অনেকের ধারণা, সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতে হলে, ক্রনিক রোগদের দূরে রাখতে হলে, নানা নিয়মের মধ্যে যে শরীরচর্চা, তা কঠোর হওয়া চাই, কড়া হওয়া চাই, তা না হলে সুফল আসবে না।
এ জন্য অনেকে বেশ ভড়কে যান। সে জন্য ব্যায়াম করতেই চান না। মনে করেন কী হবে করে? এত কঠোর শ্রম করতে পারলে তো?
কিন্তু কথাটি ঠিক না। আর সেই কথাটি অনেক তথ্য, তত্ত্ব দিয়ে সাজিয়ে লিখেছেন চমৎকার একটি বই, দ্য ফার্স্ট টুয়েন্টি মিনিটস: সারপ্রাইজিং সায়েন্স রিভিলস হাউ উই ক্যান: এক্সারসাইজ বেটার ট্রেইন স্মার্টার, লিভ লংগার। লেখিকা গ্রিচেন রেনল্ডস। প্রায় এক দশক ধরে নিউইয়র্ক টাইমস-এ Phy Ed কলামে লিখছেন, প্রচণ্ড জনপ্রিয় কলাম: স্বাস্থ্য ও ফিটনেসের বিজ্ঞান বিষয়ে এই সাপ্তাহিক স্বাস্থ্যপ্রতিবেদন সবচেয়ে বেশি ই-মেইল তালিকার শীর্ষে। বইটির উপ-শিরোনাম পড়ে মনে হবে, মানবদেহ সুরক্ষার জন্য ব্যায়ামের যে সম্ভাবনাময় দিক, সে সম্পর্কে সাহসী অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে। মিস রেনল্ডসের কাছে থেকে বিস্ময়কর যে পরামর্শ, তা হলো আমাদের সবাইকে অনেক বেশি সময় ব্যায়াম করতে হবে, তা নয়, মানুষের মনে ব্যায়াম সম্পর্কে দুর্ভাবনা দূর করতেই এই পরামর্শ। স্পোর্টস পারফরম্যান্স বাড়াতে যে পরিমাণ ব্যায়াম প্রয়োজন, সাধারণ সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার জন্য ততটা ব্যায়াম দরকার নেই। সুস্বাস্থ্য অর্জনের জন্য আমাদের ম্যারাথন দৌড়ানোর প্রয়োজন নেই। এক্সারসাইজ বাইকে ঘাম ঝরানোর দরকার নেই; অক্সিজেন শরীরে গ্রহণ কতটা তুঙ্গে, তা পরিমাপের দরকার নেই। কিছু একটা করলে হয়, ব্যস।
ব্যায়াম বিশাল কৌতূহলোদ্দীপক। বসে থাকার চেয়ে দাঁড়ানো ভালো কেন? কম ব্যায়ামেও কাজ হয়। শুয়ে-বসে থাকা মানুষটি যদি প্রথম ২০ মিনিট চলে-ফিরে বেড়ায়, হাঁটাহাঁটি করে, তাহলে স্বাস্থ্যহিতকর ফল কত পাওয়া যাবে, বলুন। আয়ু বাড়বে, রোগের ঝুঁকি কমবে, প্রথম ২০ মিনিট শরীর সক্রিয় থাকলে সব হিত আসবে।
আমেরিকানদের কথা যদি বলি, দুই-তৃতীয়াংশ লোক কোনো ব্যায়ামই করে না। তাই সেই লোকগুলো যদি উঠে দাঁড়ায়, ২০ মিনিট হাঁটাহাঁটি করে, তাহলে বিশাল লাভ। ২০ মিনিটের বেশি করলে অবশ্য আরও লাভ। তবে ২০ মিনিট যথেষ্ট সুস্বাস্থ্য রাখার জন্য।
অনেকে ওজন হারানোর সঙ্গে ব্যায়ামকে গুলিয়ে ফেলেন। সে জন্য অনেকে ছেড়ে দেন ব্যায়াম, মনে করেন বেশ কষ্ট। অনেকে বাড়তি ওজন হারানোর জন্য ব্যায়াম করেন এবং যখন তাঁরা ব্যায়াম করে অবিলম্বে ওজন না হারান, তখন ব্যায়াম ছেড়ে কোচে প্রত্যাবর্তন করেন। অনেকে বোঝেন না যে ফিটনেস শরীরের মেদ জমার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ব্যায়াম করে শুরুতে মেদ ঝরল না, সে জন্য ফিটনেস অবহেলা করা কেন? হয়তো শরীর একটু ভারী কিন্তু ফিটনেস খুব ভালো অর্থাৎ Vo12Max বা শরীরের অক্সিজেন গ্রহণের পরিমাপ বেশ স্বাস্থ্যকর তাহলে সব ক্রনিক রোগ—ডায়াবেটিস, হূদেরাগ, ক্যানসার কমবে। পছন্দ করে নিতে হবে ফিটনেসকে অগ্রাধিকার হিসেবে, প্রথম প্রথম ওজন কমুক বা না কমুক, কুছ পরোয়া নেহি।
তাই ব্যায়ামের প্রোগ্রাম শুরু করা চাই ফিটনেস উন্নত করার জন্য, ওজন প্রথম কমুক বা না কমুক।
দীর্ঘ জীবন ও সুস্থ জীবন অর্জন করা যাবে। মানুষ যদি ব্যায়াম করাকে ভালো থাকার, সুস্থ থাকার দীর্ঘ জীবন লাভ করার উপায় হিসেবে দেখে, তাহলে ভালো। কেবল ক্ষীণতনু হওয়ার জন্য ব্যায়াম, তা কেন?
ব্যায়াম সম্পর্কে জনমনে যে ভুল ধারণা, তা-ও দেখিয়েছেন গ্রিচেন রেনল্ডস। এমন মনে করেন অনেকে, ব্যায়াম হতে হবে খুব শ্রমসাধ্য, ব্যায়াম মানে ম্যারাথন দৌড় বা বাইকে তিন ঘণ্টা ব্যায়াম করা বা তেমন কঠোর কোনো ব্যায়াম। অত্যন্ত ভুল এই ধারণা।
আর এই ভুল ধারণা অনেককে ব্যায়াম করতে নিরুৎসাহিত করে। যদি হাঁটতে থাকেন, তাহলে শরীর চিহ্নিত করে যে শরীর রয়েছে চলমান এবং সে জন্য সব রকম শারীরবৃত্তিক পরিবর্তন ঘটে ইতিবাচক, সে পথে শরীর যায় সুস্বাস্থ্যের পথে। বাগানে কাজ করাও কিন্তু ভালো ব্যায়াম। ব্যায়াম এই কঠিন শব্দকে ভুলে গিয়ে আমরা যদি ভাবি; চলমান হব, আরও বেশি নড়ব-চড়ব, বসে থাকব না, তা আরও ভালো নয় কি?
গ্রিচেন রেনল্ডস হেলথ কলামে প্রায়ই তিনি লিখতেন, শুয়ে-বসে জীবনযাপনের অহিত দিকগুলো সম্বন্ধে। তিনি বইটি লেখার পর নিজের ফিটনেস প্রোগ্রামেও আনলেন পরিবর্তন। ব্যায়াম শুরু করার স্ট্রেচিং শুরু করলেন। উঠ-বস ব্যায়ামও যোগ হলো। ব্যায়ামের সময় সজল থাকার কৌশলও জানলেন।
কেবল পিপাসিত বোধ করলেই জলপান করলেই হয়, এতেই ঠিক থাকে সব।
ব্যায়াম এত করতে হয় না। অনেকের সময়ের অভাব, কেবল সে জন্যই নয়, স্বাস্থ্যবান থাকার জন্য খুব বেশি সময় ব্যায়াম করতে হয় না। খুব প্রতিযোগিতামূলক শরীরচর্চাও দরকার নেই।
সুস্থ থাকাটাই বড় কথা। দীর্ঘজীবন সুস্থ থাকতে গেলে ওইটুকু ব্যায়াম যথেষ্ট।
এখন তিনি দু-তিন মাইল দৌড়ান। আগে পাঁচ মাইল দৌড়াতেন, এর প্রয়োজন নেই। আগে মনে হতো পাঁচ মাইল না দৌড়ালে ব্যায়াম হলো না। এখন দেখা যায় ২০ মিনিট বা আধা ঘণ্টা ব্যায়ামই যথেষ্ট, সুস্থ থাকার জন্য।
বসে থাকা কেন? মাঝেমধ্যেই দাঁড়িয়ে পড়া ভালো। এমন হয় অনেকেই একটানা চার-পাঁচ ঘণ্টা বসে কাজ করতে হয়, তাঁরা ২০ মিনিট পরপর দাঁড়িয়ে একটু হাঁটাচলা করলেন। একটানা এত সময় বসে থাকলে অনেক রকম রোগের আশঙ্কা বাড়ে, তাই একে দমাতে হলে কাজটি হলো উঠে দাঁড়ানো ও হাঁটা। সে সময় চলমান না হতে পারলেও সিট থেকে উঠে দাঁড়ালেও অনেক লাভ। ফোনে কথা বলার সময় উঠে দাঁড়ান, বসে বসে ফোনালাপ না-ই বা করলেন।
বেশি সময় না বসে বেশি সময় দাঁড়ান।
মানুষ যদি সুস্থ থাকতে চায়, দীর্ঘদিন সজীব-সতেজ হয়ে বাঁচতে চায় তাহলে রেনল্ডসের পরামর্শ, ‘হাঁটুন’। সহজতম ব্যায়াম। সবাই যা করতে পারে।
কেউ যদি হাঁটতে না চান তাঁদের জন্য—সাঁতার কাটুন।
চলমান থাকার জন্য নানা বিকল্প রয়েছে, যা কিছু আহত করে, ব্যথা পান যা করে, তা করবেন না। ব্যায়ামের যন্ত্রপাতি কেনার প্রয়োজন নেই।
একজোড়া আরামদায়ক জুতো হলে হয়, স্লিকারস কিনতে হবে কেন? অনেকের ধারণা, ব্যায়াম পর্ব বেশ জটিল হওয়া চাই, হার্টবিট মনিটর, একজন কোচ, যন্ত্রপাতি, বিশেষ নির্দেশ-উপদেশ। কিন্তু সত্যি, এর প্রয়োজন নেই। মানব শরীর সত্যি একটি চমৎকার কোচ।
শরীরের কথা যদি শোনেন, তাহলে এই মহাশয় বলে দেবে, কখন কঠোর ব্যায়াম করছেন। যদি ব্যথা লাগে কমিয়ে দিন। ব্যায়াম করবেন, ভালো লাগবে, মাত্র ভালো লাগছে, এটুকু চাই। চলমান হোন, নড়াচড়া চলুক সহজ-সরল, জীবনটা বদলে যাবে।
অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরী
পরিচালক, ল্যাবরেটরি সার্ভিসেস, বারডেম হাসপাতাল, সাম্মানিক অধ্যাপক ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ, ঢাকা।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুলাই ০৫, ২০১২
KHossain
স্যার অাপনার কথা গুলো এতভালো লাগল, প ড়ে খুব উপকার হল অামার,ধন্যবাদ স্যার