আন্তর্জাতিক আত্মহত্যা প্রতিরোধ সংস্থা ২০০৩ সাল থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহায়তায় প্রতিবছর ১০ সেপ্টেম্বর ‘বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস পালন করে আসছে। এ বছরের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল ‘ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতিতে আত্মহত্যা প্রতিরোধ’। এ দিবসের তাত্পর্যপূর্ণ দিকটি হলো, বিশ্বব্যাপী জানান দেওয়া যে আত্মহত্যা প্রতিরোধযোগ্য এবং সংস্কৃতিভিত্তিক সামাজিক সচেতনতা বন্ধ করতে পারে আত্মহত্যার মতো দুঃখজনক ঘটনা। সংস্কৃতি, ধর্ম, সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান, প্রচলিত আইন, জীবনদর্শন ও একটি জাতির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট আত্মহত্যার প্রবণতার ওপর প্রভাব বিস্তার করে। গবেষণায় দেখা গেছে, উন্নত দেশগুলোতে, এমনকি ভারতেও পুরুষদের মধ্যে আত্মহত্যা করার হার বেশি। অথচ বাংলাদেশে নারীরাই বেশি আত্মহত্যা করে। ২০০১ সালে পরিচালিত এক গবেষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশে মোট সংঘটিত আত্মহত্যার শিকার ৫৮ শতাংশই নারী। আর এরও বহু আগে ১৯৮৬ সালে ঝিনাইদহে পরিচালিত আরেক জরিপে দেখা যায়, মোট আত্মহত্যাকারীর প্রায় ৭৩ শতাংশ নারী। চীনেও আত্মহত্যার প্রবণতা নারীদের মধ্যেই বেশি। যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে মধ্যবয়সী পুরুষ ও বৃদ্ধদের মধ্যে আত্মহত্যা করার হার বেশি হলেও আমাদের দেশে ১১ থেকে ২৫ বছর বয়সী মেয়েরাই বেশি আত্মহত্যা করে। অন্যান্য দেশে বিপত্নীক, অবিবাহিত, দক্ষ পেশাজীবীদের মধ্যে আত্মহত্যার হার বেশি। আমাদের দেশে গৃহবধূ, ছাত্রী ও কম শিক্ষিতদের মধ্যে আত্মহত্যা করার প্রবণতা বেশি।
বাংলাদেশে আত্মহত্যা নিয়ে কোনো জাতীয় পর্যায়ের জরিপ না হলেও বিভিন্ন গবেষকের প্রাপ্ত উপাত্তমতে, এ দেশে প্রতিবছর প্রতি লাখে আট থেকে দশজন আত্মহত্যার শিকার।
প্রচারমাধ্যমগুলোর অতিপ্রচার, অপপ্রচার বা অদায়িত্বশীল সংবাদ পরিবেশনের কারণেও কোনো কোনো দেশে আত্মহত্যার ঘটনা বাড়তে পারে।
বাংলাদেশে জাতীয় পর্যায়ে জরিপ না হলেও গবেষকদের গবেষণায় উঠে এসেছে আত্মহত্যার নানাবিধ কারণ, যার কোনো কোনোটি বিশ্বের অনেক দেশের চেয়ে আলাদা। যেমন—যৌতুক ও ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত করা। আগেই বলা হয়েছে, এ দেশে নারীরা পুরুষদের তুলনায় আত্মহত্যা বেশি করে। এর মধ্যে পারিবারিক সমস্যার কারণে—যেমন দাম্পত্য কলহ, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, যৌতুক, পরকীয়া প্রেম—গৃহবধূদের মধ্যে আত্মহত্যার ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটে। এ ছাড়া প্রেমে ব্যর্থতা, পরীক্ষায় পাস না করা, দারিদ্র্য, বেকারত্ব, অযাচিত গর্ভধারণ, মেলামেশা কম করার প্রবণতা এবং আত্মহত্যার উপকরণের (কীটনাশক, ঘুমের ট্যাবলেট) সহজপ্রাপ্যতা ইত্যাদি কারণে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে থাকে। বিগত কয়েক বছরে অল্পবয়সী তরুণী ও স্কুলগামী মেয়েদের উত্ত্যক্ত করার ফলে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর সব আত্মহত্যাকারীর মধ্যে এক বিরাট অংশ মৃত্যুকালীন কোনো না কোনো মানসিক অসুস্থতায় আক্রান্ত হয় বলে গবেষকদের অভিমত। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে—বিষণ্নতা, মাদকনির্ভরতা, সিজোফ্রেনিয়া, ব্যক্তিত্বের সমস্যা, তীব্র মানসিক চাপ ইত্যাদি। এ ছাড়া দীর্ঘদিন ধরে রোগযন্ত্রণার শিকার হয়েও কেউ কেউ আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। যে ব্যক্তি কথাচ্ছলে মৃত্যুর ইচ্ছা ব্যক্ত করে, ধরে নিতে হবে তার মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা রয়েছে। সে কারণে কারও মৃত্যুসংক্রান্ত কথাকে হালকাভাবে নেওয়া যাবে না। আত্মহত্যা প্রতিরোধের জন্য বেশ কয়েকটি বিষয়ের দিকে আমাদের নজর দিতে হবে।
দরকার দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন: পাকিস্তান, লেবাননসহ বেশ কিছু দেশে আত্মহত্যা ও আত্মহত্যার চেষ্টাকে গুরুতর অপরাধ হিসেবে ঘৃণার চোখে দেখা হয়, ফলে আত্মহত্যাকারীর বা আত্মহত্যার চেষ্টাকারীর পরিবার নিদারুণ সামাজিক নিগ্রহের শিকার হয়। এ কারণে যাদের মধ্যে আত্মহত্যার ইচ্ছা আছে, তারা কোনো সাহায্য নিতে এগিয়ে আসতে দ্বিধা বোধ করে, মুখফুটে কারও সাহায্য নিতে পারে না। ফলে বাধ্য হয়ে একসময় আত্মহত্যা করে ফেলে। যদি আত্মহত্যার বিষয়ে এই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটিয়ে সবাইকে বিশ্বাস করানো যায় যে আত্মহত্যার ইচ্ছা একটি ভুল মানসিক প্রক্রিয়া এবং এ থেকে বাঁচার জন্য উপযুক্ত ব্যক্তির সাহায্য নেওয়া প্রয়োজন, তবে অনেক ক্ষেত্রেই আত্মহত্যা প্রতিরোধ করা সম্ভব।
আত্মহত্যার উপকরণের সহজলভ্যতা কমাতে হবে: বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার বহু দেশে আত্মহত্যার উপকরণ হিসেবে যা ব্যবহূত হয়ে আসছে, সেই কীটনাশকের সহজলভ্যতা কমাতে হবে। লাইসেন্সধারী দোকানে ও লাইসেন্সধারী কৃষক ছাড়া এগুলোর বিক্রি বন্ধ করতে হবে এবং কৃষকের বাড়িতেও তা এমন জায়গায় তালা দিয়ে রাখা দরকার, যাতে সহজে কেউ নাগাল না পায়। সেই সঙ্গে চিকিত্সকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া ওষুধ বিক্রি বন্ধ করার উদ্যোগ নিতে হবে।
প্রচারমাধ্যমের দায়িত্বশীল ভূমিকা জরুরি: কে, কীভাবে, কেন আত্মহত্যা করেছে, এর ঢালাও ও পুঙ্খানুপুঙ্খ প্রতিবেদন এবং আত্মহত্যার নতুন নতুন কৌশলের বর্ণনা অনেক সময় আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়িয়ে দেয়। হংকংয়ে একটি ‘বিশেষ পদার্থ’ পুড়িয়ে বদ্ধ ঘরে একবার কোনো একজন আত্মহত্যা করার পর তা নিয়ে মিডিয়ায় নিত্যনতুন প্রতিবেদন প্রকাশ হতে লাগল। বিশেষ পদার্থটি কী প্রক্রিয়ায় কোন ধরনের বিষাক্ত গ্যাস তৈরি করে, আর তা মানুষের মস্তিষ্কের কোন অংশকে কীভাবে আক্রান্ত করে—একেবারে ডায়াগ্রাম ও রাসায়নিক সমীকরণসহ মিডিয়ায় প্রকাশ পেল। ফল হলো এই যে, ওই ‘বিশেষ পদার্থ’টি পুড়িয়ে পর পর আরও কয়েক ব্যক্তি আত্মহত্যা করল! পরে সরকারি কর্মসূচির মাধ্যমে ওই পদার্থের সহজপ্রাপ্যতা বন্ধসহ মিডিয়ার ইতিবাচক প্রতিবেদনের সহায়তা নেওয়া হয়। আমাদের দেশে ‘ছাত্রী উত্ত্যক্ত’ করার ঘটনা এবং ‘পরীক্ষায় ফেল করে আত্মহত্যা’র ঘটনাগুলো আগে যেমনটা পত্রিকার পাতায় আসত, এখন মিডিয়ার দায়িত্বশীল ভূমিকার কারণে সেভাবে পরিবেশিত হচ্ছে না, যা প্রশংসনীয় উদ্যোগ।
অভিবাসীদের প্রতি বিশেষ নজর দিতে হবে: বিশ্বব্যাপী অভিবাসীদের মধ্যে আত্মহত্যার হার বেশি, এ কারণে তাদের প্রতি বিশেষ নজরদারি ও তাদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ পরিহার করা দরকার।
সামাজিক বন্ধন দৃঢ় হোক: নগরায়ণ ও শিল্পায়নের প্রভাবে স্বাতন্ত্র্যবাদের বলয়ে ঢুকে পড়ছে বিশ্বের তাবত্ মানুষ। বাংলাদেশও এতে পিছিয়ে নেই। পারিবারিক বন্ধন বাড়ানো, সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ, অনেকে মিলে খেলা যায় এমন খেলাধুলার সুযোগ বৃদ্ধি, সেই সঙ্গে ধর্মাচরণ মেনে চলে আত্মহত্যার প্রবণতা কমানো যায়। সামাজিক সম্পৃক্ততা সামঞ্জস্যপূর্ণ থাকলে আত্মহত্যা করার আগে সামাজিক সহায়তা প্রাপ্তির সম্ভাবনা রয়েছে।
মাদকের অপব্যবহার রোধ জরুরি: মাদকের অপব্যবহার রোধ, মাদকসেবীদের প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন, তাদের চিকিত্সা ও পুনর্বাসনের মাধ্যমে সমাজের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করে আত্মহত্যার হার কমানো সম্ভব।
মানসিক রোগ দ্রুত শনাক্ত করে চিকিত্সা করতে হবে: মানসিক রোগ ও রোগীদের প্রতি সামাজিক মনোভাব বদলাতে হবে। বিষণ্নতা, ব্যক্তিত্বের বিকার, সিজোফ্রেনিয়াসহ নানা মানসিক রোগের দ্রুত শনাক্তকরণ ও সুচিকিত্সার ব্যবস্থা করতে পারলে বহু আত্মহত্যা কমানো যাবে। মানসিক রোগের অপচিকিত্সা বন্ধেও পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। মাঠপর্যায়ের চিকিত্সক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া আর মানসিক স্বাস্থ্যসেবাকে আরও বিস্তৃত করে মানসিক রোগ দ্রুত শনাক্ত ও চিকিত্সার সুযোগ তৈরি করা যায়।
নারীর ক্ষমতায়ন ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন: আমাদের দেশে যৌতুক, পারিবারিক নির্যাতন ও উত্ত্যক্তকরণের ফলে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে। এই কারণগুলো দূর করার জন্য প্রয়োজন নারীশিক্ষা ও নারীর ক্ষমতায়ন। সামাজিক অবকাঠামো ও বহুদিনের অভ্যাসের কারণে স্বভাবজাতভাবেই এ দেশের নারীরা নিজেদের অসহায় মনে করে। অনেক সময় প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলায় আত্মহত্যার বিকল্প কিছু খুঁজে পায় না। এ অবস্থা নিরসনে নারীর ক্ষমতায়ন এবং নারীর প্রতি নারী-পুরুষ সবার দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন প্রয়োজন।
কাউন্সেলিংয়ের সুযোগ দরকার: বিশেষ শ্রেণীর নারী-পুরুষ, যাঁরা আত্মহত্যার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন (ছাত্রী, নববিবাহিত বা বিবাহযোগ্য বয়সের তরুণী, দরিদ্র জনগোষ্ঠী, মাদকসেবী, মানসিক রোগী, পারিবারিক নির্যাতনের শিকার যাঁরা), তাঁদের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বা এলাকাভিত্তিক কাউন্সেলিং সেবাপ্রাপ্তির সুযোগ থাকতে হবে। যেখানে আত্মহত্যা প্রতিরোধে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিত্সক বা কাউন্সেলররা সবাইকে সাধারণভাবে আত্মহত্যা প্রতিরোধের বিষয়াদি সম্পর্কে পরামর্শ দেবেন, পাশাপাশি কারও মধ্যে আত্মহত্যার চেষ্টা বা ইচ্ছা দেখা দিলে তা ঠেকানোর উদ্যোগ নেবেন।
টেলি-পরামর্শসেবা (হটলাইন) চালু হোক: জাতীয় পর্যায়ে টেলিফোনে পরামর্শসেবা বা হটলাইনের সুযোগ থাকতে হবে। কারও মধ্যে আত্মহত্যা করার ইচ্ছা জন্মালে বা জীবনে বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটলে সে যেন এই হটলাইনে ফোন করে সুপরামর্শ পায়। হটলাইনের সাহায্যকারী প্রান্তে সার্বক্ষণিক থাকবেন মনোরোগ চিকিত্সক-কাউন্সেলর-প্যারামেডিকস-আইনজীবী-পুলিশ-সমাজকর্মীর সমন্বয়ে গঠিত একটি দল, যারা সাহায্যপ্রার্থী ব্যক্তিকে অল্প সময়ের মধ্যে টেলিফোনে বা সরাসরি উপস্থিত হয়ে আত্মহত্যার পথ থেকে ফেরাবে ও মানসিক বিপর্যয়ের জন্য প্রয়োজনীয় চিকিত্সাসেবা দেবে। প্রয়োজনে আইনি সহায়তাও দেবে। পশ্চিমা দেশগুলোতে এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে এ ধরনের হটলাইন সার্ভিস চালু আছে। সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে কার্যকর হটলাইন সার্ভিস চালু করা যেতে পারে।
আত্মহত্যা একটি প্রতিরোধযোগ্য বিষয়। সঠিক সময়ে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারলে অবশ্যই আত্মহত্যা ঠেকানো যায়। আমাদের দেশে, আমাদের সংস্কৃতিতে আত্মহত্যা প্রতিরোধের উপায় খুঁজে বের করতে হবে আমাদেরই, নিজেদের মতো করে।
আহমেদ হেলাল
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল
বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
সূত্র: প্রথম আলো, সেপ্টেম্বর ১৬, ২০০৯
Leave a Reply