প্রথম আলো গোলটেবিল বৈঠক
যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম: অগ্রগতি ও করণীয়
গত ২৪ মার্চ ছিল বিশ্ব যক্ষ্মা দিবস। দিবসটি সামনে রেখে বাংলাদেশে যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির অগ্রগতি ও করণীয়বিষয়ে স্বাস্থ্যকুশলের উদ্যোগে গোলটেবিলবৈঠকের আয়োজন করা হয়। ব্র্যাকের সহযোগিতায় আয়োজিত সেই গোলটেবিল বৈঠকের আলোচনা নিয়েই এবারের স্বাস্থ্যকুশল।
যাঁরা অংশ নিলেন
ডা. মো. আশেক হোসেন
প্রোগ্রাম ম্যানেজার, জাতীয়যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, মহাখালী, ঢাকা।
মোজাফফর হোসেন পল্টু
সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট, চেয়ারম্যান
সাউথ ইস্ট এশিয়ান রিজিওন, আইইউএটিএলডি, নাটাব।
ডা. এ কে এম মোস্তফা হোসেন
পরিচালক, জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল
মহাখালী, ঢাকা।
ফারুক আহমেদ
পরিচালক, ব্র্যাক স্বাস্থ্যকর্মসূচি।
ডা. মির্জা নিজামউদ্দিন
ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার (টিবি), জাতীয়যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি।
ডা. কে জামান
জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী/এপিডেমিওলজিস্ট, আইসিডিডিআরবি, মহাখালী।
ড. মো. আকরামুলইসলাম
প্রোগ্রাম হেড, ব্র্যাক স্বাস্থ্য কর্মসূচি।
ডা. অং ক্য জাই মগ
ডেমিয়েন ফাউন্ডেশন, বনানী, ঢাকা।
ডা. সাবেরা সুলতানা
ন্যাশনাল প্রফেশনাল অফিসার, বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা।
ডা. মাহফুজা রিফাত
প্রোগ্রাম ম্যানেজার (টিবি), ব্র্যাক।
সঞ্চালক
আব্দুলকাইয়ুম
যুগ্ম সম্পাদক, প্রথম আলো।
ডা. ইকবাল কবীর
বিভাগীয়সম্পাদক, স্বাস্থ্যকুশল, প্রথম আলো।
আব্দুল কাইয়ুম
আজকে আমাদের আলোচ্য বিষয় হচ্ছে ‘যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম: অগ্রগতি ও করণীয়’। বিশ্ব যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ দিবস উপলক্ষকে সামনে রেখে ব্র্যাকের সহযোগিতায় এবং প্রথম আলোর স্বাস্থ্যকুশল পাতার যৌথ উদ্যোগে আমরা এই আয়োজন করেছি। আমরা গত বছরও এ রকম একটি আয়োজন করেছিলাম। প্রথম আলো যে গোলটেবিল আয়োজন করে, তার কয়েকটি প্রধান দিক আছে। একটি হলো অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক বিষয়, যেগুলো আমাদের দেশের মানুষের আলোচ্য বিষয় হয়। আর অন্যদিকে আমরা স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও অন্যান্য সামাজিক বিষয় নিয়েও গোলটেবিল বৈঠক করি। এটার প্রধান উদ্দেশ্য হলো জনসচেতনতা সৃষ্টি এবং আমাদের সমাজটাকে আরও অগ্রসর করা। যক্ষ্মার বিষয়টি আমরা এ জন্য গুরুত্ব দিই, কারণ যক্ষ্মায় আক্রান্তের হার আমাদের দেশে অনেক বেশি। ১৯৯০ সালে যক্ষ্মায় মৃত্যুর হার ছিল লাখে ৭৬ জন এবং তখন একটি পরিকল্পনা নেওয়া হয়, এই লক্ষ্যমাত্রা আমরা ২০১৫ সালে অর্ধেক কমিয়ে আনব। ইতিমধ্যে আমরা বেশ কিছুটা নামিয়ে এনেছি। ২০০৯ সালে এক হিসাবে দেখেছি, লাখে ৪৫ জনে নামিয়ে এনেছি। আমরা আশা করি, এই লক্ষ্য অর্জন করা খুব কঠিন হবে না। মানুষের সচেতনতাও এখানে একটি বড় ব্যাপার। আমাদের আরও যেটা করতে হবে, শুধু মৃত্যুহার নয়, এটার সংক্রমণের হারও কমিয়ে আনতে হবে। আমরা এটা কমিয়ে আনছি কিন্তু এ জন্য একটা জাগরণ দরকার। আমরা মনে করি, পত্রিকা হিসেবে আমাদের একটি বড় ভূমিকা আছে জনসচেতনতা সৃষ্টি এবং এ কথাগুলো মানুষের কাছে নিয়ে যাওয়ার। এ সভা পরিচালনা করবেন আমাদের স্বাস্থ্য পাতার দায়িত্বপ্রাপ্ত ডা. ইকবাল কবীর।
ইকবাল কবীর
প্রথমে যক্ষ্মা নিয়েএকটি ছোট উপস্থাপনা করবেন ব্র্যাকের সাইদুর রহমান।
সাইদুর রহমান
এবারের বিশ্ব যক্ষ্মা দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে ‘ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় যক্ষ্মামুক্ত দেশ গড়ি’। একসময় আমরা জানতাম, যক্ষ্মা নির্মূল সম্ভব নয়। এখন আমাদের একটি উদ্দেশ্য হচ্ছে যক্ষ্মামুক্ত পৃথিবী গড়ব। এই যক্ষ্মামুক্ত পৃথিবী গড়ার জন্য দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হবে, যাতে একবিংশ শতাব্দীতে কেউ যক্ষ্মায় মারা না যায়, যাতে ২০১৫ সালের মধ্যে সব যক্ষ্মা রোগীর চিকিৎসা নিশ্চিত করা যায়। ২০১৫ সালের মধ্যে সব এইচআইভি-আক্রান্তের টিবি পরীক্ষা করা এবং চিকিৎসা প্রদান করাও আমাদের উদ্দেশ্য।
উন্নত ও মানসম্পন্ন যক্ষ্মার সেবা সম্প্রসারণ করা, টিবি-এইচআইভি, এমডিআর টিবি এবং ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর মাঝে যক্ষ্মা কার্যক্রম, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা পর্যায়ে স্বাস্থ্যগত উন্নয়ন, সব ধরনের স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীকে যক্ষ্মা কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা, সাধারণ জনগণকে যক্ষ্মাবিষয়ক কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা এবং যক্ষ্মাবিষয়ক গবেষণা যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত। আমরা জানি, যক্ষ্মা একধরনের জীবাণু দ্বারা হয়ে থাকে। দুই ধরনের যক্ষ্মা আছে, একটা হচ্ছে ফুসফুসের যক্ষ্মা, আরেকটি হচ্ছে ফুসফুসবহির্ভূত যক্ষ্মা। বাংলাদেশে যক্ষ্মা রোগ একটি মারাত্মক জনস্বাস্থ্য সমস্যা। ২০১০ সালে জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির মাধ্যমে এক লাখ ৫৮ হাজার ২৩৭ জন যক্ষ্মা রোগী শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে আক্রান্ত যক্ষ্মা রোগী শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে কফে আক্রান্ত যক্ষ্মা রোগী শনাক্ত হয়েছে এক লাখ পাঁচ হাজার ৬২৩ জন, যেটা শতকরা ৭০ ভাগ। ২০০৯ সালে জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের মাধ্যমে শতকরা ৯২ জন রোগী আরোগ্য লাভ করেছে। আমাদের জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির লক্ষ্য হচ্ছে, কফে যক্ষ্মা জীবাণুযুক্ত রোগী কমপক্ষে শতকরা ৭০ শনাক্তকরণ এবং শনাক্তকৃত রোগীদের মধ্যে কমপক্ষে শতকরা ৮৫ ভাগ রোগীর আরোগ্য লাভ করা।
২০১৫ সালের মধ্যে যক্ষ্মা রোগীর সংখ্যা এবং যক্ষ্মার মৃত্যু অর্ধেকে নামিয়ে আনব। শতকরা ৭০ রোগী শনাক্ত করার লক্ষ্য ২০০৬ সালে অর্জন করা হয়েছে। শতকরা ১০০ ভাগ ডটস সম্প্রসারণ ২০০৭ সালে অর্জিত। সারা দেশে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ৪৪টি বক্ষ্যব্যাধি ক্লিনিক, আটটি বক্ষব্যাধি হাসপাতাল, চারটি বিভাগীয় বক্ষব্যাধি হাসপাতাল, বিভিন্ন আরবান ক্লিনিক, মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সামরিক হাসপাতাল, জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট হাসপাতাল, জেলা সদর হাসপাতাল এবং ওয়ার্ক প্লেস যেমন—ইপিজেড, বিজিএমইএ এবং অন্যান্য শিল্পপ্রতিষ্ঠান, জেলখানা—এসব স্থানে বিনা মূল্যে যক্ষ্মা রোগের চিকিৎসা ও কফ পরীক্ষা করা হয়। ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশ প্রথম ডটস পদ্ধতি গ্রহণ করে। ১৯৮৪ সালে ব্র্যাক প্রথম একটি উপজেলায় এই যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি শুরু করে এবং পরে ১০টি উপজেলায় সম্প্রসারণ করা হয় ১৯৯২ সালে। বর্তমানে ব্র্যাক ৪২টি জেলায় ২৯৫টি উপজেলায় কাজ করছে। ৩৭টি জেলা শহরে, পাঁচটি বিভাগীয় শহরে, ২৪টি ইনস্টিটিউশনে, ইপিজেডসহ বিভিন্ন শিল্পকারখানা চট্টগ্রাম ও খুলনায়। মোট জনসংখ্যা কাভার করেছে নয় কোটি ১০ লাখ। একজন রোগী যদি নিয়মিত যক্ষ্মার চিকিৎসা নেয় এবং ওষুধ সেবন করে, তাহলে সম্পূর্ণ সুস্থ হতে পারবে এবং স্বাভাবিক কাজকর্ম চালিয়ে যেতে পারবে। পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে, তবে দামি খাবার খেতে হবে এমন কোনো কথা নেই।
ইকবাল কবীর
ধন্যবাদ সাইদুর রহমানকে। আমরা মোটামুটি একটি চিত্র পেলাম। যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমটা আমাদের দেশে অনেক দিন থেকে চলছে। এর অগ্রগতিও আছে। আমাদের অনেক অর্জনও আছে। জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. আশেক হোসেন অগ্রগতি ও সামনে করণীয় সম্পর্কে এবার ধারণা দেবেন।
আশেক হোসেন
১৮৮২ সালে রবার্ট কচ প্রথমে টিবি জীবাণু আবিষ্কারের ঘোষণা করেন। ঠিক এর ১৮০ বছর পর বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা এই দিনকে বিশ্ব যক্ষ্মা দিবস হিসেবে ঠিক করে, যার মূল বিষয় হচ্ছে জনগণকে সচেতন করা। যক্ষ্মা-অধ্যুষিত ২২টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৬ নম্বরে। বাংলাদেশ সরকার, ব্র্যাক, এনজিও এবং অন্যান্য যে সুশীল সমাজ—সবাই একসঙ্গে নিয়ে কাজ করতে চাই। এবারকার স্লোগান হচ্ছে ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসে যক্ষ্মামুক্ত দেশ গড়ি। এখন আমাদের অর্জন কী? ১৯৯৫ সালে ডটস কাভারেজ ছিল ৪১%, এখন ২০১০ সালে ডটস কাভারেজ হচ্ছে ১০০%। সুতরাং আমরা এখানে বিশাল একটা অর্জন করেছি। ১৯৯৫ সালে শনাক্তকরণ রোগী ছিল ১৬%, এখন শনাক্তকরণ রোগী হচ্ছে ৭৪%। ১৯৯৫ সালে আরোগ্য ছিল ৭০%, এখন আরোগ্য হলো ৯২%। আমরা সব দিক দিয়ে সফলতা অর্জন করছি, কিন্তু আমাদের চ্যালেঞ্জ আছে। এখন আমাদের কৌশল কী? আমাদের কৌশল হলো ডটস স্ট্রাটেজি। সরাসরি পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে ওষুধ সেবন। এখানে এসে কিছু চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছি আমরা। এসব মোকাবিলা করে যদি আমরা এগিয়ে যেতে পারি, তাহলে যক্ষ্মামুক্ত দেশ অর্জন আমাদের জন্য কঠিন হবে না।
ইকবাল কবীর
কমিউনিটিভিত্তিক চিকিৎসা নিয়ে এখন আলোচনা করবেন ডা. মাহফুজা রিফাত।
মাহফুজা রিফাত
কমিউনিটিভিত্তিক চিকিৎসার কারণেই কিন্তু আজকে আমাদের এত বড় একটি অর্জন সম্ভব হয়েছে। ব্র্যাকের অভিজ্ঞতা থেকে আমি বলি, ব্র্যাক ১৯৮৪ সালে একটি প্রাইমারি প্রকল্প নিয়েছিল। যেখানে মূল বিষয় ছিল কমিউনিটির লোকজন কীভাবে যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণে সম্পৃক্ত হতে পারেন। ফলে আমরা রোগীদের কাছে পৌঁছাতে পারি। এখন আমাদের জন্য কিছু সহজ বার্তা আছে। তিন সপ্তাহের বেশি কাশি হলে কফ পরীক্ষা করানো। তারা কাশি পরীক্ষাটি নিকটস্থ কমিউনিটি সেন্টারে করাতে পারছেন। আবার সে যদি যক্ষ্মা রোগী হয়, তাহলে যে কথাটি বলা হয়েছে, কারও সামনে ওষুধ খেতে হবে প্রতিদিন নিয়মিত। ওই কমিউনিটিরই স্বাস্থ্য সেবিকার সামনে থেকে সে ওষুধ খাবে। তাতে তার কষ্ট কমছে এবং একজনের তত্ত্বাবধানে ওষুধ খেতে পারছে। তাই চিকিৎসাসেবাটা দিন দিন বেড়েছে। এ ছাড়া কমিউনিটির অন্য মেম্বারদেরও যুক্ত করা হচ্ছে বিভিন্নভাবে। আমরা ২০০৮ সাল থেকে এবং অন্যান্য এনজিও এবং সরকার যে কাজটি করেছে, অন্যান্য লোকের সংযুক্ত করার চেষ্টা, এতে রোগী শনাক্তকরণটা বেড়েছে এবং যক্ষ্মা রোগী শনাক্তের হারও বেড়েছে।
ইকবাল কবীর
আমাদের এখানে উপস্থিত আছেন ডেমিয়ান ফাউন্ডেশনের ডা. অং ক্য জাই মগ। তাঁর অভিজ্ঞতার কথা শুনব এখন।
অং ক্য জাই মগ
আমরা আসলে ১৩টি জেলায় ১০১টি উপজেলা কমিউনিটি লেভেলে কাজ করছি, ১৯৯১ সাল থেকে। আমরা আমাদের উদ্যোগে আমাদের কাজের এলাকায় যত সরকারি-বেসরকারি লোকজন আছেন, যাঁরা এই কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত, তাঁদের ট্রেইনআপ করেছি। পল্লি ডাক্তার যাঁরা আছেন তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, তাঁদেরও আমরা ট্রেইনআপ করিয়েছি। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, যেসব টিবি রোগী আমাদের কাছ থেকে চিকিৎসা নিয়েছে, তারা যদি কমিউনিটির সবাইকে বলে তাদের অভিজ্ঞতার কথা, তাহলে সবাই সেটা বিশ্বাস করবে। আমরা এ বিষয়েও কাজ করছি। আরেকটি বিষয় দেখলাম, ১৯৯৫ সালে ৩৪% ড্রপআউট ছিল। এখন এটা আমরা পাচ্ছি ১০%। এ সংখ্যাটি স্থিতিশীল অবস্থায় থাকবে বলে আমরা মনে করি। এখন রোগীরা সরাসরি আমাদের প্রোগ্রামে চলে আসে যক্ষ্মা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য।
ইকবাল কবীর
ধন্যবাদ, একটি বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো ফিল্ডে ল্যাব ডায়াগনসিস।
এ বিষয়ে বলবেন ডা. সাবেরা।
সাবেরা সুলতানা
আমাদের অগ্রগতি সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় হয়েছে। ডব্লিউএইচও আসলে জাতীয় যক্ষ্মা কার্যক্রমের আওতাভুক্ত সবাইকে টেকনিক্যাল সাপোর্ট দিয়ে আসছে। বিভিন্ন ধরনের পলিসি ও স্ট্রাটেজিক গাইডলাইন ডেভেলপমেন্টে সহযোগিতা করছে। ২০০৭ ডব্লিউএইচও বাংলাদেশে প্রথম ন্যাশনাল টিবি রেফারেন্স ল্যাবরেটরি তৈরি করতে সহযোগিতা করেছে। যে ল্যাবরেটরি নেটওয়ার্ক সিস্টেম আছে, তার মধ্যে হচ্ছে ন্যাশনাল টিবি রেফারেন্স ল্যাবরেটরি। রিজিওনাল রেফারেন্স ল্যাবরেটরি। বাংলাদেশে যে ল্যাবরেটরি নেটওয়ার্ক আছে, তাতে এক হাজার ৫০টা ল্যাব আছে। পেরিফিরাল ল্যাবরেটরি আমাদের এনজিওদের সহযোগিতায় পরিচালিত হয়ে থাকে। সুতরাং উপজেলা থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায়ের সব ল্যাবরেটরির কোয়ালিটি মেইনটেইন পলিসি আছে এবং গাইডলাইন আছে এবং একটি সুনির্দিষ্ট সিস্টেম চালু আছে।
ইকবাল কবীর
এবার ডা. মির্জা নিজামউদ্দিন বলবেন।
মির্জা নিজামউদ্দিন
ল্যাবরেটরি সিস্টেম সম্পর্কে আমরা এতক্ষণ শুনলাম। জাতীয় পর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে যদি রোগীদের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পাঠানো যায়, তাহলেই সফলতা আসবে। তাড়াতাড়ি শনাক্ত করে যক্ষ্মা রোগীকে দ্রুত চিকিৎসা দেওয়াই হলো একমাত্র সমাধান। এখানে চিকিৎসাই হচ্ছে মূল মন্ত্র। যে চিকিৎসা যত তাড়াতাড়ি করতে পারবে, আক্রান্তের সংক্রমণের হার তত তাড়াতাড়ি কমাতে পারব। সংক্রামণ রোগী শুধু যারা যক্ষ্মা রোগের জীবাণু বহন করছে।
এটা বুঝতে হবে, ইনফেকশন আর ডিজিজ এক জিনিস নয়। এই জিনিসগুলো মানুষকে বোঝাতে হবে। সে ক্ষেত্রে আজকের দিনটি সঠিক দিন—জনগণকে সচেতন করা। এই অনুষ্ঠানটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এই তথ্যগুলো সবাইকে জানানোর চেষ্টা করা। যক্ষ্মা রোগের ভয়াবহতা, তার প্রতিকার, প্রতিরোধ এবং কোথায় কোথায় যক্ষ্মার চিকিৎসা হয়, সেসব জানাতে হবে। আরেকটি হলো যক্ষ্মা রোগ কীভাবে হয়, কীভাবে ছড়ায়, সেগুলোও মানুষকে জানাতে হবে সব রকম উপায়ে।
ইকবাল কবীর
এবার আমরা একটু গবেষণার দিকে আসি। এ ক্ষেত্রে আমাদের অপারেশন রিসার্চগুলো মূলত আইসিডিডিআরবি থেকেই আসে। ডা. জামানকে আমি বলব, টিবিবিষয়ক যে গবেষণাগুলো হয়েছে তার পরিপ্রেক্ষিতে বলতে।
কে জামান
আইসিডিডিআরবি মূলত টিবির গবেষণাকার্যেই যুক্ত। টিবি বাংলাদেশে একটি সাকসেস হিস্টরি। ১৯৬৪-৬৫ সালে বাংলাদেশে ৩১৫ জন রোগী পাওয়া যায় সার্ভে করে। ২০ বছর পর পাওয়া যায় ৮৭০ জন প্রতি এক লাখে। ২০০৭-২০০৯ সালে আমরা আরেকটি সার্ভে করেছিলাম। তখন আমরা পেয়েছি ৭৯ জন প্রতি এক লাখে। আমাদের গবেষণায় দেখা গেছে, পুরুষেরা নারীদের থেকে প্রায় তিন গুণ বেশি আক্রান্ত হয় টিবি রোগে। আর যক্ষ্মা রোগীদের মধ্যে শতকরা ৫% এমডিআর টিবিতে আক্রান্ত আমাদের দেশে। আরেকটি বিষয় হলো প্রায় ৮০% রোগী প্রথমে অন্যান্য ডাক্তার বা ক্লিনিকে যায়, তার পর ডটসে আসে। কী করলে আমরা সামনে আরও অগ্রগতি করব। একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো এমডিআর। তারপর হলো টিবির ওষুধ। এটা অনেক আগেই আবিষ্কৃত হয়েছে কিন্তু সব পর্যায়ে এটা ব্যবহূত হচ্ছে না। এটাও একটা বড় চ্যালেঞ্জ।
এ বিষয়ে নজর দেওয়া উচিত। টিবি রোগীদের মধ্যে বাংলাদেশে ২% চাইল্ডহুড টিবি। এটাও ডায়াগনসিস করা কঠিন। এ বিষয়ে নজর দেওয়া উচিত। আরবান ডটসে কোয়ালিটি মেইনটেইন দরকার। কারণ এত প্রাইভেট ডাক্তার ক্লিনিক, যার ফলে অনেকে ডটসের যে রেজিমেন্ট, এটা অনেকে মানে না।
সবাইকে যদি মেসেজ দিতে চাই, তাহলে বলব, যক্ষ্মা একটি নিরাময় ব্যাধি। তিন সপ্তাহের বেশি কাশি হলে আপনি কফ পরীক্ষা করাবেন। দু-তিন সপ্তাহ পর দেখবেন, আপনার কাশি থেকে জীবাণু ছড়াচ্ছে না এবং শরীরও অনেকটা সুস্থ লাগবে। কিন্তু তার পরও আপনাকে পুরো কোর্সের ওষুধ খেতে হবে। এই মেসেজগুলো যদি আমরা সবাইকে দিতে পারি, তাহলে যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে।
মো. আকরামুল ইসলাম
গ্রাম ও শহর পর্যায়ে দুই জায়গাতেই আমরা প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য সাধারণ ডাক্তারের কাছে যাই। গ্রামে এর হার অত্যন্ত বেশি। তারা সাধারণত সঠিকভাবে এ চিকিৎসা করতে পারে না। তাই গ্রাম পর্যায়ে মৃত্যুহার বেশি। শহরে প্রাইভেট পর্যায়েও সহযোগিতা কম। এটা অত্যন্ত জরুরি, যারা প্রাইভেট সেক্টরে আছেন, তাঁদের এই প্রোগ্রামের আওতায় নিয়ে আসা। আরেকটি বিষয় হলো ধূমপানের সঙ্গে টিবি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যাঁরা ধূমপান করেন, তাঁদের টিবি হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি। এটা আমাদের সব গবেষণায় আসছে। আমি মনে করি, ধূমপান নিয়ন্ত্রণে টিবি প্রোগ্রাম একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এ-বিষয়ক কিছু কাউন্সেলিং করা দরকার। বেশ কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, এর ফলে অনেকেই ধূমপান বন্ধ করে দিয়েছেন।
তাই আমরা ধারণা করছি, যদি টিবি প্রোগ্রামে এ রকম কাউন্সেলিং করা হয়, তাহলে এ সংখ্যা অর্ধেকে নামিয়ে আনা সম্ভব।
ইকবাল কবীর
নাটাবের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণের অগ্রগতিকে আরও কীভাবে সুসংহত করা যায়, সে সম্পর্কে বলবেন মোজাফফর হোসেন পল্টু।
মোজাফফর হোসেন পল্টু
একটা সময় বাংলাদেশে কয়েকটা রোগ খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। তার মধ্যে ছিল কলেরা, বসন্ত ও যক্ষ্মা। যক্ষ্মা প্রতিরোধে তখন আমাদের হাতে কিছুই ছিল না। একটা সময় যক্ষ্মা রোগের ওষুধ বেরোল। আমরা তখন বলতাম, ‘ওষুধ খেলে টিবি সারে’, এখন অবস্থা তো আরও ভালো। ‘যক্ষ্মা হলে রক্ষা নাই, এই কথার ভিত্তি নাই’। এমন অবস্থায় আমরা চলে এসেছি। আমাদের এই অগ্রগতি নিঃসন্দেহে বিরাট অগ্রগতি। সারা দেশে কাজ করতে গিয়ে আমার মনে হয়েছে, জেলা পর্যায়ে সিভিল সার্জনরা কিন্তু এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারেন। আরেকটা ব্যাপার হলো, বিভিন্ন দেশ থেকে শ্রমিকেরা ফেরত আসছেন, তাঁদের মাধ্যমে এ রোগের বিস্তার হওয়ার সুযোগ আছে। এ ক্ষেত্রে সরকারের কিন্তু অনেক কিছু করার আছে। কাজটা করতে হবে আসলে সর্বদলীয়ভাবে। এ রোগটির বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরিতে সরকার তার প্রশাসনকে কাজে লাগাতে পারে। রাজনৈতিক অঙ্গীকার করে কাজ করতে হবে সারা দেশে।
এ কে এম মোস্তফা হোসেন
প্রথম আলোকে এ ধরনের একটি গোলটেবিল আয়োজনের জন্য ধন্যবাদ জানাই। যদি সঠিক চিকিৎসা, সঠিক ডোজ আর খাবার দেওয়া হয়, তাহলে যক্ষ্মাকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তবে অনেক সময় দেখা যায়, নিয়মিত ওষুধ খাচ্ছেন, চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়মিত পালন করছেন, তবু তাঁর যক্ষ্মা সারছে না। অসহায়ের মতো বক্ষব্যাধি হাসপাতালে এলেন। তখন স্ক্রিনিং করে দেখা গেল, তাঁর ডায়াবেটিস আছে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ না করে যক্ষ্মার চিকিৎসা দিলে যক্ষ্মা কখনোই ভালো হবে না। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসকদের আরও সচেতন হতে হবে। চিকিৎসা দেওয়ার আগে রোগীর অন্য কোনো রোগ আছে কি না, তা পরীক্ষা করে নিতে হবে। শহর ও গ্রামের চিকিৎসকদের যক্ষ্মা রোগ সম্পর্কে বিশেষ প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে হবে। তা ছাড়া যক্ষ্মা রোগের ওষুধের অনেক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে। রোগী তাই কিছুদিন ওষুধ খেয়ে বিরক্ত বা আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে পারে। তাই চিকিৎসককে আগে থেকেই রোগীকে বুঝিয়ে বলতে হবে এবং সম্পূর্ণ কোর্স শেষ করার প্রয়োজনীয়তাও তাকে জানাতে হবে। এ ছাড়া স্কুলের শিক্ষক, মসজিদের ইমাম—এঁদেরও প্রশিক্ষণ দিতে হবে, যাতে তাঁরা উপসর্গ দেখে বুঝতে পারেন এবং পার্শ্ববর্তী স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিতে পারেন।
ইকবাল কবীর
কীভাবে এগোলে আমাদের এই অর্জন ধরে রাখতে পারব। এবং যে বাধাগুলো আছে, সেগুলো মোকাবিলা করে যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমকে আরও বেগবান করা যায় কীভাবে, তা নিয়ে বলবেন ফারুক আহমেদ।
ফারুক আহমেদ
ব্র্যাকের মূল কথা হলো দারিদ্র্য বিমোচন ও দরিদ্র মানুষের ক্ষমতায়ন, কিন্তু ব্র্যাক কাজ করতে গিয়ে দেখল, দরিদ্র মানুষের বড় একটা সমস্যা, তা হলো স্বাস্থ্য সমস্যা। ব্র্যাক জনস্বাস্থ্যে যেসব কাজ করে, তার মধ্যে যক্ষ্মা একটি। ব্র্যাকের এই কাজ সফলতার সঙ্গে এগিয়ে চলছে। আরেকটা ব্যাপার হলো, বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার কাঠামো খুবই শক্তিশালী, কিন্তু সেগুলোকে সঠিকভাবে কাজে লাগানো যাচ্ছে না। আরেকটা ব্যাপার হলো, সরকার যখনই যৌথভাবে এ ধরনের কাজ হাতে নিয়েছে, তখন কিন্তু তারা সফলও হয়েছে। ২০০৪ সালের আগে রোগী শনাক্তকরণের হার ছিল ৪০ শতাংশ, এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭০ শতাংশ। আমরা শুধু যক্ষ্মা খাতে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা বাইরে থেকে আনতে সক্ষম হয়েছি। ২০০৪ সাল থেকে শুরু হয়ে খাতটি চলবে ২০১৫ সাল পর্যন্ত। আমরা সফলতার পথেই এগোচ্ছি, কিন্তু সফলতাকে ধরে রাখতে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও সুসংহত করতে হবে। সবাইকে একযোগে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিতে হবে যক্ষ্মা প্রতিরোধে।
আব্দুল কাইয়ুম
আজকের এ গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণের জন্য আপনাদের সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মার্চ ৩০, ২০১১
Leave a Reply