কিছুদিন আগে এক জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত ছবিতে দেখা যায়, একজন ব্যক্তি গাছে ঝুলে থাকা আমে রাসায়নিক পদার্থ স্প্রে করছেন। এই স্প্রে করায় আমের রং হলুদ হয়, উদ্দেশ্য কাঁচা আম পাকা বানিয়ে বিক্রি করা। অবস্থা এখন এতই ভয়াবহ যে খাবার তৈরির পরে তো বটেই, আগেও তাতে রাসায়নিক দ্রব্য মেশানো হচ্ছে। ভেজাল মেশানো হচ্ছে কয়েক পর্যায়ে। খাদ্যশস্য, ফলমূল, সবজি ইত্যাদি উৎপাদনের সময় রাসায়নিক উপাদান ব্যবহার করা হচ্ছে। মাঠ থেকে উত্তোলন ও প্রক্রিয়াজাত করার সময় ভেজাল দেওয়া হচ্ছে, আবার খাবার তৈরির সময়ও তাতে থাকছে ভেজালের স্পর্শ। এভাবে পুরো খাবারে ভেজালের ভাগটাই হয়ে যাচ্ছে বেশি।
ভেজাল ছাড়া খাবার যেন হয়ে উঠেছে সোনার হরিণ। চাল-ডাল-তেল-লবণ থেকে শুরু করে শাকসবজি, ফলমূল, শিশুখাদ্য সবকিছুতেই ভেজাল। মাছে ও দুধে ফরমালিন, সবজিতে কীটনাশক ও ফরমালিন, মচমচে করার জন্য জিলাপি ও চানাচুরে মবিল, লবণে সাদা বালু, চায়ে করাতকলের গুঁড়ো, মসলায় ভুসি, কাঠ, বালি, ইটের গুঁড়ো ও বিষাক্ত গুঁড়ো রং, এমনকি ইসবগুলের ভুসিতে ভুট্টার গুঁড়ো মিশানো হচ্ছে বলে শোনা যায়। টেক্সটাইল ও লেদারের রং মেশানো হচ্ছে সস্তা মানের বিস্কুট, আইসক্রিম, জুস, সেমাই, নুডলস ও মিষ্টিতে। মুড়িতে মেশানো হচ্ছে হাইড্রোজ, ফলে মুড়ি দেখতে চকচকে ও সাদা হয়, ফুলে-ফেঁপে বড় আকৃতি ধারণ করে। হাইড্রোজ একটি ক্ষারীয় পদার্থ, যা পেটে গিয়ে পড়ে রক্তের সঙ্গে মিশে শ্বেত কণিকা ও হিমোগ্লোবিনের কার্যকারিতা নষ্ট করে দেয়।
ভেজাল খাবারের উদাহরণ যেন অন্তহীন। মৌসুমি ফলও পাকানো হচ্ছে রাসায়নিক দ্রব্য দিয়ে। দ্রুত ফল পাকাতে ও আকর্ষণীয় বর্ণের করতে ব্যবহার করা হচ্ছে কার্বাইড আর পচন ঠেকাতে ফরমালিন। এভাবে আম, কমলা, আপেলের মতো ফলগুলো মাসের পর মাস রেখে বাজারজাত করা হচ্ছে অতিরিক্ত মুনাফা লাভের আশায়। ফলের মতো টমেটোও কেমিক্যাল দিয়ে পাকানো হচ্ছে আর পচন ধরা রোধ করার জন্য ওই টমেটো ফরমালিন মেশানো পানিতে চুবিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিক্রি করা হচ্ছে। সাধারণত ছোট আকারের এক বোতল ফরমালিন এক ড্রাম পানিতে মেশানো হয়। এই পানিতে পোকামাকড়, মশা-মাছি পড়লেও সঙ্গে সঙ্গে মারা যায়। এতে একবার খাবার ডোবানো হলে তা আর পচে না। এই ড্রামের পানিতে চুবিয়ে রাখা ফল, সবজি আর মাছ মানুষ তার গাঁটের পয়সা খরচ করে কিনছে এবং খাচ্ছে নিয়মিত, যেন জেনেশুনেই বিষপান করছে সবাই।
মানুষের খাবার তো বটেই, পশুপাখির খাবারও আজকাল ভেজালমুক্ত নয়। ভেজাল খাবার এখন সর্বত্র। শোনা যায়, খাবার তাজা রাখতে যে বরফ বা আইস ব্যবহার করা হয়, তাতেও থাকে ভেজাল। অনেকে এর নাম দিয়েছেন ‘আইসক্রাইম’। লোকমুখে গল্প শুনেছি, এক লোক মনের দুঃখে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পুরো এক বোতল বিষ খেয়েও তিনি মারা গেলেন না। পরে জানা গেল ওই বিষের মধ্যেও ভেজাল।
ভেজালের এই মহোৎসবের পেছনে রয়েছে একশ্রেণীর অসাধু মুনাফালোভী ব্যবসায়ী গোষ্ঠী। নকল খাবার, নিম্নমানের খাবার আর ভেজালমিশ্রিত খাবার বাজারজাত করে তারা হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। তাদের এই সীমাহীন লোভের জন্য বলি হচ্ছে সাধারণ মানুষ। বলা যায়, এ একরকম নীরব মানবহত্যা।
অতিরিক্ত কেমিক্যাল পদার্থ ব্যবহারে খাদ্যের ঘ্রাণ ও স্বাদ পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, পুষ্টির বদলে খাদ্যগুলো পরিণত হচ্ছে বিষে। পুষ্টির জোগান আর সুস্থতার পরিবর্তে দীর্ঘস্থায়ী রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন ভোক্তারা, নিজের অজান্তেই অনেকের দেহে বাসা বাঁধছে নানা মরণব্যাধি। বেড়ে যাচ্ছে নতুন নতুন রোগ ও আক্রান্তের সংখ্যা। জনস্বাস্থ্যের জন্য এ অবস্থা এক মারাত্মক হুমকি।
ভেজাল খাবার খেয়ে ভোক্তারা আক্রান্ত হন লিভার, কিডনি, হূদরোগ, ক্যানসারসহ নানা রকম জটিল রোগে। মানবদেহে গ্যাস্ট্রিক আলসার, পাকস্থলী আর অন্ত্রনালির প্রদাহ, অরুচি, ক্ষুধামান্দ্য, লিভার সিরোসিস, কিডনি ফেইলুর ইত্যাদি দেখা দেয়। এমনকি লিভার ক্যানসারও হতে পারে। এ ছাড়া এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে পারে অস্থিমজ্জা বা বোনম্যারোর ওপর। এতে রক্তকণিকার অস্বাভাবিকতা দেখা দিতে পারে। অ্যানিমিয়া বা রক্তাল্পতা হতে পারে, আবার লিউকেমিয়া বা ব্লাড ক্যানসারের মতো মারাত্মক ব্যাধি দেখা দিতে পারে।
গর্ভবতী মা ও শিশুর জন্য বিষয়টি আরও ভয়ংকর। ভেজাল মেশানো ফলমূল, সবজি, টমেটো, মাছ, মাংস ইত্যাদি খেলে গর্ভবতী মা ও সন্তান উভয়েই মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হতে পারে। সন্তান জন্মানোর সময় হাবাগোবা কিংবা বিকলাঙ্গ হওয়ার আশঙ্কা থাকে, মস্তিষ্ক সম্পূর্ণ নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে। সন্তানের বৃদ্ধি থেমে যায়, মস্তিষ্কের বিকাশও থেমে যায়। বস্তুত খাদ্যে ভেজালের কারণে দেশে এ ধরনের শিশুর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে।
মুশকিল হলো ভেজাল খাবারের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয় খুব ধীরে ধীরে। তাই অনেকেই জানতে পারেন না যে কী বিষ তিনি প্রতিদিন গ্রহণ করছেন, এর গুরুত্বও তাঁরা উপলব্ধি করতে পারেন না। এমনকি যখন চূড়ান্তভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন, তখনো বুঝতে পারেন না যে তাঁর প্রাত্যহিক ভেজালযুক্ত খাবারই এই পরিণতির জন্য দায়ী।
ভেজাল খাবার যে শুধু স্বাস্থ্য খাতই ক্ষতিগ্রস্ত করছে তা নয়, এতে চাপ পড়ছে অর্থনীতির ওপরও। যেসব মারাত্মক অসুখে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে তার চিকিৎসা ব্যয় অত্যধিক, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দীর্ঘস্থায়ী চিকিৎসা লাগে, কখনো বা আজীবন চিকিৎসা করতে হয়। এতে মানুষের কষ্টার্জিত টাকার বড় অংশ চলে যাচ্ছে অনাকাঙ্ক্ষিত চিকিৎসা খাতে। অথচ ভেজাল নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে এই বাড়তি অসুখ তথা বাড়তি খরচ প্রতিরোধ করা যেত। আবার রাসায়নিক ব্যবহারের ফলে অসাধু ব্যবসায়ীরা একচেটিয়া মুনাফা করে যাচ্ছেন, যার ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে প্রকৃত ব্যবসায়ীদের ওপর, যাঁরা সৎ উপায়ে ব্যবসার চেষ্টা করছেন। দ্রুত পাকানো আর পচন রোধের ওষুধ দেওয়া খাবারের সঙ্গে অসম প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে তাঁরা হয় বিরাট লোকসানের বোঝা কাঁধে নিয়ে ব্যবসা গুটিয়ে ফেলছেন অথবা সময়ের স্রোতে ভেসে নিজেরাও ভেজালের কারবারে যুক্ত হচ্ছেন।
মনে রাখা দরকার, ভেজাল মেশানো এসব খাবার যাঁরা খাচ্ছেন, শুধু তাঁরা কিংবা তাঁদের পরিবারই নয়, ভেজাল মেশানোর এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, যেমন উৎপাদনকারী, আমদানিকারক, পাইকার, ব্যবসায়ী কেউই ঝুঁকিমুক্ত নন। লাভ ও লোভের বলি শুধু ভোক্তারাই হবেন, তা নয়, অসাধু ব্যবসায়ীরাও এর থেকে পরিত্রাণ পাবেন না।
ভেজালের এই কালো থাবা থেকে নিস্তার পেতে হলে আমাদের সবাইকে সচেষ্ট হতে হবে। মূলত সরকারের দায়িত্বই এখানে প্রধান। ভেজালবিরোধী আইন কঠোর করতে হবে, এর প্রয়োগও হতে হবে দ্রুত, যথাযথ। ভ্রাম্যমাণ আদালতের সংখ্যা বাড়াতে হবে এবং এর কার্যকারিতা সুনিশ্চিত করতে হবে। তবে এ কথাও মনে রাখতে হবে, শুধু বাজারে গিয়ে রাস্তার পাশের দরিদ্র ফল বিক্রেতার আমগুলো ধ্বংস করে এবং সামান্য জেল জরিমানা করেই এই সমস্যার সমাধান হবে না। শুধু এই চুনোপুঁটিদের শাস্তি দিলেই চলবে না, বরং যাঁরা এই অনৈতিক কাজের মূল কারবারি, সেই রাঘববোয়ালদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। ভোক্তা অধিকার আইনের যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে। খাদ্য ও ভোগ্যপণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আলাদা প্রশাসন গড়ে তোলা যেতে পারে। শোনা যায় অসাধু সিন্ডিকেটও নানা কায়দায় ভেজালবিরোধী কার্যক্রমে বাধা দিচ্ছে। এমনকি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার যোগসাজশ রয়েছে বলেও শোনা যায়। কাজেই ভেজাল দূর করতে হলে এ ক্ষেত্রে দুর্নীতি ও অনিয়মও দূর করতে হবে কঠোর হস্তে।
ভেজাল খাবার রোধের জন্য মানুষের সচেতনতা খুবই জরুরি। এ ক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যম, সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও সচেতন মহলকেই এগিয়ে আসতে হবে। মানুষকে বোঝাতে হবে, ভেজালের ব্যাপ্তি ও পরিণতি ব্যাখ্যা করতে হবে, এগুলো থেকে বেঁচে থাকার পথও দেখাতে হবে। আমাদের দেশে যে হারে দুরারোগ্য ব্যাধি বাড়ছে, তাতে ভেজাল খাদ্যদ্রব্য গ্রহণ করার ব্যাপারে সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। একই সঙ্গে জরুরি ভিত্তিতে প্রতিরোধ করার যত ব্যবস্থা তা নিতে সরকারসহ সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। তা না হলে রোগব্যাধির সংখ্যা বেড়ে যাবে এবং তার চিকিৎসার জন্য অর্থনৈতিক দৈন্যসহ নানামুখী চাপে মানুষ হিমশিম খাবে। রোগব্যাধি যেমন বাড়বে, তেমনি সঙ্গে তৈরি হবে মেধাশূন্য জাতি, যা দেশের জন্য এক ভয়ানক পরিণতি ডেকে আনবে।
এ বি এম আবদুল্লাহ
ডিন, মেডিসিন অনুষদ, অধ্যাপক, মেডিসিন বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুন ০৬, ২০১২
osman
ei desh e jonmo hoye ajonmo pap hoyeche.manush koto boro bodmash hote pare.
Bangla Health
দোষটা দেশের নয়; মানুষের।