শিশুর জন্মের পর প্রথম কয়েক দিনের মধ্যে হঠাৎ শরীরের যেকোনো স্থান দিয়ে রক্তক্ষরণ হতে পারে। সাধারণত রক্তক্ষরণ ছাড়া শিশুটির অন্য কোনো শারীরিক সমস্যা থাকে না। এটিকে বলে হেমোরেজিক ডিজিজ অব নিউবর্ন বা নবজাতকের রক্তক্ষরণ।
কারণ: নবজাতকের শরীরে ভিটামিন ‘কে’-র অভাবে এ রোগ দেখা যায়। ভিটামিন ‘কে’ আমাদের শরীরে খাদ্যনালিতে এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া দ্বারা তৈরি হয়। শিশুর জন্মের পর এই ব্যাকটেরিয়াগুলো খাদ্যনালিতে জন্মাতে কয়েক দিন লাগে। এ সময়ের মধ্যে যদি ভিটামিন ‘কে’-র মাত্রা যথেষ্ট পরিমাণে কমে যায়, তবেই রক্তক্ষরণের এ সমস্যা দেখা দিতে পারে।
প্রকারভেদ: লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার সময় শিশুর বয়সের ওপর ভিত্তি করে রোগটিকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়—
১. জন্মের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে রক্তক্ষরণ
সাধারণত গর্ভাবস্থায় খিঁচুনি ও যক্ষ্মা রোগের ওষুধ সেবন করলে নবজাতকের এ সমস্যা দেখা দিতে পারে। এ ক্ষেত্রে সাধারণত তীব্র ক্ষরণের আশঙ্কা থাকে, এমনকি মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণও হতে পারে। এ ক্ষেত্রে গর্ভকালীন শেষ দুই থেকে চার সপ্তাহের মধ্যে মাকে ভিটামিন ‘কে’ ইনজেকশন প্রয়োগ করলে শিশুর রক্তক্ষরণ রোগটি প্রতিরোধ করা যায়। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের বিশেষ পরামর্শ নিতে হবে।
২. দ্বিতীয় দিন থেকে এক সপ্তাহের মধ্যে রক্তক্ষরণ
শিশুর সাধারণত অন্য কোনো শারীরিক সমস্যা থাকে না। বুকের দুধ খাওয়ানো হচ্ছে এমন শিশু, যাদের ভিটামিন ‘কে’ খাওয়ানো হয়নি এদের ক্ষেত্রে বেশি লক্ষ করা যায়। রক্তক্ষরণ সাধারণত নাভি থেকে পায়খানার সঙ্গে, নাক দিয়ে বা ইনজেকশনের জায়গায় দেখা যায়। এ ক্ষেত্রে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ সাধারণত হয় না।
৩. বিলম্বিত রক্তক্ষরণ
কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই রক্তক্ষরণের লক্ষণ দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে শুরু করে তিন মাস, এমনকি ছয় মাসের মধ্যে যেকোনো সময় দেখা যেতে পারে। রক্তক্ষরণ শরীরের যেকোনো জায়গা দিয়েই দেখা যেতে পারে। তবে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের আশঙ্কা এ ধরনের রোগীদের ক্ষেত্রেই বেশি থাকে। সাধারণত যেসব শিশু লিভার রোগে আক্রান্ত, দীর্ঘদিন অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে চিকিৎসাধীন, ডায়রিয়া আছে ইত্যাদি ক্ষেত্রে এ ধরনের বিলম্বিত রক্তক্ষরণ হতে পারে।
রোগের উৎপত্তি
আমাদের শরীরে অন্যান্য ভিটামিনের তুলনায় ভিটামিন ‘কে’-র কার্যাবলি কিছুটা ভিন্ন। এই ভিটামিন আমাদের খাদ্যনালিতে এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া দ্বারা তৈরি হয়।
জন্মগতভাবে শিশু মায়ের শরীর থেকে ভিটামিন ‘কে’ কম পেয়ে থাকে এবং এদের লিভারে এই ভিটামিনের মজুদ পর্যাপ্ত থাকে না। ভিটামিন ‘কে’ আমাদের শরীরে রক্ত জমাট বাঁধার জন্য অত্যাবশ্যক কয়েকটি উপাদান সৃষ্টি করে। উপাদানগুলো সৃষ্টির প্রক্রিয়া লিভারে সংঘটিত হয়।
নবজাতকের শরীরে জন্মের পর প্রথম দিনগুলোতে এই ভিটামিনের মাত্রা কম থাকে এবং এই মাত্রা যথেষ্ট কমে গেলে রক্ত জমাট বাঁধার প্রক্রিয়াটি বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে রক্তক্ষরণের লক্ষণগুলো প্রকাশ পায়।
লক্ষণ
শরীরে রক্তক্ষরণ সব সময়ই আতঙ্কজনক একটি ব্যাপার! সাধারণত নাভি দিয়ে, পায়খানার সঙ্গে, নাক দিয়ে, মেয়েশিশুর জননাঙ্গপথে রক্তপাত হতে দেখা যায়। অনেক সময় চামড়ার নিচে রক্তপাতের কারণে লাল লাল দাগ দেখা দিতে পারে, এমনকি রক্ত জমা হয়ে জায়গাটি ফুলে যেতে পারে। তবে সবচেয়ে বিপজ্জনক হলো মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ; যার কারণে শিশু গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হলে শিশু আকস্মিকভাবে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়বে। শিশুর স্বাভাবিক নড়াচড়া কমে অসাড় হয়ে যাবে, বুকের দুধ খাওয়া কমিয়ে দেবে, মাথার তালু ফুলে যেতে পারে, শ্বাসকষ্ট দেখা দিতে পারে, এমনকি খিঁচুনি পর্যন্ত হতে পারে। গুরুতর অসুস্থ হয়ে কোনো কোনো ক্ষেত্রে শিশুকে মৃত্যুবরণ করতেও দেখা যায়।
প্রতিরোধের উপায়
আশার কথা হলো, নবজাতকের এই রক্তক্ষরণ প্রতিরোধে সহজ একটি চিকিৎসাপদ্ধতি বিদ্যমান। সেটি হলো ভিটামিন ‘কে’ ইনজেকশন প্রয়োগের মাধ্যমে। জন্মের পর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে এ ইনজেকশনটি দিতে হয়। ইনজেকশন মাংসপেশিতে একবার প্রয়োগ করলেই যথেষ্ট। তবে মুখে খাওয়ালে তিন ডোজ নিতে হবে। প্রথম ডোজ নিতে হবে জন্মের চার ঘণ্টার মধ্যে। দ্বিতীয় ডোজ চতুর্থ দিনে এবং তৃতীয় ডোজ ২৮তম দিনে।
উল্লেখ্য, ভিটামিন ‘কে’ ইনজেকশন নেওয়ার পরও যদি রক্তক্ষরণের কোনো লক্ষণ দেখা যায়, তবে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
মনে রাখবেন
নবজাতকের রক্তক্ষরণ কখনো কখনো মারাত্মক সমস্যার সৃষ্টি করলেও একটু সচেতন হলে সহজেই এর প্রতিরোধ করা যায়।
মেয়েশিশুর ক্ষেত্রে জন্মের কয়েক দিনের মধ্যে হরমোনজনিত কারণে জননাঙ্গপথে রক্তক্ষরণ হতে পারে, যেটি অস্বাভাবিক নয়। এ ক্ষেত্রে রক্তপাতের পরিমাণ সাধারণত বেশি হয় না। শরীরের অন্য কোনো স্থান দিয়ে রক্তপাত হয় না এবং দু-তিন দিনের মধ্যে আপনা-আপনিই বন্ধ হয়ে যায়। এ জন্য মেয়ে-নবজাতকের ক্ষেত্রে কেবল জননাঙ্গপথে রক্তক্ষরণ হলে কিছুটা ধৈর্য ধারণ করতে হবে।
জন্মের পর যত শিগগির সম্ভব শিশুকে মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানো শুরু করবেন এবং বারবার খাওয়ানোর অভ্যাস করবেন। শিশুর যেকোনো অসুস্থতায় চিকিৎসকের সুনির্দিষ্ট নিষেধাজ্ঞা না থাকলে অবশ্যই বুকের দুধ খাওয়ানো চালিয়ে যাবেন।
অর্জুন চন্দ্র দে
সহকারী অধ্যাপক, নবজাতক বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, শাহবাগ, ঢাকা।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুন ৩০, ২০১০
Leave a Reply