সমস্যাটি এখন আমেরিকায় বেশি।
সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল বলেছেন সে দেশে তিন জনের মধ্যে একজন শিশুর ওজন বেশি বা স্থূল। এজন্য বেশি উদ্বিগ্ন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, শিশুদের স্থূলতার পেছনের কারণগুলো তিনি বলেছেন, “মা-বাবা অতিব্যস-”। ফাস্টফুড সস-া, সহজলভ্য, শিশুদের প্রিয় হলো এসব খাবার। আধুনিক প্রযুক্তির কারণে বাচ্চারা বসে বসে দিন কাটাচ্ছে। শিশুদের টিভিতে প্রচারিত হচ্ছে ফাস্টফুডের বিজ্ঞাপন। দুই তৃতীয়াংশ পূর্ণবয়স্ক হলো বেশি ওজনের। ওজন বেশি শিশু ও স্থূল শিশুদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি অনেক। গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যার মুখোমুখি হবে তারা, যার চিকিৎসাও বেশ ব্যয়বহুল। টাইপ-২ ডায়াবেটিস ও হৃদরোগ যা আগে ছিলো মধ্যবয়সী ও বুড়োদের রোগ তা ধীরে ধীরে বাড়ছে শিশু ও তরুণদের মধ্যেও। সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল ইদানীং দেখেছেন, দেহের ওজন বেশি এমন শিশুদের ২২% এবং স্থূল তরুণদের ৪৩% শতাংশের রক্তের চর্বিমান বেশি, বেশি ট্রাইগ্লিসারাইড মান ও কোলেস্টেরল, এগুলো হলো হৃদরোগের বড় ঝুঁকি।
সমস্যা শিল্পোন্নত দেশের হলেও ক্রমেই এ সমস্যা বাড়ছে নিম্ন আয় ও মধ্য আয় দেশের তরুণদের মধ্যে। নগরায়ন, ফাস্টফুড সংস্কৃতি, বসে বসে দিন কাটানো, শরীরচর্চার অভাব গ্রাস করছে স্বল্প আয় ও মধ্য আয়ের দেশগুলোতে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। স্থূল হলে যে খরচ বাড়ে পরিবারে তা ঠিক। যাদের শরীরের ওজন বেশি, ওজন সুমিত এমন লোকদের চেয়ে, এদের ক্লনিক রোগের সম্ভাবনা অনেক বেশি, আর এসব রোগের জন্য প্রয়োজন ব্যয়বহুল চিকিৎসা। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ও প্রেসিডেন্ট পত্নী দু’জনেই শৈশব স্থূলতার বিরুদ্ধে অভিযান ঘোষণা করতে বলেছেন। ঘরের বাইরের বিষয়গুলো দিকে নজর দিতে হবে, মা-বাবারা এব্যাপারে উদ্যোগী হবেন ঘরের অর্থনীতি, বাজার সওদা, রান্না-বান্না, সবদিকেই। হাট-বাজার করার সময় স্বাস্থ্যকর উপকরণ কিনতে হবে, টেবিলে স্বাস্থ্যকর খাবার পরিবেশন করতে হবে, ঘরে রান্না করতে হবে। প্রয়োজনে ডাক্তার ও পুষ্টিবিদের পরামর্শ নিতে হবে। সবই আমাদের দেশে ছিলো, এখন পশ্চিমা হাওয়ায় উড়ে গেছে, অনেকটা ফাস্টফুড কালচার ও কোমল পানীয় কালচার এবং রিমোটকন্ট্রোল প্রযুক্তি আমাদেরকে সুস্বাস্থ্য থেকে সরিয়ে দিচ্ছে ক্রমে ক্রমে।
আমেরিকার প্রিভেনটিভ সার্ভিসেস টাস্ক ফোর্স দেখেছেন, স্থূলতার বিরুদ্ধে কিছু কিছু কর্মসূচী কার্যকর। যেমন শিশুদের ও তরুণদের (৬ -১৮ বছর) বিএমআই (বডি মাস ইনডেক্স) পরিমাপ করা উচিত। ওজন বেশি পাওয়া গেলে, ওজন হ্রাসের কর্মসূচীতে অন-র্ভূক্ত করতে হবে। বোস্টনের শিশু হাসপাতালে স্থূলতা কর্মসূচীর পরিচালক ডা: ডেভিড লাডউইন বলেন, শৈশব স্থূলতার বিরুদ্ধে বড় হাতিয়ার হলো পারিবারিক উদ্যোগ, যার সম্ভাবনা এখন উম্মোচিত নয়। শিশুদেরকে ঘি-মাখন, গোস-, তেল-চর্বি, মিষ্টি মন্ডা দিতে অনেক মা-বাবা বড় উদার। ‘খাকনা আমার সোনামনি’। বিপত্নীক ভদ্রলোক একজন বাচ্চা একটু মোটা হওয়াতে অখুশি নন। নাম উহ্য রাখছি। কিন্তু শারীরিক এক অসুস্থতার জন্য ডাক্তারের কাছে নেওয়াতে তিনি জানলেন তার সন-ানের ওজন স্বাভাবিক আদর্শ ওজনের চেয়ে ৩০% বেশি। ইতিমধ্যে ১১ বছরের এই বাচ্চার হয়েছে টাইপ-২ ডায়াবেটিস। এথচ শিশু বিশেষজ্ঞ বার্ষিক চেক আপের সময়ই বলে দিতে পারেন শিশুটির বিএমআই। শিশুর ওজন, উচ্চতা, বয়স ও জেন্ডার বিবেচনা করে গণনা করা যায়, বিএমআই সহজেই। শিশুর এসব তথ্য ওয়েব সাইটে দিলেও বিএমআই ক্যালকুলেটার গণনা করতে পারে ইগও। শিশুর ওজন বেশি না শিশু স্থূল এ তথ্যটিও জানা যায়। সেভাবে ব্যবস্থাও নেওয়া যায়। শিশুদের ওজন হ্রাস করা বড়দের চেয়ে অনেক সহজ।
প্রয়োজন পুষ্টি পরামর্শ: বেশিরভাগ পরিবারেই কাজের চাপ ও অন্যান্য চাপ। পরিবার খোঁজে কিভাবে সহজে চটজলদি খাবার খাওয়া যায়। সেজন্য ফাস্ট ফুড হয় সহজ উপায়। বাঁচে সময়, এড়ানো যায় রান্নার ঝামেলা। ২০০৪ সালে চিকিৎসা জার্নাল পেডিয়াট্রিক্সে প্রকাশিত এক নিবন্ধে দেখানো হয়েছে দুর্ভাগ্যবশত: যেসব শিশু ফাস্টফুড খায় এরা, যারা ফাস্টফুড খায়না এদের চেয়ে কম খায় দুধ, শাক-সবজি, ফল ও আঁশ। প্রয়োজন চিকিৎসক ও পুষ্টিবিদের পরামর্শ। পরিবারের খাদ্যের নমুনা দেখে তিনি সঠিক খাদ্যাভ্যাসের পরামর্শ দেবেন। স্বাস্থ্যকর অথচ কম খরচে খাবারের রেসিপি ও মেনু তিনি দিতে পারবেন। শিশু হাসপাতাল শিশুদের স্থূলতা থাকলে ওজন হ্রাসের পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করতে পারেন। শিশু ও পরিবার শিখবে খাদ্যগ্রহণের ব্যাপারে অনেক কিছু, পিৎজা ও ফাস্ট ফুডের বদলে মৌরলা মাছের ঝোঁল, কচি মোরগের ঝোঁল ও আটার রুটি, ভাপে রান্না সবজি খেতে বললে অবাক হবার কিছু নাই। প্রতি বেলার খাবারের পরিমাণও জানাচাই। শরীরচর্চাও করতে হবে সে সঙ্গে।
শিশুদের জন্য খেলাধূলা ও শরীরচর্চার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতিটি স্কুল কলেজে বাধ্যতামূলকভাবে খেলার মাঠ এবং তা নাহলে কয়েকটি স্কুল মিলে খেলার মাঠ রাখতে হবে। স্কুলে মাধ্যহ্ন আহার দেওয়া যেতে পারে। স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া বাড়বে শিশুদের। স্কুল বাস করা যেতে পারে। বড় শিশুরা সাইকেল চালিয়ে আসতে পারে স্কুলে। পাঠ্যসূচীতে বাধ্যতামূলক খেলাধূলা, ব্যায়াম, ড্রিল/স্কাউটিং থাকা উচিত। জনপ্রিয় বর্তমান সরকার এসব ব্যবস্থা করা যায় কিনা ভেবে দেখতে পারেন।
আমেরিকার একটি গবেষণা সংস্থার রিপোর্টে প্রকাশিত হয়েছে আমেরিকার শিশুরা আগের তুলনায় অনেক বসে বসে দিন কাটায়। প্রতি দিন তারা কম্পিউটার, আইপড, সেলফোনেও টেলিভিশন দেখে গড়ে ৭ ঘন্টা ৩৮ মিনিট সময় কাটায়। আমাদের দেশেও এরকম বসে বসে দিন কাটানো বাড়ছে শিশু ও তরুণদের মধ্যে। শিশুরা কত সময় টেলিভিশন দেখবে বা কম্পিউটারে বিনোদন করবে সে সময় বেঁধে দিতে পারেন মা-বাবারা। সেই গবেষণা সংস্থা আরও লক্ষ্য করেছেন, মা-বাবা যখন সীমা বেঁধে দিয়েছেন তখন শিশুদের টিভিদেখা, বিনোদন এসব কমেছে তিন ঘন্টার মতো। বিকল্প হিসেবে শিশুদের মজা ও বিনোদনের জন্য অন্য ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সামাজিক সাংস্কৃতিক কর্মসূচীতে এদের অন-র্ভূক্ত করার উদ্যোগ নিতে হবে। বাইরে মাঠে খেলা, টেবিল টেনিস, ব্যাডমিন্টন খেলা, সাতার, নৃত্য, গানবাজনা ও সামাজিক কাজকর্ম অনেক বিকল্প আছে।
ব্যাপারটি পারিবারিক: পুরো পরিবার যুক্ত না হলে শিশুর একার পক্ষে অভ্যাস বদলানো কঠিন। নিজে যদি ধূমপান করি বা কোক ফান্টা দিনে দুই লিটার পান করি তবে এগুলো না করার পরামর্শ কি করে দেওয়া যাবে শিশুদের ? কথায় আছে, “আপনি আচরি ধর্ম, পরেরে শিখাও।” বাচ্চাদের বোঝালে বুঝে। মা-বাবা ও শিক্ষক যদি শিশুদের এ পরিবর্তনে সহায়তা করেন, তাহলে পরিবর্তন আসবেই।
অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরী
পরিচালক, ল্যাবরেটরী সার্ভিসেস, বারডেম, ঢাকা
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, এপ্রিল ১৭, ২০১০
Leave a Reply