এপেনডিক্স, পায়ুপথ ও বৃহদান্ত্রের ক্যানসারকে কোলোরেক্টাল ক্যানসার বলা হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এরা আপাতদৃষ্টিতে নির্দোষ—এমন কিছু পলিপ থেকে তৈরি হয়। আঙুরের খোসার মতো এ পলিপগুলো বৃহদান্ত্রে আগে থেকেই থাকতে পারে। কেবল যুক্তরাষ্ট্রেই প্রতিবছর এ রোগে প্রায় দেড় লাখ মানুষ আক্রান্ত হয় এবং প্রায় ৫০ হাজার মানুষ এতে মারা যায়। ক্যানসারে মৃত্যুর দিক দিয়ে এর অবস্থান নবম। জাতীয় পর্যায়ে তথ্যের অপ্রতুলতার কারণে বাংলাদেশে এ রোগসম্পর্কিত সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। আমাদের দেশে সবচেয়ে বেশি হওয়া ক্যানসারের মধ্যে প্রথম পাঁচটির একটি এই কোলোরেক্টাল ক্যানসার।
আপনি কি কোলোরেক্টাল ক্যানসারের ঝুঁকিতে আছেন?
বয়স: কোলোরেক্টাল ক্যানসার যেকোনো বয়সেই হতে পারে। তবে এ রোগে আক্রান্ত প্রতি ১০ জনের ৫০ বছর বা এর চেয়ে বেশি বয়সে এ রোগ হতে পারে।
লিঙ্গ: পুরুষ ও মহিলা উভয়েই এ রোগে আক্রান্ত হতে পারেন।
ধূমপান ও অ্যালকোহলের ব্যবহার: সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, ধূমপায়ীরা অধূমপায়ীদের চেয়ে ৩০-৪০ ভাগ বেশি কোলোরেক্টাল ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকিতে থাকেন। অ্যালকোহল ব্যবহারকারীদের মধ্যেও এ রোগ হওয়ার ঝুঁকি বেশি।
অন্ত্রের অন্যান্য অসুখ: আগে থেকেই অন্ত্রের অন্য কোনো অংশে থাকা ক্যানসার বা পলিপ অথবা অন্ত্রের অন্যান্য রোগ, যেমন মলাশয়ে আলসার তৈরি করে এমন প্রদাহ, অন্ত্রের প্রদাহ—এ রকম কিছু কারণে কোলোরেক্টাল ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
বংশগত: বংশগত কারণও কোলোরেক্টাল ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। মা-বাবা, ভাইবোনের কারোর ৬০ বছর বয়সের নিচে অন্ত্রের পলিপ বা ক্যানসার থাকলে অথবা যেকোনো বয়সে যেকোনো দুজনের এ ধরনের সমস্যা থাকলে আপনি কোলোরেক্টাল ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকিতে আছেন।
কোলোরেক্টাল ক্যানসারের লক্ষণ:
মলত্যাগের অভ্যাসের পরিবর্তন
ডায়রিয়া বা কোষ্ঠকাঠিন্য অথবা পর্যায়ক্রমে ডায়রিয়া ও কোষ্ঠকাঠিন্য
মলের সঙ্গে রক্ত মিশে থাকে
ওজন কমে যায়
দুর্বলতা
পেটে অস্বস্তিভাব—যেমন গ্যাস, পেট ফুলে থাকা, পেট ভর্তি ভাব, কামড়ানো প্রভৃতি
রক্তশূন্যতা
রোগের শেষপর্যায়ে মলত্যাগ করতে না-পারা বা অন্ত্রনালি বন্ধ হয়ে যাওয়া।
যদি কেউ বেশ কয়েক দিন ধরে এ ধরনের লক্ষণে ভোগেন, তবে আপনার চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
কীভাবে এ রোগের চিকিৎসা করা হয়:
শুরুতেই ধরা পড়লে এ রোগের যথাযথ চিকিৎসা করা সম্ভব। কোলোরেক্টাল ক্যানসার নিরাময়ে শল্যচিকিৎসা, রেডিয়েশন, কেমোথেরাপি বা ইমিউনোথেরাপি—এর যেকোনোটি বা কয়েকটি একসঙ্গে ব্যবহার করা হতে পারে। এ রোগের চিকিৎসায় শল্যচিকিৎসাই প্রথমে করা হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সার্জারির আগে রেডিয়েশন কেমোথেরাপি দেওয়া হতে পারে। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় কোলোরেক্টাল ক্যানসারের চিকিৎসায় অনেক অগ্রগতি সম্ভব হয়েছে। এর পাশাপাশি নতুন চিকিৎসাপদ্ধতি যেমন ভ্যাকসিন, অ্যান্টিবডি ব্যবহার, জিনথেরাপি, টিউমারের রক্ত চলাচলে বাধা দেওয়া—এ রকম নানা পদ্ধতির মাধ্যমে কোলোরেক্টাল ক্যানসারের চিকিৎসার সম্ভাব্যতা যাচাই করা হচ্ছে।
কোলোরেক্টাল ক্যানসার নির্ধারণে স্কিনিং:
কোলোরেক্টাল ক্যানসার স্ক্রিনিং আমাদের জীবন বাঁচাতে দুভাবে সাহায্য করতে পারে—
ক্যানসারে পরিণত হতে পারে, এমন পলিপ খুঁজে বের করা এবং সঠিক সময়ে তা অপসারণ করা।
শুরুতেই ক্যানসার খুঁজে বের করে যথাসময়ে এর চিকিৎসা করা।
৫০ বছর বা তদূর্ধ্ব সব পুরুষ ও মহিলারই এ রোগ নির্ধারণের জন্য নিয়মিত স্ক্রিনিং করা প্রয়োজন। যাঁদের এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি, তাঁদের আরও কম বয়স থেকেই স্ক্রিনিং করানো উচিত।
কোলোরেক্টাল ক্যানসার স্ক্রিনিংয়ে পরীক্ষাগুলো কী কী?
ঠিক কত দিন পর পর বা কোন কোন পরীক্ষার মাধ্যমে এ রোগের স্ক্রিনিং করতে হবে, এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞরা একমত না হলেও কিছু কিছু পরীক্ষার ব্যাপারে সব ক্ষেত্রেই দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। প্রতিবছর মল পরীক্ষা, নিয়মিতভাবে সম্পূর্ণ অন্ত্রের পরীক্ষা, প্রতিবছর ৩০ হাজার পর্যন্ত লোকের জীবন বাঁচাতে সহায়ক হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মত প্রকাশ করেছেন।
কাদের স্ক্রিনিং করতে হবে:
৫০ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সের ব্যক্তিদের জন্য কোলরেস্টাল ক্যানসারের সম্ভাবনা যাচাই করা নিয়মিত স্বাস্থ্যসেবার অংশ হওয়া উচিত। যাঁরা বংশগতভাবে বা ব্যক্তিগত অভ্যাসের কারণে অধিক ঝুঁকিতে আছেন, তাঁদের আরও আগে থেকেই পরীক্ষা করানো উচিত। আপনি যদি অধিক ঝুঁকিতে থাকেন, তবে রোগ নির্ণয়ের সঠিক পথ নির্ধারণের জন্য আপনার চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
কোলোরেক্টাল ক্যানসার স্ক্রিনিং কম হওয়ার পেছনে দায়ী
এ রোগ সম্পর্কে গণসচেতনতার অভাব এবং নিয়মিত পরীক্ষা করার উপকারিতা সম্পর্কে না জানা।
স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী সংস্থার অনিয়মিত প্রচারণা।
কীভাবে স্ক্রিনিং করতে হয়, সঠিকভাবে তা না জানা।
এ রোগ সম্পর্কে আলোচনায় অনীহা বা সংকোচ।
মোহাম্মদ আবদুল হাই
প্রধান, ক্যানসার সেন্টার, খাজা ইউনুস আলী মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতাল।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, আগস্ট ০৩, ২০১১
Leave a Reply