কেস স্টাডি-১: রোগী নিজেই একজন চিকিত্সক। দেড় মাস মাসিক বন্ধ থাকার পর আলট্রাসনোগ্রাম করিয়ে দেখলেন তাঁর বাম টিউবে অ্যাক্টোপিক প্রেগনেন্সি হয়েছে। ভয়ানক ব্যাপার! কারণ অ্যাক্টোপিক প্রেগনেন্সির একমাত্র চিকিত্সা হলো অস্ত্রোপচার। সে রাতেই ল্যাপারোস্কপ যন্ত্র দিয়ে তাঁর অসুস্থ টিউবটি কেটে বের করে আনা হলো এবং টিউবটি ফেটে গিয়ে পেটের ভেতর যে রক্ত ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল তা পরিষ্কার করা হলো। পরদিন সকালেই রোগী সুস্থ। এক সপ্তাহের মধ্যেই প্রায় স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডে ফিরে গেলেন তিনি।
কেস স্টাডি-২: ভদ্রমহিলা একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা। তাঁর বিয়ে হয়েছে দীর্ঘদিন, কিন্তু তিনি নিঃসন্তান। মাসিক বন্ধ থাকায় চিকিত্সকের পরামর্শে আলট্রাসনোগ্রাম করিয়ে দেখলেন তাঁর অ্যাক্টোপিক প্রেগনেন্সি হয়েছে। ভদ্রমহিলা বেশ সচেতন, আধুনিক চিকিত্সা সম্পর্কেও ভালো খোঁজখবর রাখেন। কিন্তু ল্যাপারোস্কপির মাধ্যমে অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত নিয়েও আত্মীয়স্বজনের চাপে প্রথাগত (পেট কেটে) অপারেশন করাতে বাধ্য হলেন। ক্লিনিকে ভর্তি ছিলেন তিন দিন। সেলাই কাটার পর চলাফেরায় স্বাভাবিক হতে তাঁর প্রায় দুই সপ্তাহ লেগে গেল। অফিসে গেলেন এক মাস পর।
প্রকৃতির অদ্ভুত খেয়াল! কখনো কখনো ভ্রূণ জরায়ুতে বড় না হয়ে অন্য জায়গায়, যেমন—টিউব, ডিম্বাশয় ইত্যাদি জায়গায় বড় হয়। এটাকেই বলে অ্যাক্টোপিক প্রেগনেন্সি। ‘অ্যাক্টোপিক’ শব্দের অর্থ হলো, যেটা যেখানে থাকার কথা বা হওয়ার কথা তা না হয়ে অন্য স্থানে হওয়া। অনেক কারণেই এ রোগ হতে পারে, তবে প্রধানতম কারণ হচ্ছে টিউবের প্রদাহ।
তাই বেশ কিছু বিকল্প জায়গার মধ্যে বাচ্চাদানির দুই পাশে যে দুটো টিউব থাকে, সেখানেই এ রোগ বেশি হতে দেখা যায়। অধিকাংশ অ্যাক্টোপিক প্রেগনেন্সি সঠিক জায়গায় বড় না হতে পেরে নষ্ট হয়ে যায় এবং রোগী তাঁর অজান্তেই সেরে ওঠেন। কিন্তু যেসব অ্যাক্টোপিক প্রেগনেন্সি বড় হয়, সেগুলো একসময়ে ফেটে গিয়ে পেটের ভেতর রক্তক্ষরণ ঘটায়। সে সময় পেটে ভীষণ ব্যথা অনুভূত হয়। কখনো কখনো রক্তক্ষরণে রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
অ্যাক্টোপিক প্রেগনেন্সির প্রথাগত চিকিত্সা হলো অস্ত্রোপচার করে অসুস্থ টিউবটি ফেলে দেওয়া। তবে রোগী যদি নিঃসন্তান হন (নিঃসন্তান নারীদের এই রোগ বেশি হয়) এবং অন্য টিউবটি যদি ভালো না থাকে, সে ক্ষেত্রে বিভিন্ন মাইক্রোসার্জারি করা হয়ে থাকে।
অ্যাক্টোপিক প্রেগনেন্সির আধুনিক চিকিত্সা হলো ল্যাপারোস্কপিক সার্জারি। উল্লিখিত দুটি কেস স্টাডি থেকে নিশ্চয়ই এর ভালো দিকগুলো অনেকটা বোঝা যায়। এ পদ্ধতিতে অস্ত্রোপচারে পেট কাটার দরকার হয় না। রোগীকে অস্ত্রোপচার-পরবর্তী তীব্র ব্যথা অনুভব করতে হয় না। রোগী পরদিনই বাড়ি ফিরতে পারেন। এক সপ্তাহেই প্রায় কর্মক্ষম হয়ে ওঠেন। একজন দক্ষ ল্যাপারোস্কপিক গাইনি সার্জনের হাতে এ অস্ত্রোপচার সব মানদণ্ডেই প্রথাগত পদ্ধতি থেকে ভালো।
অস্ত্রোপচার ছাড়া শুধু্ ওষুধ দিয়েও অ্যাক্টোপিক প্রেগনেন্সির চিকিত্সা করা যায়। তবে এর বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা ও পূর্বশর্ত রয়েছে।
এ পদ্ধতিতে সবাইকে চিকিত্সা দেওয়া যায় না। রোগীকে চিকিত্সকের নিবিড় তত্ত্বাবধানে থাকতে হয়। ঘন ঘন বিভিন্ন পরীক্ষা করাতে হয়। অ্যাক্টোপিক প্রেগনেন্সি নতুন কোনো রোগ নয়। আদিকালেও এ রোগ ছিল। তবে বর্তমানে এই রোগ যেমন দ্রুত ধরা পড়ে, তেমনি উন্নত চিকিত্সা-পদ্ধতির কারণে রোগীর সার্বিক ক্ষতির মাত্রাও অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব হয়। আমাদের দেশে এ রোগের ব্যাপারে সচেতনতা কম। রোগ ধরা পড়লেও প্রায়ই রোগী চিকিত্সা নিতে গড়িমসি করেন এবং বিপদগ্রস্ত হন। এ সম্পর্কে আরও সচেতনতা তৈরি হোক—এটাই কাম্য।
এনামুল হক
স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ও ল্যাপারোস্কপিক সার্জন
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, অক্টোবর ২১, ২০০৯
Leave a Reply