বিভিন্ন রোগ এবং চিকিৎসার ব্যাপারে আমাদের অনেক ভুল ধারণা ও কুসংস্কার রয়েছে। এ জন্য জনগণের অশেষ কষ্ট ও আর্থিক অপচয় ঘটে। চিকিৎসা বিষয়ে কুসংস্কার খুবই মারাত্মক ও দুঃখজনক। ভুল ধারণার জন্য এবং সময়মত সঠিক চিকিৎসার অভাবে রোগীর জীবনে নেমে আসে বিপর্যয় ও হতাশা। পৃথিবীর অনেক দেশ আজ এ ধরনের অভিশাপ থেকে মুক্ত। বাংলাদেশের জনগণকেও এ অভিশাপ ও অজ্ঞতা থেকে মুক্ত হতে হবে। তাই দাঁতের রোগের ক্ষেত্রে বিরাজমান কিছু ভুল ধারণা ও কুসংস্কার সম্পর্কে আলোচনা করা হলো, যাতে আমরা এ বিষয়ে সাবধান হতে পারি।
আমাদের দেশে এখনো অনেকে বিশ্বাস করে, দন্তক্ষয় হলে দাঁতের মধ্যে বড় বড় পোকার সৃষ্টি হয় এবং এ কারণে দাঁতে ব্যথা হয়। এ বিশ্বাসের মুলে রয়েছে বিভিন্ন কুসংস্কার ও হাতুড়ে ডাক্তারদের অপপ্রচার। সেজন্য দাঁতে ব্যথা হলে আজো অনেকে ঝাড়ফুঁকের আশ্রয় নেয় উপশমের জন্য। বেদে-বেদেনীরা ঝাঁড়ফুকের মাধ্যমে বড় বড় পোকা বের করে দেখায় এবং রোগীর কাছ থেকে থেকে প্রচুর অর্থ গ্রহণ করে। চোখ বা কানে ব্যথা হলেও এই ধরনের পোকা বের করে দেখানো হয়। এখন বুঝতে হবে আসলে ব্যাপারটা কী?
আমরা ভালো করে জানি, দাঁতে ব্যথার জন্য সাধারণত দুটি প্রধান কারণ দায়ী। একটি দন্ত মজ্জার প্রদাহ অন্যটি মাড়ি সংক্রান্ত রোগের জন্য। দাঁতের রোগের প্রধান কারণ হলো ‘জীবাণু প্রলেপ’। খাদ্যকণা, মুখে অবস্হিত বিভিন্ন প্রকার জীবাণু, মুখের শ্লৈষ্মিক ঝিল্লি থেকে ইপিথেলিয়াল কোষ এবং লালা থেকে মিউসিন ইত্যাদি সংযুক্ত হয়ে ‘জীবাণু প্রলেপ’ তৈরি হয়। এই ‘প্রলেপ’ দাঁতের মুকুটে আঠার মতো লেগে থাকে এবং দন্তক্ষয় ও মাড়ি সংক্রান্ত রোগের সৃষ্টি করে।
দন্তক্ষয় হলে দাঁতের মধ্যে ছোট ছোট গর্ত সৃষ্টি হয়। এ ক্ষয় যখন দন্তমজ্জা পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করে তখন দন্তমজ্জায় প্রদাহের সৃষ্টি হয় এবং দাঁতে তীব্র ব্যথা অনুভুত হয়। এ অবস্হায় পরে দাঁতের গোড়ায় পুঁজ জমে মুখ ফুলে যেতে পারে।
১। দন্তক্ষয়ের ফলে দাঁতে যে ধরনের ক্ষুদ্র গর্তের সৃষ্টি হয় সেখানে যে ধরনের পোকা বের করে দেখানো হয় তার একটিরও জায়গা হওয়ার কথা নয়। অথচ তারা এই অতি ক্ষুদ্র গর্ত থেকেই এ ধরনের অনেক পোকা বের করে থাকে।
২। আমাদের মুখের মধ্যে যে স্বাভাবিক তাপ থাকে অথবা আমরা যখন গরম খাদ্য বা চা, দুধ ইত্যাদি পান করি সে অবস্হায় ওই ধরনের পোকা বাঁচতে পারে না।
৩। পৃথিবীর সব দেশের লোকেরই দন্তমজ্জা বা মাড়ি সংক্রান্ত রোগের জন্য দাঁতে ব্যথা হলে অনেক ক্ষেত্রে দাঁত উঠিয়ে ফেলতে হয়। বিভিন্ন ডেন্টাল হাসপাতাল বা ক্লিনিকে এ ধরনের উঠিয়ে ফেলা দাঁতের মধ্যে কেউ কোনোদিন ওই ধরনের পোকা দেখেনি।
তাহলে প্রশ্ন জাগে-কীভাবে পোকা দেখানো হয়। যতটুকু জানা যায় তারা (বেদে-বেদেনী) আগে থেকেই ওই সব পোকা বিভিন্ন ময়লা জায়গা থেকে সংগ্রহ করে রাখে। ওই সব পোকাই ঝাড়ফুঁক দেয়ার সময় অত্যন্ত কৌশলে হাতের কারসাজির মাধ্যমে প্রদর্শন করে। সুতরাং বেদে-বেদিনী বা ভন্ড ফকিরদের দাঁতের পোকা উঠানোর কথা কোনো প্রকারেই বিশ্বাসযোগ্য নয়।
দ্বিতীয়ত, আমাদের দেশে অনেকেই ধারণা করেন দাঁতে যে পাথর জমে তা ফেলে দিলে দাঁত নড়তে থাকে এবং দাঁতের ক্ষতি হয়। আমরা জানি শরীরের বিভিন্ন জায়গায় যেমন-গলব্লাডার, মুত্রাশয়, কিডনি ইত্যাদি স্হানে পাথর হয়, তেমনি দাঁতেও পাথর জমে। দাঁতে পাথর জমলে মাড়িকে ধীরে ধীরে ক্ষয় করে ফেলে এবং মারাত্মক মাড়ি রোগ দেখা দেয়। ফলে দাঁতের শিকড় যে অস্হির সাহায্যে চোয়ালের মধ্যে আটকে থাকে তা ক্ষয় হয়ে যায় এবং দাঁত নড়তে থাকে। শেষ পর্যায়ে দাঁত ফেলে দিতে হয়। তাহলে দেখা যাচ্ছে, পাথর দাঁতের ক্ষতি ছাড়া কোনো মঙ্গল করে না। সুতরাং পাথর হলে অবশ্যই তা সম্পুর্ণরুপে পরিষ্কার করে ফেলে দিতে হবে।
তৃতীয়ত, সঙ্গতি থাকা সত্ত্বেও অনেকে টুথপেষ্ট ও ব্রাশ ব্যবহার করে না, কারণ তারা মনে করে টুথব্রাশ ব্যবহার করলে দাঁত ফাঁক এবং দাঁতের এনামেল ক্ষয় হয়ে যায়। মুখ ও দাঁত পরিষ্কার করার প্রধান উদ্দেশ্য হলো দাঁতের ফাঁকে ফাঁকে যে সব খাদ্যকণা আটকে থাকে এবং দাঁতের এনামেলে যে জীবাণু প্রলেপ জমে তা পরিষ্কার করা। কারণ জীবাণু প্রলেপই দাঁতের বিভিন্ন প্রকার রোগ সৃষ্টি করে। খাদ্যকণা ও জীবাণু প্রলেপ দুর করতে ব্রাশ ব্যবহারই সবচেয়ে ভালো। মেছওয়াক বা নিমের ডাল ব্যবহার করে সেরকম ভালো ফল পাওয়া যায় না। দাঁত ফাঁক বা এনামেল ক্ষয় সাধারণত অন্য কারণে হয়ে থাকে- টুথব্রাশ ব্যবহারকে এ ব্যাপারে দায়ী করা উচিত নয়। দাঁতের স্বাস্হ্য রক্ষার জন্য টুথপেষ্ট ও ব্রাশ ব্যবহার করাই উত্তম। সেই সঙ্গে খিলাল এবং ডেন্টাল ফ্লস ব্যবহার করা যেতে পারে।
চতুর্থত, দাঁতের রোগ হলে অনেক ক্ষেত্রে দাঁত ফেলে দেয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায় থাকে না। এ ব্যাপারে অনেকেই মনে করে, দাঁত ফেলে দিলে চোখের জ্যোতি কমে যায়। প্রকৃতপক্ষে ব্যাপারটা অন্যরকম। কতগুলো ভালো আপেলের সঙ্গে যদি একটি খারাপ আপেল থাকে তবে খারাপ আপেলটি অন্য ভালো আপেলগুলোকেও ধীরে ধীরে নষ্ট করে দেয়। তেমনি একটি খারাপ দাঁত আশপাশের ভালো দাঁতকে নষ্ট করে ফেলতে পারে। এছাড়া একটি খারাপ দাঁতে সাধারণত অসংখ্য জীবাণু থাকে। এসব জীবাণু শরীরের রক্তের সঙ্গে মিশে যায় এবং শরীরের গুরুত্বপুর্ণ অংশ যেমন চোখ, কান, কিডনি, হৃৎপিন্ড ইত্যাদিতে মারাত্মক রোগের সৃষ্টি করে। সে জন্য সব দাঁত ফেলে দিলে চোখের জ্যোতি কমে যাবে, এ ধারণা ঠিক নয়।
উৎসঃ দৈনিক আমারদেশ, ১০ ডিসেম্বর ২০০৭
লেখকঃ অধ্যাপক (ডা.) মোহাম্মদ আশরাফ হোসেন
ডীন, ডেন্টাল অনুষদ, বিএসএম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
Leave a Reply