বয়স ৬০ এর ওপরে গেলেই পুরুষরা সাধারণত যে স্বাস্থ্য সমস্যায় বেশি আক্রান্ত হন, সেটা প্রোস্টেট গ্রন্থির সমস্যা। হঠাৎ করে প্রস্রাব আটকে যাওয়া, জ্বালাপোড়া করা, ফোঁটায় ফোঁটায় প্রস্রাব হওয়া কিংবা সম্পূর্ণ ক্লিয়ার না হওয়া প্রভূতি উপসর্গ নিয়ে কেউ যখন চিকিৎসকের কাছে যান, চিকিৎসক পরীক্ষা করেই বলে দেন যে সমস্যাটা প্রোস্টেটের। কিন্তু রোগী জানেন না প্রোস্টেট আসলে কী জিনিস। অনেক সময় রোগীর অপারেশনের প্রয়োজন হয়। রোগী ভয় পান এ ধরনের অপারেশনে শারীরিক মিলন সংক্রান্ত সমস্যা দেখা দিতে পারে ভেবে। পাঠক যাতে প্রোস্টেট সম্পর্কে জানতে পারেন তাই বিষয়গুলো সহজভাবে প্রশ্নোত্তর আকারে সাজানো হলো:
প্রোস্টেট কি?
বেশিরভাগ লোক প্রোস্টেটের কথা শুনে ধারণা করেন এটা পুরুষদের প্রজনন অঙ্গ। আসলে প্রোস্টেট হলো পুরুষদের প্রজননতন্ত্রের একটি গ্রন্থি। রেকটাম বা মলনালীর সামনে এবং মূত্রথলির তলায় বা গোড়ায় থাকে। প্রোস্টেট মূত্রনালী বা ইউরেথ্রার এক অংশ দ্বারা বেষ্টিত। মূত্রনালী হলো একটি টিউব, যার মাধ্যমে প্রস্রাব মূত্রথলি থেকে বেরিয়ে যায়। মূত্রনালীর একটা অংশ প্রোস্টেটের মধ্যে থাকে। নাম প্রোস্টিটিক ইউরেথ্রা। অনেকে ওটাকে প্রজনন অঙ্গ বলে ভুল করেন। প্রোস্টেটিক ইউরেথ্রা শেষ হয় এক্সটার্নাল ইউরেথ্রাল স্ফিংকটার-এ। এই স্ফিংকটার মূলত একটা পেশী, প্রস্রাবের সময় ওটাকে সংকুচিত করে প্রস্রাব বন্ধ করে রাখা যায়। অর্থাৎ প্রস্রাব করা সময়ে হঠাৎ প্রস্রাব বন্ধ করতে চাইলে, আমরা যে পেশীটিকে চাপ দেই, সেটা এক্সাটার্নাল ইউরেথ্রাল স্ফিংকটার। মূত্রথলির মুখে আরেকটি স্ফিংকটার রয়েছে যা আমাদের ইচ্ছায় কাজ করে না। তবে প্রস্রাব নিয়ন্ত্রণে এই দুটো স্ফিংকটার ভালভ-এর মত কাজ করে।
প্রোস্টেট দেখতে কেমন?
প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষদের প্রোস্টেট বড় আখরোটের মতো। ওজন প্রায় ২০ গ্রাম। যদি ওটাকে অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে নিয়ে দেখা হয়, তাহলে দেখা যাবে ওটা একটা মাংসপেশী, গ্রন্থি ও কানেকটিভ টিস্যুর স্তুপ। প্রোস্টেটের বাইরের আবরণটি মূলত পুরু মাংসপেশী দিয়ে আবৃত-ওটাকে বলে প্রোস্টেটিক ক্যাপসুল। এ ধরনের নামকরণের কারণ- প্রোস্টেটকে চারপাশ থেকে ক্যাপসুলের মতো ঘিরে রাখে ওটা। যদিও প্রোস্টেটে সে রকম পৃথকীকরণ চিহ্ন নেই, তবু চিকিৎসকরা প্রোস্টেটকে বর্ণনা করার জন্য কয়েকটি লোব বা অঞ্চলে ভাগ করেছেন। এর কেন্দ্রীয় বা মধ্যাঞ্চলে বেষ্টিত থাকে মুত্রনালী। সাধারণত ৫টি লোবে বিভক্ত করা হয়েছে প্রোস্টেটকে। সামনে, পেছনে, মাঝখানে এবং দুপাশে দুটি। চিকিৎসক যখন প্রোস্টেটের রোগ নির্ণয়ের জন্য পরীক্ষা করে থাকেন, তখন বস্তুত এই লোব বা অঞ্চলগুলোই দেখে থাকেন।
প্রোস্টেট যদি প্রজনন অঙ্গ না-ই হয়, তাহলে এর কাজ কি?
আমরা বলেছি প্রোস্টেট একটি গ্রন্থি। গ্রন্থির সংজ্ঞার মধ্যে পড়ে বলেই প্রোস্টেটকে গ্রন্থি বলা হয়েছে। যে কোনো গ্রন্থিই কিছু কিছু রস নি:সরণ করে। প্রোস্টেটও করে। তবে প্রোস্টেটের মূল ভূমিকা হলো প্রজননের ক্ষেত্রে সহায়তা করা। যেমন একটি ছেলের অণ্ডকোষ যখন বীর্য তৈরির জন্য সক্ষম হয়, তখন প্রোস্টেট এক ধরনের রস প্রচুর পরিমাণে নি:সরণ করে, যার নাম প্রোস্টিটিক ফ্লুইড। এই প্রোস্টিটিক ফ্লুইড বীর্যকে সচল রাখতে সাহায্য করে। অর্থাৎ সবসময় সে বীর্যকে সাপোর্ট দেয়। প্রোস্টেটে অসংখ্য ছোট ছোট গ্রন্থি রয়েছে যারা অবিরাম কম বেশি রস নি:সরণ করে যাচ্ছে। সত্যিকার অর্থে প্রোস্টেট এই রস নি:সরণ করে বলে শারীরিক মিলনের উত্তেজনার সর্বোচ্চ পর্যায়ে এবং বীর্যপাতের সময় শুক্রাণুগুলো শরীরের বাইরে আসতে পারে। প্রোস্টেটিক ফ্লুইড শুক্রাণুকে সজীব রাখে।
তাহলে শুক্রাণু কি প্রোস্টেটের মধ্যে দিয়ে আসে?
একটা কথা সবসময় মনে রাখতে হবে যে শুক্রাণুকে তৈরি করছে অণ্ডকোষ। এই শুক্রাণুগুলো এসে জমা হয় এপিডিডাইমিস নামের এক ধরনের পেঁচানো টিউবে। এখান থেকে ভাস ডিফারেন্স বা শুক্রবাহী নালীর মাধ্যমে তা যায় সেমিনাল ভেসিকল নামের এক ধরনের থলির মধ্যে। সেমিনাল ভেসিকল থাকে মূত্রথলির ঠিক পিছনে, নিচে। একই জায়গায় আছে প্রোস্টেটিক ইউরেথ্রা। ভাস ডিফারেন্সের ওপরের অংশের সংকোচনের জন্য শুক্রাণুগুলো সেমিনাল ভেসিকল থেকে প্রোস্টেটিক ইউরেথ্রার দিকে ধাবিত হয়। একই সময়ে প্রোস্টেটের সংকোচনের ফলে প্রোস্টেটের রস প্রোস্টেটিক ইউরেথ্রায় চলে আসে। শুক্রাণুর সঙ্গে প্রোস্টেট রসের এই মিশ্রণ সামনের দিকে চালিত হয় এবং মূত্রনালীর চারপাশের পেশীর হঠাৎ হঠাৎ সংকোচনের মাধ্যমে তা বের হয়ে আসে। আর এটাকেই আমরা বীর্যত্থলন বা বীর্যপাত বলি। শারীরিক মিলনের সময় বীর্যের মাধ্যমে শুক্রাণু মহিলাদের জননাঙ্গতে ও জরায়ুতে গিয়ে পড়ে এবং সেখান থেকে মহিলাদের ফ্যালোপিয়ান টিউব বা ডিম্ববাহী নালীতে যায়।
প্রোস্টেটের রস বীর্যকে চালু রাখা ছাড়া আর কি দায়িত্ব পালন করে?
প্রোস্টেটের ও সেমিনাল ভেসিকলের নি:সরণে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে বিভিন্ন উপাদান। এ সবের কিছু কিছু উপাদান শুক্রাণুর পুষ্টিসাধন ও উর্বরতা বৃদ্ধি করে। কিছু কিছু উপাদান আবার শুক্রাণুগুলোকে জননাঙ্গরসের স্বাভাবিক অম্লত্ব থেকে রক্ষা করে। সেমিনাল ফ্লুইডের রাসায়নিক উপাদান গর্ভসঞ্চালনের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিতে গুরুত্বপুর্ণ ভূমিক রাখে।
তার মানে নো প্রোস্টেট, নো শারীরিক মিলন, নো বেবি, কথাটি কি তাহলে সত্যি?
এ নিয়ে অনেকের মধ্যে ভুল ধারণা আছে। প্রোস্টেটের সমস্যা দেখা দিয়েছে এমন লোকের সামনে এ ধরনের কথা বললে দেখা যায় সত্যি সত্যিই সে তার বিশেষ অঙ্গ উত্থিত করতে পারছে না। প্রোস্টেট নিয়ে এ ধরনের আলোচনা করলে পুরুষত্বহীনতা নামক ভৌতিক অপচ্ছায়া তার মনে দারুণ প্রভাব ফেলে। খুশির খবর হলো, প্রোস্টেটের অসুখ হয়েছে এমন রোগীর চিকিৎসা করালে তাদের বেশিভাগই শারীরিক মিলনে আগের মতোই পারদর্শী হয়ে উঠবেন। আর দু:সংবাদ হলো এতে অল্প হলেও কিছু লোকের শারীরিক মিলনক্ষমতা স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। গর্ভসঞ্চারের ক্ষেত্রে বলা চলে-যেখানে বীর্য রস নেই সেখানে শুক্রাণু সহজে মেয়েদের ডিম্বনালীতে প্রবেশ করতে পারে না।
ডা: মিজানুর রহমান কল্লোল
আবাসিক সার্জন, সার্জারি বিভাগ
ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, মে ০১, ২০১০
Leave a Reply