ইদানীং অনেক রোগী প্রায়ই অভিযোগ করছেন যে তাঁদের ডেঙ্গু জ্বর হয়েছিল, কিন্তু জ্বর সেরে গেলেও শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগী সাধারণত পাঁচ থেকে সাত দিনের মধ্যেই সম্পূর্ণ ভালো হয়ে যায়, অথচ দেখা যাচ্ছে জ্বর চলে গেলেও রোগী আরও দীর্ঘদিন অসুস্থ ও দুর্বল বোধ করছেন। শরীরের বিভিন্ন অংশে, বিশেষ করে গিঁটে গিঁটে ব্যথা কিছুতেই যাচ্ছে না। আসলে ডেঙ্গু হিসেবে ধরে নেওয়া হলেও এ রোগটি সম্ভবত ডেঙ্গু জ্বর নয়, বরং অন্য একটি ভাইরাসজনিত জ্বর, যাকে বলে চিকুনগুনিয়া।
চিকুনগুনিয়া একটি ভাইরাসজনিত অসুখ। এ রোগটি আফ্রিকা এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রোগ হলেও আমাদের দেশের কিছু কিছু এলাকায় এ রোগ পাওয়া যাচ্ছে। আমাদের অতিপরিচিত ডেঙ্গুর সঙ্গে এর অনেকটাই মিল রয়েছে। ডেঙ্গু জ্বরের মতোই চিকুনগুনিয়া ভাইরাস এডিস মশার মাধ্যমে ছড়ায়।
চিকুনগুনিয়ার মূল উপসর্গ হলো জ্বর এবং অস্থিসন্ধির ব্যথা। জ্বর অনেকটা ডেঙ্গুর মতোই দেহের তাপমাত্রা অনেক বেড়ে যায়, প্রায়ই ১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট ডিগ্রি পর্যন্ত উঠে যায়, তবে কাঁপুনি বা ঘাম দেয় না। জ্বরের সঙ্গে সঙ্গে মাথাব্যথা, চোখ জ্বালা করা, গায়ে লাল লাল দানার মতো রেশ, অবসাদ, অনিদ্রা, বমি বমি ভাব ইত্যাদি দেখা দিতে পারে। এ ছাড়া শরীরের বিভিন্ন স্থানে, বিশেষ করে অস্থিসন্ধিতে তীব্র ব্যথা হয়—এমনকি ফুলেও যেতে পারে। জ্বর সাধারণত দুই থেকে পাঁচ দিন থাকে এবং এর পর নিজে থেকেই ভালো হয়ে যায়। তবে তীব্র অবসাদ, পেশিতে ব্যথা, অস্থিসন্ধির ব্যথা ইত্যাদি জ্বর চলে যাওয়ার পরও কয়েক সপ্তাহ থাকতে পারে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এমনকি মাসের পর মাসও অস্থিসন্ধিতে ব্যথা বা প্রদাহ থাকতে পারে, যা অনেক ক্ষেত্রেই রোগীকে স্বাভাবিক কাজ করতে অক্ষম করে তোলে। রোগী ব্যথায় এতই কাতর হয় যে হাঁটতে কষ্ট হয়, সামনে বেঁকে হাঁটে। স্থানীয়ভাবে কোথাও কোথাও তাই একে ‘ল্যাংড়া জ্বর’ বলা হয়। দেখা গেছে, রোগীর বয়স যত বেশি, তার রোগের তীব্রতাও তত বেশি হয় এবং উপসর্গগুলো, বিশেষ করে শরীরে ব্যথাও তত বেশি দিন থাকে। ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীর সাধারণত এত দীর্ঘ সময় শরীরে ব্যথা বা অন্য লক্ষণগুলো থাকে না। ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীর মূল সমস্যা হলো শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে রক্তক্ষরণ, যা অনেক সময় খুব ভয়াবহ হতে পারে। কিন্তু চিকুনগুনিয়া জ্বরে ডেঙ্গুর মতো রক্তক্ষরণ হয় না এবং রক্তের প্লাটিলেট সাধারণত খুব বেশি কমে না। এ রোগে আক্রান্ত হলে কেউ মারা যায় না, শুধু দীর্ঘদিনের জন্য অনেকেই স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলতে পারে। ডেঙ্গু জ্বরে চারবার আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে, কিন্তু চিকুনগুনিয়া একবার হলে সাধারণত আর হয় না।
চিকুনগুনিয়া সন্দেহ হলে রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে তা নিশ্চিত হওয়া যায়। এ ক্ষেত্রে রোগীর রক্তে ভাইরাসের বিরুদ্ধে তৈরি হওয়া অ্যান্টিবডি দেখা হয়। এতে দুই থেকে ১২ দিন লাগতে পারে। রোগীর আর্থিক সামর্থ্য না থাকলে শুধু শুধু এ পরীক্ষা করার কোনো দরকার নেই। কেননা এতে চিকিৎসার ক্ষেত্রে কোনো লাভ হবে না। চিকুনগুনিয়া জ্বরের কোনো প্রতিষেধক নেই। এর চিকিৎসা মূলত রোগের উপসর্গগুলোকে নিরাময় করা। রোগীকে সম্পূর্ণ বিশ্রামে রাখতে হবে এবং প্রচুর পানি বা অন্যান্য তরল খেতে দিতে হবে। জ্বরের জন্য প্যারাসিটামল-জাতীয় ওষুধই যথেষ্ট এবং এর সঙ্গে সঙ্গে পানি দিয়ে শরীর মুছে দিতে হবে। তীব্র ব্যথার জন্য এনএসএআইডি-জাতীয় ওষুধ প্রয়োজন হতে পারে, তবে অ্যাসপিরিন না দেওয়াই ভালো। ক্লোরোকুইন এ রোগের উপশম করে বলে কেউ কেউ দাবি করছেন। আবার যেন মশা না কামড়ায় এ জন্য রোগীকে মশারির ভেতরে রাখাই ভালো। কারণ, আক্রান্ত রোগীকে মশায় কামড় দিয়ে কোনো সুস্থ লোককে সেই মশা কামড় দিলে ওই ব্যক্তিও এ রোগে আক্রান্ত হবেন।
চিকুনগুনিয়ার জন্য কোনো ভ্যাকসিন বা টিকাও নেই। তাই প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো এডিস মশা প্রতিরোধ। এডিস মশার উৎপত্তিস্থল ধ্বংস করা এবং মশাকে নির্মূল করাই মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। বাসাবাড়ির আশপাশে যেখানে পানি জমে থাকতে পারে, তা সরিয়ে ফেলতে হবে অথবা নিয়মিত পরিষ্কার রাখতে হবে। ডাবের খোসা, কোমল পানীয়ের ক্যান, ফুলের টব—এসব স্থানে যাতে পানি জমে না থাকে, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। মজা পুকুর বা ডোবা পরিষ্কার করতে হবে। ডেঙ্গু জ্বরের বেলায় স্বচ্ছ, পরিষ্কার পানিতে এডিস মশা বংশবিস্তার করে, কিন্তু চিকুনগুনিয়ায় মশা নোংরা-অপরিষ্কার পানিতেও ডিম পাড়তে পারে। তাই পানি জমে থাকে এমন সব জায়গাই পরিষ্কার রাখতে হবে। এ ছাড়া মসকুইটো রিপেলেন্ট ব্যবহার করা যেতে পারে, যাতে মশা কাছে না আসতে পারে। বাইরে যাওয়ার সময় শরীর ভালোভাবে ঢেকে রাখতে হবে, যাতে মশা কামড়াতে না পারে। ঘরে ঘরে মশার ওষুধ দেওয়া, দরজা-জানালায় নেট লাগানো, রাতে মশারি ব্যবহার ইত্যাদিও চলবে। জেনে রাখা ভালো, এডিস মশা দিনের বেলা এবং ঘরের বাইরেই বেশি কামড়ায়। কিছু কিছু মিডিয়া বা পত্রপত্রিকায় আজকাল আবার প্রচার করা হচ্ছে যে এ ধরনের রোগীকে ডাক্তাররা ‘ভুল করে’ ডেঙ্গুর চিকিৎসা দিচ্ছেন। আসলে এখানে ভুল করার কিছু নেই। ডেঙ্গুর চিকিৎসা এবং চিকুনগুনিয়ার চিকিৎসা প্রায় একই রকম এবং এতে রোগীর কোনো সমস্যা হবে না বরং ভাইরাস সুনিশ্চিতভাবে নির্ণয় করে চিকিৎসা করতে গেলে যেসব ব্যয়বহুল পরীক্ষা করতে হবে, তা অনেক দরিদ্র রোগীই করতে পারবে না—এর প্রয়োজনও নেই। এতে চিকিৎসার ক্ষেত্রেও কোনো অতিরিক্ত সুফল পাওয়া যাবে না। রোগটি নতুন হলেও এতে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। এতে কেউ মারা যায় না। হয়তো বা কিছুদিন একটু ভোগান্তি বাড়ায়। একটু সচেতন হলেই এ রোগ মোকাবিলা করা সম্ভব।
এ বি এম আবদুল্লাহ
ডিন, মেডিসিন অনুষদ
অধ্যাপক, মেডিসিন বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
ছবি: সৈকত ভদ্র
জ্বর এলেই সচেতন হতে হবে। প্রতীকী এ ছবিটির মডেল হয়েছেন লিপি ও তাঁর মেয়ে নোহা।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ডিসেম্বর ২১, ২০১১
Leave a Reply