মানবদেহের পুষ্টি চাহিদা সম্পর্কে প্রতিটি মৌসুমে সজাগ দৃষ্টি রাখা একান্ত কর্তব্য। আর গ্রীষ্মের গরমে এ কর্তব্য আরো বেড়ে যায়। উচ্চ তাপমাত্রায় আমাদের খাবার গ্রহণের ব্যাপারে সচেতনতা বাড়াতে হবে। আমাদের পরিষ্কার ধারণা নিতে হবে যে, কোন খাবার গরমে খাদ্য তালিকা থেকে কমিয়ে দিতে হবে অথবা কোন খাবার একেবারেই খাদ্যতালিকা থেকে বাদ দিতে হবে। আমাদের অসচেতনতা বহু রোগের কারণ। কিছু রোগ বা শারীরিক পরিস্থিতি জন্ম থেকে নিয়ে আসে না। শুধুমাত্র অসচেতনতার কারণে শরীরে স্থান পায় ও শরীরে এদের আধিপত্য বিস্তার করে অথ্যাৎ কোন কোন রোগী রোগগুলোর উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। মানুষের অসচেতনতার দরুণ খাদ্য সম্পর্কিত দীর্ঘমেয়াদী রোগ গুলো হলো: (১) শরীরের অতিরিক্ত ওজন (২) ডায়াবেটিস (৩) ইনসুলিন রেসিসাটেন্স (৪) উচ্চ রক্তচাপ (৫) হৃদরোগ।
কোন ব্যক্তি যদি উপরোক্ত যে কোন ১টি বা সবগুলোতে ইতিমধ্যে আক্রান্ত হয় তবে তাদের এই গরমে কিছুটা স্বসি-র জন্য অত্যন- সজাগ হতে হবে কেন না প্রচণ্ড গরমে শরীরের মধ্যে বিভিন্ন পরিবর্তন দেখা যায়। যেমন: ১। দেহে সোডিয়াম কমে যাওয়া ২। পটাসিয়াম কমে যাওয়া ৩। বমি হওয়া ৪। খাদ্য হজম না হওয়া ও পেট ফাপা ৫। ডায়রিয়া ৬। আমশায় ৭। জ্বর।
গরমে এ শারীরিক পরিবর্তন গুলোকে প্রতিরোধ করতে খাবারের গুরুত্ব অপরীসিম। গরমে সঠিক পুষ্টির লক্ষে সুস্বাস্থ্য রক্ষায় সে দিকগুলো খেয়াল রাখতে হবে তা হলো:
১। প্রথম ও প্রধান সাবধানতা হলো বাহিরের খোলা জায়গার পানি, শরবত, আখের রস, পরিহার করা, এগুলো গ্রহণের ফলে সৃষ্ট ডায়রিয়া, আমাশয়, আপনার আর্থিক ব্যায় বৃদ্ধির সাথে সাথে মৃত্যু ঝুঁকিও বহন করে।
২। নিরাপদ বিশুদ্ধ পানি পান করা, ঘরের তৈরী শরবত, পানি জাতিয় শাক সবজি ও ফল বেশী খাওয়া।
৩। উল্লেখ যে, গরমে ডাব, তরমুজ, বাঙ্গি, বেলের শরবত এগুলো পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ভাবে হাত ধুয়ে খাবারের উপযোগী করা।
৪। গরমে মাছ, মাংস, ভূণা, ভাজি, খিচুরী, পোলাও, ফাস্টফুড কমিয়ে পাতলা আম ডাল, পাতলা দুধ, টকদই, করলার বোল তরকারী, লেবু চিনির শরবত, সালাদ, রসালো ফল খাওয়া যেতে পারে।
৫। গরমে সাদা ভাত, পোলাও, বিরানী, খিচুরী পরটা থেকে অনেক বেশী উপযোগী।
৬। যারা নিয়মিত হাঁটেন, তারা শুধুমাত্র সময় পরিবর্তন করলেই চলবে। যেমন সকালে না হেঁটে বিকাল/সন্ধ্যার পর হাঁটা খুব বেশী আরাম দায়ক।
৭। গরমে খুব বেশী হাঁটা, ব্যায়াম অত্যাধিক পরিশ্রম, অত্যাধিক খাদ্য গ্রহণ পরিহার করুন।
৮। পোষাক পরুন আরাম দায়ক। হালকা রং বেছে নিন পোষাকে।
৯। নিজস্ব পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখুন।
১০। মনে রাখবেন গরমে আপনার নিজস্ব পরিচর্যা ও যত্ন আপনাকে সুস্থ্য রাখতে সহায়ক হবে। গরমে থাকা যাবে স্বস্তিতে। প্রতিরোধ করা যাবে ডায়রিয়া, কলেরা ও আমশায়ের মত পানি বাহীত ও খাদ্য বাহীত বিভিন্ন রোগ এমন কি মৃত্যু ঝুঁকিও।
গরমে পুষ্টি: গরমে কিছুটা স্বস্থির জন্য পুষ্টি সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-১। যারা অতিরিক্ত ওজনে ভূগছেন তারা এই গরমে অন্তত: সজাগ হোন পথ্য ও পুষ্টির ব্যাপারে। ওজন কমানোর জন্য গরমকাল সহায়ক। কেন না আপনি যদি উচ্চ ক্যালরি পরিহার করে নিম্ন ক্যালরির খাদ্য গ্রহণ করেন তবে ওজন কমবে। নিম্ন ক্যালরি খাবারের মধ্যে রয়েছে ফল (যেমন: তরমুজ, বাঙ্গি, জাম, জামরুল, ডাব ইত্যাদি) ও সবজি (যেমন- লাউ, পেঁপে, ঝিংগা, কুমড়া ইত্যাদি)। ২। গরমে খাদ্য তালিকায় তেল ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্ক হোন। গরমে তেলের ব্যাবহার একেবারেই কমিয়ে দিন। কেন না ১ গ্রাম তেল শরীরের ভেতর ৯ কিলো ক্যালোরী তাপ উৎপন্ন করে। উচ্চ তাপমাত্রায় ও আদ্রতায় শরীরের তাপ বাইরে বেরোতে পারে না। ফলে শরীরের তাপমাত্রা বাড়ে। এই গরমে বয়স্ক ও অতিরিক্ত ওজন ব্যক্তিদের হিট স্ট্রোকের সম্ভাবনা বাড়ে। তাই অন-ত: এই গরমে তেলের ব্যবহার কমিয়ে দেখুন আপনার ৩টি উপকার নিশ্চিত হবে।
(ক) কম তেলে খাবার খেয়ে আপনি স্বসি- বোধ করবেন, হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি কমবে
(খ) আপনার অতিরিক্ত ওজন কমবে,
(গ) দ্রব্যমূল্য উর্ধগতির সাথে তাল মিলানো যাবে অর্থাৎ তেল কেনার খরচ কমবে।
ইদানিং “কোলেস্টেরল ফ্রি” তেলের প্রচারণা বেড়েছে। এক্ষেত্রে আপনার নিজস্ব বৃদ্ধি যাচাই করুন। উদ্ভিদ উৎস হতে আসা তেলে প্রাকৃতি গত ভাবেই কোন কোলেস্টেরল থাকে না। এটি তেলের নিজস্ব বৈশিষ্ট। বিশেষ ভাবে উদ্ভিজ তেলকে কোন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির মাধ্যমে কোলেস্টেরল ফ্রি করা হয়নি। কোলেস্টেরল ফ্রি তেলের প্রচারনায় সাধারণ মানুষ মনে করে তেল খেলে কোন ক্ষতি নেই কিন্তু এ কথা পরিষ্কার ভাবে বুঝতে হবে। ১ চা চামচ (৫ এম. এল) তেল = ৪৫ ক্যালরি, ১ চা চামচ (৫ এম. এল) ঘি = ৪৫ ক্যালরি, ১ চা চামচ (৫ এম. এল) সরিষা তেল = ৪৫ ক্যালরি, ১ চা-চামচ (৫ এম. এল) সয়াবিন তেল = ৪৫ ক্যালরি, কোলেস্টেরল ফ্রি হোক বা না হোক ৫ এম. এল তেল বা ঘি এর ক্যালরি মূল্য কিন্তু একই। অতিরিক্ত গ্রহনের ফলে আপনার শরীরের ওজন বৃদ্ধি পাবে যা আপনার হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়াবে। ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকিতো রয়েছেই। তাই নিদিষ্ট পরিমাণের বেশি কোন ভাবেই যে তোলই হোক না কেন তা গ্রহণ করা যাবে না। আমরা আসলে জানি কি প্রতিদিন প্রাপ্তবয়স্ক একজন মানুষের কতটুকু তেলের প্রয়োজন। প্রাপ্তবয়স্ক = ২০ গ্রাম ভিজিটেবল ফ্যাট, গর্ভবতী মা ৩০ গ্রাম ভিজিটেবল ফ্যাট, দুগ্ধদানকারী মা ৪৫ গ্রাম ভিজিটেবল ফ্যাট, [উৎস: আই.সি.এম.আর]
এই গরমে এখনই নিয়ন্ত্রণ করুন:
১. অতিরিক্ত তেল গ্রহণ
২. ডুবো তেলে ভাজা খাবার
৩. ঘি, মাখন, পনির, মেয়নেজ, ফাস্টফুড
৪. কোল্ডড্রিংক্স
৫. পোলাও, কাচ্চি, গরু ও খাশীর মাংস
৬. ভূনা খাবার
৭. অতিরিক্ত মিষ্টি খাবার
৮. অতিরিক্ত গরম ও ঠান্ডা খাবার।
গ্রহণ করুন:
তেল ১। অল্প তেলে রান্না খাবার। প্রতিদিন ৩টির বেশ তরকারী গ্রহণ করবেন না। কারণ খাদ্য তালিকায় রান্না করা খাবার যত বাড়াবেন তত বেশী তেল খাওয়া হবে তত বেশী পেট ভরে খাওয়া হবে, তাই সাদা ভাতের সাথে করলা ভাজি, পাতলা আম ডাল ও মাছ/মুরগীর ঝোল তরকারী যথেষ্ট। সাথে সালাদ লেবু, রসালো ফল ও টকদই রাখতে পারেন। তাজা খাবার গ্রহণ করুন, বাসী খাবার পরিহার করুন। উদাহরণ: ৪ সদস্য বিশিষ্ট প্রতিটি পরিবার এই গরমে দিনে ৩-৪ টেবিল চাচম অর্থাৎ ৬০ এম এল তেল ব্যবহার করুন। খাবারের বৈচিত্র যাই হোক না কেন তেলের ব্যবহার ৬০ এম এল অতিক্রম করবেন না। কারণ শুধু তেল থেকে ক্যালরি পাচ্ছে ৬০x৯ = ৫৪০। গরমে এটিই যথেষ্ট নয় কি? মাসের তেলের মোট ব্যবহার হওয়া উচিত ১৮০০ এম এল. প্রায় ২ লিটার। পাশাপাশি তেল খরচও কমে গেল। অবশ্য শিশু ও গর্ভবতী মা, দুগ্ধদানকারী মায়েদের জন্য পরিমান কিছুটা বাড়াতে হবে। আমাদের দেশে অনেক পরিবার মাসে ১০ লিটার থেকে ১৫ লিটার পর্যন্ত তেল গ্রহণ করে থাকে। এতে আপনার পরিবারের সদস্যদের গরমে অস্বসি-র পাশাপাশি শরীরে ওজন বেড়ে যাওয়া, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ সবশেষে কিডনি পর্যন্ত অকেজো হবার ঝুঁকি থাকে। এই গরম থেকেই কম তেলের ব্যবহার শুরু করলে আস্তে আস্তে অভ্যস্ত হবে, লাভবান হবেন:- গরমে স্বস্থি, রোগ প্রতিরোধ, চিকিৎসা ব্যয় কমানো।
২। কোমল পানীয়ের পরিবর্তে ডাবের পানি গ্রহণ করুন।
৩। ফ্রিজ ঠান্ডা তরল খাবেন না। এতে গরমে অস্বসি- আরো বাড়বে। ৪। তরমুজের শরবত বাঙ্গির শরবত, টকদইয়ের শরবত, বেলের শরবত পান করুন।
প্রেটিন: ৫। মনে রাখবেন শরীরে প্রোটিনের চাহিদা অত্যন- গুরুত্বপূর্ণ। সুস্থ্য প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির প্রতি কেজি শরীরের ওজনের জন্য ১ গ্রাম প্রোটিন ধার্য্য করা হয়েছে। অর্থাৎ ৬০ কেজি শরীরের ওজনের জন্য ৬০ গ্রাম প্রোটিন প্রয়োজন। [কিডনি রোগ ব্যতিত] গরমে মাংস (গরু, খাসী) পরিহার করে এর পরিবর্তে ছোট মাছ, পাতলা ডাল, টক দই, পাতলা দুধ, খাদ্যতালিকায় অনর্-ভূক্ত করে দৈনিক চাহিদা পূরণ করতে হবে।
শর্করা: ৬। শর্করা জাতীয় খাবারের দিকে একটু লক্ষ করুন। আপনি জানেন কি? আপনার শরীরে শর্করা জাতীয় খাবারের চাহিদা কতটুকু। এটি হচেছ মোট ক্যালরির ৬০%। অর্থাৎ আপনার ওজন উচ্চতা, বয়স, শারীরিক পরিশ্রম লিঙ্গ ভেদে শক্তি চাহিদা যদি হয় ২০০০ ক্যালরি তবে তার ৬০ % নিতে হবে শর্করা জাতীয় খাবার থেকে। অর্থাৎ ১২০০ ক্যালরি। ১২০০ গু ৪ = ৩০০ গ্রাম শর্করা, এটি আপনি পাবেন ভাত, রুটি, চিড়া, মুড়ি, সুজি, সাগু, চিনি, আলু ও ফল থেকে। দুধ থেকেও আপনি শর্করা পাবেন। অনেকে ফল ও দুধ নিয়ে চিনি-ত হবেন, চিন্তা মুক্ত হতে জেনে নিন:- ফলে গড়ে ১৫% শর্করা থাকে, দুধে ১২% শর্করা থাকে। মনে রাখতে হবে, পাকা আমে ক্যালরি প্রতি ১০০ গ্রাম পাকা আমে ৭৪ ক্যালরি পাওয়া যায়। আমে কোন প্রোটিন বা ফ্যাট নেই। পুরোটাই শর্করা। হ্যাঁ তবে ভিটামিন ‘এ’ পাবেন প্রচুর। প্রতি ১০০ গ্রাম পাকা আমে ২৭৪৩ মাইক্রোগ্রাম ক্যারটিন পাওয়া যায়। গরমে শর্করার চাহিদা মিটাতে ভাত, রুটি, চিনির পরিমান কমিয়ে ফল, সবজি, দুধ, দই খাদ্য তালিকায় স্থান দিন।
ভিটামিন ও খনিজ উপাদান: ৭। গরমে ভিটামিন ও খনিজ উপাদানের চাহিদা মেটাতে টক ফল ও মিষ্টি ফল দুটোই খাদ্যতালিকায় রাখতে হবে। এছাড়া রঙ্গিন শাক সবজি, তো রয়েছেই। সুষম খাদ্যতালিকা থেকে (ইধষধহপব উরবঃ) আপনার খাদ্যের ৬টি পুষ্টি উপাদানের চাহিদাই পুরণ হবে।
পানি: ৮। বিশুদ্ধ পানি গ্রহণের কথা ভূলে গেলে চলবে না। প্রতিদিন ২.৫ লিটার পানি গ্রহণ যথেষ্ট। ৩ লিটার পর্যন্ত গ্রহণ করা যেতে পারে। তবে কিডনি রোগী ও ফ্লুয়িড রিটেনশন সিনড্রমের রোগীরা পানি গ্রহণের ব্যাপারে সতর্ক হোন ও আপনার ডাক্তার এর পরামর্শ নিন।
৯। অত্যাধিক পরিশ্রম নিয়ন্ত্রণ করুন। প্রয়োজন অনুযায়ী বিশ্রাম করুন।
১০। নিজের প্রতি স্বাস্থ্য সচেতনতাই আপনাকে করবে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী, সজীব ও কর্মক্ষম।
এস এন সম্পা
পুষ্টিবিদ, শমরিতা হাসপাতাল
পান্থপথ, ঢাকা।
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, মে ০৮, ২০১০
Leave a Reply