প্রখ্যাত শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ জাতীয় অধ্যাপক এম আর খান শিশুদের বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যা, খাদ্য, পুষ্টি সমস্যাসহ নানা বিষয়ে ইত্তেফাকের স্বাস্থ্য পাতায় নিয়মিত লিখবেন। এ সংখ্যায় লিখেছেন শিশুর সাধারণ সমস্যা নিয়ে।
শিশু স্বাস্থ্যসমস্যা – সর্দি-কাশি:
ইহা ভাইরাসজনিত অসুখ। অল্প জ্বর, মাথা ধরা, নাক দিয়ে পানি পড়া বা নাক বন্ধ হওয়া, অল্প গলা ব্যথা হওয়া এবং কিছুটা কাশি-এ রোগের লক্ষণ। এর চিকিৎসার জন্য বিশেষ কোন ওষুধ লাগে না-নাক বন্ধ হলে নাকের ড্রপ: মাথা ব্যথা বা জ্বরের জন্য প্যারাসিটামল বা এসপিরিন; কখনও কখনও এন্টিহিস্টামিন খেলেও কিছুটা উপশম পাওয়া যায়। সাধারণত: ৭ দিনের মধ্যেই এ-রোগ সেরে যায়। যদি কোন জটিলতা দেখা যায় তাহলে ডাক্তারের স্মরণাপন্ন হতে হবে।
মাথাব্যাথা:
মাথাব্যাথা একটা সাধারণ অভিযোগ। এটা রোগ নয়, রোগের লক্ষণ মাত্র। এমন কোন লোক নেই, যার কোন না কোন সময় মাথা ব্যথা করেনি। চোখ, নাক, গলা, সাইনাস, দাঁত ও কানের বিভিন্ন অসুখে মাথাব্যথা হতে পারে। যাদের অপরিমিত ঘুম হয়, যারা রোদে অত্যধিক ঘুরাঘুরি করেন, মানসিক দুশ্চিন্তায় সময় কাটান বা যারা উচ্চ রক্তচাপে ভুগেন-তারা সচরাচর মাথাব্যথায় কষ্ট পান। মাথাব্যথা যে কারণে হচ্ছে সেই কারণের চিকিৎসা করলেই মাথা ব্যথা সেরে যায়। তবে সাময়িক উপশমের জন্য প্যারাসিটামল বা এসপিরিন ভরাপেটে খেতে দিতে হয়। যদি মাথাব্যথা দীর্ঘদিন থাকে এবং উপরোক্ত ওষুধে উপকার না পাওয়া যায়, তাহলে অবহেলা না করে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
জ্বর:
আমাদের শরীরের তাপমাত্রা ৯৮-৯৯; তাপমাত্রা যখন এর চেয়েও বেশী হয়, আমরা তাকে জ্বর বলি। যে রোগের কারণে জ্বর হয় সে রোগ না চিকিৎসা করলে জ্বর পুরোপুরি সারে না। কিন্তু জ্বর হলে জ্বর কমানোর ব্যবস্থা করতে হবে।জ্বর ১০১; এর বেশী হলে রোগীকে প্যারাসিটামল বা এসপিরিন জাতীয় ওষুধ খেতে দিতে হবে। রোগীর গায়ের জামাকাপড় খুলে সমস্ত শরীর ঈষদুষ্ণ গরম পানি দিয়ে স্পঞ্জ করে দিতে হবে (মাথায় ঠাণ্ডা পানি বা আইসব্যাগ দেয়া যেতে পারে): প্রথমে একটা পাত্রে ঈষদুষ্ণ পানি নিতে হবে; তারপর দুটো পরিষ্কার তোয়ালে বা গামছা ঐ পানিতে ভিজিয়ে তা দিয়ে প্রথমে জ্বরাক্রান্ত শিশুর একটা হাত একটা পা, তারপর অন্য হাত-পা এবং আস্তে আস্তে সমস্ত শরীর (পেট-পিঠ-মাথা) মুছে দিতে হবে। জ্বর না কমা পর্যন্ত এ-রকম করতে হবে। এভাবে স্পঞ্জ করার পর শুকনো কাপড় দিয়ে গা মুছে ফেলতে হবে। এরপর পাতলা জামা পরিয়ে ফ্যানের বা খোলা বাতাসের কাছাকাছি রাখতে হবে। জ্বর থাকলে পানির চাহিদা বাড়ে, সুতরাং জ্বরাক্রান্ত অবস্থায় রোগীকে বারবার পানি ও পানীয় খাওয়াতে হবে। অনেকে জ্বর বেশী হলে রোগীর গায়ে বেশী করে লেপ, কাঁথা বা গরম কাপড় জড়িয়ে দেন। এটা করা একেবারেই উচিত নয়, কারণ এতে শরীরের তাপমাত্রা আরো বেড়ে যায়, রোগী অস্বস্থি বোধ করে। জ্বর যদি বেশী দিন ধরে চলতে থাকে, তবে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
কৃমিরোগ: এদেশে, বিশেষত: এ-দেশের গ্রামাঞ্চলে, কৃমিরোগের প্রাদৃর্ভাব খুব বেশী। কৃমি বিভিন্ন রকমের হয়, যেমন-কেঁচোকৃমি, গুঁড়াকৃমি, বক্রকৃমি, ফিতাকৃমি ও জিয়ারডিয়া।
কেঁচোকৃমি: রোগীর পায়খানার সঙ্গে এই কৃমির ডিম শরীর থেকে বাইরে বেরিয়ে আসে। পানি এবং বিভিন্ন খাবার-দাবার, কাঁচা তরি-তরকারী, ফলমূল, হাতের আঙ্গুল, বাচ্চাদের খেলনা ইত্যাদির মাধ্যমে আমাদের অন্ত্রে এই ডিম প্রবেশ করে। অন্ত্র থেকে ফুসফুস হয়ে আবার অন্ত্রে এসে এ-গুলো বড় হয়, ডিম পাড়ে।
দুধকৃমি বা গুঁড়াকৃমি: এই কৃমি মানুষের মলদ্বারের চার পাশে ডিম পাড়ে, পায়খানার সঙ্গে এই কৃমির ডিম শরীরের বাইরে চলে আসে। পানি, বিভিন্ন খাবার-দাবার, কাঁচা শাক-সবজির মাধ্যমে এই রোগের ডিম আমাদের অন্ত্রে প্রবেশ করে। মলদ্বার চুলকালে এই এগুলি হাতে এবং নখের ভিতরে লেগে থাকে এবং হাত না ধুয়ে খেলে কৃমির ডিম আমাদের শরীরের ভিতরে প্রবেশ করে এবং অন্ত্রে যেয়ে রোগের সৃষ্টি করে।
বক্রকৃমি: এই কৃমির ডিম রোগীর পায়খানার সঙ্গে বাইরে বেড়িয়ে আসে এবং প্রাকৃতিক পরিবেশে এসে শুককীটে (লার্ভা) পরিণত হয়। খালি পায়ে হাঁটার সময়, সাধারণত: এগুলি পায়ের চামড়া ভেদ করে শরীরে প্রবেশ করে। শিরার রক্ত বেয়ে এগুলো ফুসফুসে প্রবেশ করে এবং সেখান থেকে অন্ত্রে আসে। সেখানে বড় হয়। ডিম পাড়ে। কৃমিতে আক্রান- হলে পেট ব্যথা, বদহজম, বমি-বমি ভাব কিংবা পাতলা পায়খানা হয়। অনেকেই অপুষ্টি ও রক্ত-শূন্যতায় ভূগে, বিশেষ করে বক্রকৃমিতে আক্রান্ত হলে; এ-গুলো রক্ত খায়, এক একটা বক্রকৃমি এক-একদিনে প্রায় ১/৪ সিসি রক্ত চুষে নিতে পারে। একজনের পেটে একই সাথে কয়েকশ থেকে কয়েক হাজার কৃমি থাকতে পারে। পায়খানা বা বমির সাথে অনেক সময় আস্ত কৃমি বেড়িয়ে আসতে পারে। বেশী বেশী মিষ্টি, গুড়, ইলিশ মাছ বা কলা খেলে কৃমি হতে পারে-এ ধারণা একেবারেই সত্য নয়, সম্পূর্ণ ভূল। অনেক সময় কলার বাকলে কৃমির ডিম লেগে থাকতে পারে, কেবলমাত্র সেক্ষেত্রে কলা ধুয়ে না খেলে কৃমি হবার সম্ভাবনা থাকে।
কৃমিরোগের চিকিৎসা: কৃমির প্রতিরোধ চিকিৎসাই সবচেয়ে প্রয়োজনীয়। পায়খানার পরে বা খাবার আগে অবশ্যই ছাই বা সাবান দিয়ে হাত পরিষ্কার করতে হবে, নিয়মিত নখ কাটতে হবে। শাক-সবজি, ফলমুল এবং সালাদ জাতীয় খাবার, খাওয়ার আগে, ভাল করে পরিষ্কার পানি দিয়ে ধূয়ে নিতে হবে। যেখানে-সেখানে পায়খানা করা উচিৎ নয়। বাড়ী থেকে দুরে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় গর্ত করে কিংবা নির্দিষ্ট পায়কানায় মলত্যাগ করতে হবে। অপরিষ্কার, নোংরা জায়গায় যেন শিশুরা খালিপায়ে না হাঁটে, খেয়াল রাখতে হবে। কৃমিরোগের চিকিৎসায় সাধারণত: মেবেণ্ডাজোল, পাইরেন্টাল প্যামোয়েট, পাইপেরাজিন, লিভামিসল ইত্যাদি ওষুধ ব্যবহার করা হয়। জিয়ারডিয়ার চিকিৎসায় সাধারণত: মেট্রোনিডাজোল ব্যবহার করা হয়।
অধ্যাপক ডা. এম আর খান
জাতীয় অধ্যাপক এবংপ্রখ্যাত শিশু বিশেষজ্ঞ্যা-৫
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, জানুয়ারী ২৩, ২০১০
Leave a Reply