ঠোঁট, গালের ভেতরের ঝিল্লি, দাঁতের মাড়ি, জিহ্বা ও জিহ্বাসংলগ্ন মুখের অংশ, মুখের তালু ইত্যাদি মুখ ও মুখগহ্বরের প্রতিটি অঙ্গই ক্যানসারে আক্রান্ত হতে পারে। দীর্ঘদিন বিভিন্ন কার্সিনোজেনের (ক্যানসারের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ উপাদান) প্রভাবে এ ধরনের ক্যানসার হয়। প্রথম দিকে ছোট একটি বিন্দু আকারের ঘা বা পিণ্ডের মতো দেখায়। ধীরে ধীরে এর আকার বাড়তে বাড়তে এমন এক আকৃতি ধারণ করে, যা দেখে শিউরে উঠতে হয়।
নারী-পুরুষ উভয়েরই এ ধরনের ক্যানসার হয়। তবে পুরুষের এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার হার বেশি। সাধারণত বয়স্করা (৫০ বছর ও পঞ্চাশোর্ধ্ব) এ রোগে আক্রান্ত হন। তবে কম বয়সীদেরও এই ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা কম নয়। একেবারে প্রথম দিকে তেমন কোনো উপসর্গ থাকে না।
রোগ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সমস্যা আরও বাড়তে থাকে। খাবার খেতে যত সমস্যা। মুখে ঝাল লাগা, খাবারের স্বাদেও পরিবর্তন হওয়া, খাবার চিবুতে কষ্ট, গিলতে কষ্ট—এমনকি অনেক সময় হাঁ করতেও কষ্ট হয়। খাবার খেতে কষ্ট হওয়ায় অল্প দিনেই পুষ্টির অভাব দেখা দেয় এবং শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা লোপ পায়। মুখ ও মুখগহ্বরের অংশবিশেষ ঠিকমতো নড়াচড়া না করায় কথা জড়িয়ে যায়। অর্থাৎ স্পষ্ট উচ্চারণে কথা বলা যায় না। এ ছাড়া মুখ ও মুখগহ্বরের ক্যানসারের কারণে চোখের দৃষ্টি, নাকের গন্ধ ও কানে শোনার মতো বিশেষ স্নায়ুর কার্যকারিতায় বাধাগ্রস্ত হয়।
মুখ ও মুখগহ্বরের ক্যানসার আশঙ্কা করার মতো উপসর্গ ও চিহ্ন—
মুখের পর্দা বা ঝিল্লিতে কোনো ক্ষত, খোঁচা খোঁচা অনুভব হওয়া, পিণ্ড বা পুরু হয়ে যাওয়া।
মুখের পর্দায় লাল বা সাদা ঘা।
গলায় কিছু একটা যেন বেঁধে আছে মনে হওয়া।
চিবুতে বা গিলতে কষ্ট হওয়া।
চোয়াল বা জিহ্বা নাড়াতে কষ্ট হওয়া।
জিহ্বা বা মুখের অন্যান্য অংশে বোধশক্তি কমে যাওয়া।
দাঁতের মাড়ি ফুলে যাওয়া এবং বাঁধানো দাঁত মাড়িতে ঠিকমতো সেট না হওয়া।
এক কানে ব্যথা অনুভব করা, কিন্তু কানে শুনতে কোনো সমস্যা নেই।
উল্লিখিত সমস্যার যেকোনো একটি দুই সপ্তাহের বেশি স্থায়ী হলে দন্তচিকিৎসক বা চিকিৎকের পরামর্শ নিতে হবে এবং ক্যানসার হয়েছে কি না, তার জন্য ডাক্তারি পরীক্ষা করাতে হবে। তবে এসব উপসর্গ বা সংকেত মানেই ক্যানসার নয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে প্রদাহ ও অন্যান্য কারণে এ ধরনের সমস্যা হয়ে থাকে।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এ ধরনের সমস্যা হলেই ডাক্তারি পরীক্ষা করানো জরুরি। কারণ, যদি ক্যানসার হয়ে থাকে, তবে প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণয় করে সফল চিকিৎসা দেওয়া যায়।
ডাক্তারি পরীক্ষা কী?
চিকিৎসক কর্তৃক মুখ ও মুখগহ্বরের ভেতরের বিভিন্ন অংশ, গলা, গলার ভেতরের অংশ পরীক্ষা করানো। পরীক্ষা খুব সহজ। কোনো ব্যথা হয় না। সময়ও খুব অল্প লাগে।
কী কী বিষয় ঝুঁকিপূর্ণ
সব ধরনের ধূমপান, যেমন—বিড়ি, সিগারেট, পাইপ, সিগার ইত্যাদি ব্যবহার; পান, সুপারি, জর্দা বা সাদাপাতা (তামাক) খাওয়ার অভ্যাস; দাঁতের গোড়ায় গুল (তামাকপাতার গুঁড়া) ব্যবহার; নেশা (গাঁজা) সেবন; মদ, তাড়ি সেবন, কড়া রোদে দীর্ঘ সময় অবস্থান করা, জিহ্বা বা গালে আঘাত, যেমন—দীর্ঘদিন ধারালো দাঁতের খোঁচা লাগা, সংক্রামক রোগ, যেমন—হিউম্যান প্যাপিলোমা নামের ভাইরাসের আক্রমণ।
ক্যানসার রাতারাতি ঘটে না। দীর্ঘদিন ঝুঁকিপূর্ণ উপাদানের প্রভাবে ধীরে ধীরে মুখ ও মুখগহ্বরের পর্দার কোষে পরিবর্তনের সূচনা হয়। একসময় তা ক্যানসার কোষে রূপান্তর ঘটে।
একাধিক ঝুঁকিপূর্ণ বিষয় থাকলে ঝুঁকির মাত্রা বেড়ে যায়।
কীভাবে প্রতিরোধ করতে হবে
ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়গুলো এড়িয়ে চলা।
গালে বা জিহ্বায় ধারালো দাঁতের খোঁচা অনুভব হলে দন্তচিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
মুখ ও মুখগহ্বর নিয়মিত পরিষ্কার রাখতে হবে।
নিয়মিত দাঁত মাজা ও দাঁতের যত্ন নেওয়া।
মাসে একবার নিজেকে নিজে আয়না দিয়ে ঠোঁট, গাল, জিহ্বা, তালু, দাঁত ও দাঁতের মাড়ি ইত্যাদি মুখ ও মুখগহ্বরের বিভিন্ন অঙ্গ সময় নিয়ে ভালো করে দেখতে হবে।
সুষম খাবার খাওয়া। পর্যাপ্ত পরিমাণে ফলমূল, শাকসবজি ও আঁশজাতীয় খাবার খাওয়া, যাতে শরীরে ভিটামিন, আয়রন ও অন্যান্য পুষ্টির অভাব না থাকে।
সংক্রামক রোগের চিকিৎসা করাতে হবে।
পারভীন শাহিদা আখতার
অধ্যাপক, মেডিকেল অনকোলজি
জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, মহাখালী, ঢাকা।
ছবিটি প্রতীকী। পান, সুপারি, জর্দা বা সাদাপাতা (তামাক) খাওয়ার অভ্যাস; দাঁতের গোড়ায় গুল (তামাকপাতা)
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ফেব্রুয়ারী ০১, ২০১২
Leave a Reply