ড. জেফরি মরিসনের একটি বড় পরিচয় হল তিনি নিউইয়র্কের মরিসন সেন্টারটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আর অন্য পরিচয় হল তিনি আমেরিকান অ্যাকাডেমি ফর দ্য অ্যাডভান্সমেন্ট অব মেডিসিন বা এসিএএম-এর বোর্ডের একজন পরিচালক। প্রতিষ্ঠানটি আগে আমেরিকান অ্যাকাডেমি অব মেডিকেল প্রিভেনটিকস্ নামে পরিচিত ছিল। চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের কাছে ড. মরিসন শরীর বিষমুক্ত করার অনন্য উপায় বা চীলেশানথেরাপির সঠিক ব্যবহার বিষয়ে একজন প্রথিতযশা শিক্ষক। এই থেরাপি সম্পর্কে তিনি প্রথমে যে তথ্যটি দেন তা হল, ‘শরীরের টিস্যুর মধ্যে বিষাক্ত ধাতু জমা হলে রক্তের চাপ, হৃদরোগের আশঙ্কা এবং স্নায়ু তন্ত্রের দুর্বল হয়ে পড়ার প্রবণতা বেড়ে যেতে পারে।’ পরে বিষয়গুলো প্রমাণের জন্য কতগুলো কেসস্টাডি তুলে ধরেন।
নেপলস্-এর চীলেশান সেন্টারের ডাক্তার গেরি গ্যালোর পরিবারে হৃদরোগের ইতিহাস আছে। এ কারণে তিনি নিজে তার রক্তের মার্কারির পরিমাণ কমাতে এই থেরাপি গ্রহণ করেছেন। তার মতে, ‘মার্কারি দেহের স্নায়ুতন্ত্র, কিডনী এবং হৃদযন্ত্রকে আক্রমণ করে।’ তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন যে, দেহে ভারী ধাতুর পরিস্থিতির কারণে মুক্তকণাগুলো একে অন্যের সাথে সংযুক্ত হয়। পরে তা যেমন ধমনীতে প্লেক সৃষ্ট করে তেমনি হৃদস্পন্দনে অনিয়ম, গিটে গিটে ব্যথা, ক্রমাগত ক্লান্তি, স্নায়ুর অকার্যকারিতা এবং মানসিক সুস্থতা হ্রাস পাবার মতো অবস্থাও তৈরি করতে পারে।
চীলেশান থেরাপি সম্পন্ন করার জন্য একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে ৩০টি চিকিৎসার বা সেশনের প্রয়োজন হয়। প্রতিটি সেশনে লাগে কয়েক ঘন্টা করে। থেরাপি চলাকালীন ও পরবর্তী সময়ে চিকিৎসার পাশাপাশি বিশেষ কতগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলতে থাকে। ‘২০টি চিকিৎসা নিতে নিতেই অনেকের মধ্যে ব্যাপক উন্নতি চোখে পড়ে।’ কথাটি বললেন নেপলস্-এর চীলেশানসেন্টারের রেজিস্টার্ড নার্স ডায়ানা স্মিথ। ‘যখন রোগীরা নিজেরাই এ পার্থক্যটা ধরতে পারেন তখন তারা বাকী ১০টি চিকিৎসাও সম্পন্ন করতে আগ্রহী হন।’
স্বাস্থ্য সেবাদানকারী যে কারো জন্যই এটা খুবই উৎসাহব্যঞ্জক যে একজন রোগী যার কিনা গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গা থেকে ডাক্তারের রুম পর্যন্ত যেতে একগাদা নাইট্রো পিল খাওয়া লাগতো পরে সেই যখন চিকিৎসা নিল তখন দেখা গেল যে সপ্তায় একদিন নাইট্রোপিল খেলেই তার চলছে। স্মিথ আরো যা দেখেছেন তা হল অনেক রোগী যারা আগে প্রায় একদমই হাঁটতে পারতেন না চীলেশানথেরাপি নেবার পর তাদের কেউ কেউ দিনে এক থেকে দু’মাইলও হাঁটতে পারছেন।
চীলেশান থেরাপির ইতিহাস শুরু হয়েছে সেই ১৮৯৩ সালে যখন ফ্রেঞ্চ-সুইস রাসায়নবিদ আলফ্রেড ওয়ার্নার তার কোঅর্ডিনেশন কম্পাইন্ড (যা আজ সেলেসটেস নামে পরিচিত) থিওরী আবিষ্কার করেন। চীলেশান শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ ‘কীলে’ থেকে যার অর্থ হল ‘থাবা’। কীলেটিং এজেন্টস এক ধরনের পদার্থ যা শরীরের বিষাক্ত খনিজ, ধাতব ও রাসায়নিক পদার্থের সাথে মিলে রাসায়নিক যৌগ গঠন করতে পারে। এ যৌগগুলো দেহের অনাকাঙ্খিত পদার্থকে ঘিরে ফেলে এবং পরে সেগুলোকে মল-মূত্রের সাথে করে দেহ থেকে বের করে দেয়। ১৯১৩ সালে ওয়ার্নার তার এ আবিষ্কারের জন্য নোবেল পুরস্কার লাভ করেন এবং চীলেশান রসায়নের এই বিজ্ঞানটিকে প্রতিষ্ঠিত করার কাজ এগিয়ে নেন।
ওয়ার্নারের এই আবিষ্কার জার্মানিতে কল-কারখানায় রঙ তৈরিতে ব্যবহার করেছে। রঙ প্রস্তুত করার সময় ভারী ধাতব দূষণ প্রতিরোধ করা অত্যন্ত জরুরি। উৎপাদন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য বিদেশ থেকে আমদানি করা সাইট্রিক এসিডের উপর নির্ভরশীল না থেকে জার্মানির রসায়নবিদেরা ওয়ার্নারের আবিষ্কারের পথ ধরে ইথিলিনডিয়ামাইন টেট্রা এসিডিক এসিড (ইডিটিএ) নামের একটি নিরাপদ অ্যামিনো এসিড অবিষ্কার করেন যা বর্তমানে চীলেশান থেরাপিতেও ব্যবহার করা হচ্ছে।
১৯৪০ সালে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত এ বিজ্ঞানের বিষয়ে যে সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও গবেষণা চলেছে তা মূলতঃ হয়েছে ইডিটিএ চীলেশান থেরাপির মাধ্যমে যে সব ব্যক্তি চিকিৎসা নিয়েছেন তাদের উপরে বিশেষভাবে যাদের শরীরে মার্কারি ও সীসা জাতীয় বিষাক্ত ধাতু জমাট বেধেছিল। চিকিৎসা বা পরীক্ষা-নিরীক্ষাটিতে শিরার মধ্যে রোগীর প্রয়োজনানুসারে ভিটামিন, ম্যাগনেসিয়াম এবং লবণের পানি সঞ্চার করা হয়েছিল। সৌভাগ্যক্রমে তারা তাদের বুকের ব্যথা, বাত, স্মরণশক্তি হ্রাস এবং মনোসংযোগের অসমর্থতা থেকে মুক্ত হয়েছেন।
আবিষ্কারের খবরটি বিভিন্ন দেশের অনেক চিকিৎসা বিষয়ক পত্রিকায় স্থান পেয়েছে। ফলশ্রুতিতে ১৯৭৩ সালে চিকিৎসকদেরকে হৃদরোগের চিকিৎসায় ইডিটিএ চীলেশান থেরাপির ব্যবহার শেখাতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ‘এসিএএম’।
আজ ন্যাশনাল ইনস্টিটিউটস অব হেলথ এর দুটি প্রকল্প ন্যাশনাল সেন্টার ফল কমপ্লিমেন্টারি অ্যান্ড অল্টারনেটিভ মেডিসিন এবং ন্যাশনাল হার্ট, লাং অ্যান্ড ব্লাড ইনস্টিটিউট- দু’জায়গাতেই চীলেশান থেরাপি পড়ানো হচ্ছে। এটাই প্রথম বড় আকারে আয়োজিত এবং একাধিক কেন্দ্রে পরিচালিত হৃদরোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের উপর ইডিটিএ চীলেশান থেরাপি ও উচ্চ মাত্রায় ভিটামিন বা খনিজ প্রয়োগের কার্যকারিতা নির্ধারণের জন্য বিশেষ ধরনের শিক্ষা।
মাইকেল লোকাস্টো নামের একজন ডাক্তার যিনি প্রাকৃতিক আরোগ্যদায়ী শক্তির উপর ভিত্তি করে রোগীদের সুস্থ করেন তিনি তার পেনসিলভেনিয়াস্থ এলেনটাউন এর বর্টন মেডিকেল সেন্টারে রোগীদের চীলেশান থেরাপি দিয়ে থাকেন। তার ভাষায়, ‘আমি এই থেরাপিকে বলতে চাই কয়েকটি ভিটামিনের সংমিশ্রণ কারণ আমরা এতে ম্যাগনেসিয়াম ও ক্যালসিয়ামের সাথে ভিটামিন সি এবং ভিটামিন বি-সিক্স দিয়ে থাকি।’
ডাক্তার লোকাস্টোই খাবার চীলেশান আবিষ্কার করেছেন। তিনি বিশ্বাস করেন যে, চিকিৎসকদের শুধুমাত্র বিষক্রিয়া প্রতিরোধকারী হিসেবেই চীলেশনের ব্যবহার সীমাবদ্ধ রাখা উচিত নয়। কেননা এটা যে কোন শারীরিক অবস্থায় রোগীকে সাহায্য করতে পারে। চীলেশান থেরাপি রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি করে যা প্রাকৃতিরভাবেই দেহের সকল অংশে বেশি করে স্বাস্থ্যকর অক্সিজেন পৌঁছে দেয়।
ডা. গোবিন্দ চন্দ্র দাস
সিনিয়র কনসালটেন্ট, শহীদ সোহরাওয়ারর্দী হাসপাতাল, ঢাকা
চেম্বার : করোনারি আর্টারি ডিজিস প্রিভেনশান এন্ড রিগ্রেশান (সিএডি পিআর) সেন্টার, ৫৭/১৫ পশ্চিম পান্থপথ, ঢাকা। ফোন : ০১৯২১৮৪৯৬৯৯।
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, আগস্ট ২৯, ২০০৯
kholilur rhaman
please write about swine flu.