই. ‘তোমার যেটা ভালো লাগে…সেটাই করো’
সন্তানের প্রতি অতিরিক্ত ভালোবাসা আর অন্ধস্নেহ থেকে সন্তানের কোনো আচরণের বিরুদ্ধে মা-বাবা যান না। সন্তানের সবকিছুতেই তাঁদের সম্মতি। তার সব চাওয়া-পাওয়া পূরণ করেন। এই মা-বাবাদের ধরনকে বলা হয় ‘ইনডালজেন্ট-পারমিসিভ’ বা প্রশ্রয়পূর্ণ আচরণ। এ ধরনের মা-বাবার সন্তানেরা উগ্র মেজাজের হয়। একপর্যায়ে দেখা যায়, মা-বাবা রীতিমতো তাঁদের সন্তানকে ভয় পাচ্ছেন। অবাধ্য আচরণ, নেশাসহ বয়ঃসন্ধিকালের নানা সমস্যায় আক্রান্ত হতে পারে এই সন্তানেরা।
তিন. ‘আমাদের কিছু যায়-আসে না’
সন্তানের প্রতি উপেক্ষাপূর্ণ আচরণও করে থাকেন কিছু মা-বাবা। বিশেষ করে, ভেঙে যাওয়া পরিবার বা মা-বাবার মধ্যে অন্তত একজন যদি মানসিকভাবে অসুস্থ হন, তখন এ ধরনের প্যারেন্টিং দেখা যায়। এই পরিবারের সন্তানের মধ্যে সাধারণত সামাজিক মূল্যবোধ গড়ে ওঠে না। মানসিক সমস্যা, নেশা, ব্যক্তিত্বের সমস্যাসহ নানা জটিলতায় পূর্ণ হতে পারে তাদের জীবন।
চার. ‘এটা না করাই ভালো। তুমি ভেবে দেখো, এর কোনো ভালো দিক আদৌ আছে কি না’
এই ধরনের মা-বাবাকে আমরা বলে থাকি আদর্শ মা-বাবা। যাকে বলা হয় ‘অথরিটেটিভ-রেসিপ্রোকাল’ বা পারস্পরিক নির্ভরযোগ্য। তাঁরা সন্তানকে নিয়মকানুন শিক্ষা দেন ও তার ব্যাখ্যা জানান। নিয়মের ব্যতিক্রম হলে শাস্তির বদলে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন। তাঁরা সন্তানকে একটা সীমা পর্যন্ত স্বাধীনতা দেন এবং বয়সের সঙ্গে সঙ্গে এই সীমা বাড়ান। সন্তানের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক হয় অনেকটা বন্ধুর মতো। এ ধরনের মা-বাবার সন্তানের মধ্যে আত্মবিশ্বাস বেশি হয়, বন্ধুসুলভ হয়, সাধারণত নেশা করে না এবং ভবিষ্যতে তারাও ভালো মা-বাবা হিসেবে নিজেকে প্রকাশ করে।
এই চার ধরনের মধ্যে শেষের ধরনটিকে আমার বলতে পারি গুড প্যারেন্টিং, যেখানে সন্তানের প্রতি নিয়মকানুন থাকলেও বাড়াবাড়ি নেই, স্বাধীনতা থাকলেও তার সীমা রয়েছে। এই ধরনের মা-বাবার সন্তানেরা উঠতি বয়সের নানা সমস্যা, বিশেষ করে নেশার জগৎকে এড়িয়ে চলতে সক্ষম হয়।
হঠাৎ নেশা: গোপন করবেন না
সবকিছু করার পরও যে কারও সন্তান যেকোনো সময় নেশায় আসক্ত হয়ে যেতেই পারে। এ সময় মা-বাবারা যেটা করবেন, তা হলো:
l বিষয়টি লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করবেন না। পরিবারের নির্ভরযোগ্য সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করুন। এই একটি পদক্ষেপ আপনাকে ও আপনার সন্তানকে ভবিষ্যতের বড় ধরনের বিপর্যয় থেকে রক্ষা করবে। রাত জেগে নেশা করে পরদিন সারা বেলা যখন সে ঘুমাচ্ছে, তখন সাফাই গেয়ে বলবেন না, ‘সারা রাত অ্যাসাইনমেন্ট করেছে তো, এখন ঘুমাচ্ছে।’
l নেশা করছে জেনে তার ওপর চড়াও হবেন না। তাকে মানসিক বা শারীরিক পীড়ন করলে, ঘরে তালাবন্দী করে রাখলে তার উপকারের চেয়ে ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা বেশি।
l নিজেদের দোষী ভাববেন না। মা-বাবা একে অন্যকে দায়ী করবেন না। পারিবারিক সম্প্রীতি বজায় রাখুন।
l সন্তান নেশা করছে জেনে তাকে ঘৃণা করবেন না। তাকে অভয় দিন। সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিন, মাদকাসক্তি একটি রোগ। এই রোগের চিকিৎসা আছে এবং এই চিকিৎসার প্রতিটি পর্যায়ে আপনি তার পাশে আছেন।
l নেশা করছে, এমন প্রমাণ পেলে তার সঙ্গে সরাসরি কথা বলুন। কত দিন থেকে নেশা নিচ্ছে, কী নেশা নিচ্ছে, সে নেশামুক্ত হতে চায় কি না—জানার চেষ্টা করুন।
l প্রয়োজন হলে তাকে রাজি করিয়ে চিকিৎসার আওতায় নিয়ে আসুন। ধৈর্য ধরে চিকিৎসা করান। মনে রাখবেন, নেশামুক্ত হওয়ার চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদি এবং প্রয়োজনে একাধিকবার এ চিকিৎসা লাগতে পারে।
l নেশামুক্ত করার জন্য তাকে বিয়ে দেবেন না বা বিদেশে পাঠাবেন না। এর কোনোটিই নেশা থেকে মুক্তির উপায় নয়।
সন্তানকে নেশার জগৎ থেকে দূরে রাখতে এবং কোনোক্রমে সে নেশাগ্রস্ত হলে সে পথ থেকে তাকে ফিরিয়ে আনতে সবার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বটি যাঁদের, তাঁরা হলেন মা-বাবা। তাই আপনারা নিজেরা কখনো ভেঙে পড়বেন না, হাল ছাড়বেন না। আপনার সন্তানের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ আপনারই হাতে।
আহমেদ হেলাল
সহকারী অধ্যাপক
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, আগস্ট ৩১, ২০১২
Leave a Reply