রোজা নিয়ে মানুষের স্বাস্থ্য ভাবনার শেষ নেই। রোজায় সেহরি, ইফতার ও শারীরিক সুস্থতা নিয়ে মানুষের মনে এ সময়ে থাকে অনেক জিজ্ঞাসা। কিন্তু রোজায় স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি তো নেইই, বরং অনেক সময় এটি স্বাস্থ্যের জন্য সুফল বয়ে আনে।
রোজায় সেহরি ও ইফতার কেমন হবে?
আমাদের দেশে মানুষের মধ্যে রমজানে যে খাদ্যাভ্যাস লক্ষ্য করা যায়, তা পুরোপুরি স্বাস্থ্যসম্মত নয়। এ সময়ে খাবারের প্রধান পর্যায় দুটি-সেহরি ও ইফতার। আমাদের দেশে সেহরি ও ইফতারের অধিকাংশ খাবারই হচ্ছে চর্বি সমৃদ্ধ এবং তেলে ভাজা। সেহরি ও ইফতারের খাবার নির্বাচনে রোজাদারের বয়স ও শারীরিক অবস্থাকে বিবেচনায় রাখা হয় না। কিন্তু এসব দিকে নজর দিতে হবে।
সেহরির প্রসঙ্গে আসা যাক। স্বাভাবিকভাবে যেকোনো ধরনের খাবারই সেহরিতে খাওয়া যায়, তবে খেয়াল রাখতে হবে খাবারটা যেন সহজপাচ্য ও স্বাস্থ্যসম্মত হয়। ভাত ভাঙালির মূখ্য খাবার। তাই সেহরিতে অবশ্যই সাদা ভাত রাখবেন। তবে ভাতের সঙ্গে রাখতে হবে উচ্চ প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার যেমন- মাছ, গোশত ও ডিম। খরচ কমাতে চাইলে ভাতের সঙ্গে শুধু ডিম ও ডাল। ডাল উদ্ভিজ প্রোটিন বলে এতে ক্ষতিকর চর্বি নেই। সেহরির খাবার তালিকায় যেকোনো একটি সবজি থাকা ভাল। ফুলকপি, বাঁধাকপি, শিম, পেঁপে, করলা, আলু, টমেটো এর কয়েকটি বা যেকোনো একটি রাখলে চলবে। পাকস্থলীতে উত্তেজনা ও অস্বস্তি সৃষ্টি করে- এমন কোনো খাবার খাওয়া উচিত নয়। এবার ইফতার প্রসঙ্গ। ইফতার পর্বে উত্তেজক খাবার একেবারেই বর্জন করতে হবে। ইফতার শুরু করবেন শরবত দিয়ে। তবে শরবতে কৃত্রিম রঙ মেশাবেন না। এ রঙে থাকে ক্যান্সার সৃষ্টিকারী উপাদান। বাজারে অনেক কৃত্রিম রঙ মেশানো শরবত পাওয়া যায়, যেসব অবশ্যই পরিহার করবেন। যেকোনো একটি ফল খাবেন ইফতারে। ফল থাকে প্রচুর ভিটামিন ও খনিজ যা আপনাকে স্বাস্থ্য বিপর্যয় থেকে রক্ষা করবে। বুট, ছোলা ও মুড়ি খেতে পারেন এ সময়ে। দই, চিড়া ও কলা খেলে ভাল। তবে প্রচলিত তেলে ভাজা খাবার স্বাস্থ্যের ক্ষতি করতে পারে। তা ছাড়া খাবারগুলো পুরনো তেলে ভাজা হলে ক্ষতির পরিমাণটা বেড়ে যায়। তেল বারবার গরম করলে ক্ষতিকর পলিনিউক্লিয়ার হাইড্রোকার্বন তৈরি হয় যার মধ্যে থাকে বেনজোপাইরিন। এটা ক্যান্সার সৃষ্টি করে। সারাদিন না খেয়ে থাকার ফলে শরীরে গ্লুকোজের ঘাটতি দেখা দেয়। খেঁজুর সেই ঘাটতি পূরণে সাহায্য করে। সেহরি ও ইফতারে প্রচুর পানি পান করবেন। পানি আপনার শরীরের কোষগুলোকে সজীব রাখবে।
যারা বিভিন্ন অসুখে ভুগছেন তাদের জন্য পরামর্শ
পেপটিক আলসারের রোগী যারা বিভিন্ন অসুখে ভুগছেন তারাও রোজা রাখতে পারবেন। তবে এ ক্ষেত্রে তাদের খাবারের বেলায় কিছুটা সতর্ক হতে হবে। সেহরি ও ইফতারে বাছাই করা খাবার খেতে হবে। তৈলাক্ত খাবার বাদ দিয়ে সহজপাচ্য খাবার খেলে এসিড নিঃসরণের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকবে এবং স্বাস্থ্যগত কোনো অসুবিধা হবে না।
ডায়াবেটিসের রোগী অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে রোজা রাখতে হবে। যারা ইনসুলিন নিচ্ছেন, রোজা তাদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। চিকিৎসা বিজ্ঞান অনুযায়ী এদের রোজা না রাখাই ভাল। কিন্তু যারা ইনসুলিন নিচ্ছেন না তারা রোজা রাখতে পারেন। তবে রোজা রাখার সময় অনেকের হাইপোগাইসেমিয়াতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সে ক্ষেত্রে রোজা রাখার আগে চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে আপনার চিকিৎসাপত্র, খাবার ও ব্যায়ামের ব্যাপারটা ঠিক করে নেবেন। এ সময়ে দৈনন্দিন কাজ কম করতে হবে।
রোজা রাখলে হৃদরোগীদের সাধারণ অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। তা ছাড়া এ সময়ে খাদ্য নিয়ন্ত্রণে রাখার একটা সুযোগ তৈরি হয় বলে তাদের রক্তের কোলেস্টেরলের মাত্রাও ঠিক থাকে।
রোজায় পানি শূন্যতায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে যদি সেহরি ও ইফতারে পর্যাপ্ত পানি না খাওয়া হয়। সেহরি ও ইফতারে পর্যাপ্ত পানির সঙ্গে শাকসবজি ও ফলমূল খাবেন। তাহলে পানিশূন্যতার পাশাপাশি কোষ্ঠকাঠিন্য থেকেও রেহাই পাওয়া যাবে। যারা ওষুধ খাচ্ছেন তাদের জন্য রোজার সময়ে ওষুধ কোনো সমস্যা নয়। চিকিৎসককে বলে ওষুধের মাত্রা ঠিক করে নিলেই হলো। অবশ্য কিছু কিছু ক্ষেত্রে রোগীকে জীবন বাঁচানোর স্বার্থে রোজা রাখার পরিকল্পনা বাতিল করতে হবে। অন্য ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ মতো ওষুধের মাত্রা ঠিক করে নিলে রোজা রাখতে কোনো অসুবিধার সৃষ্টি হবে না। রোজার সময় আরো একটি স্বাস্থ্যগত সমস্যা দেখা দেয়। সেটি হলো পেটে ব্যথা। বিভিন্ন হাসপাতালে দেখা গেছে, রোজার সময় ইফতারের পরপরই অধিকাংশ রোগী ভর্তি হন পেটে তীব্র ব্যথা নিয়ে। অনেকের অন্ত্র ফুটো হয়ে যায় এবং জরুরি অপারেশনের প্রয়োজন হয়। ব্যথানাশক ওষুধ খাবার কারণে পেটে তীব্র ব্যথা এবং অন্ত্র ফুটো হয়ে যাওয়া সমস্যার সৃষ্টি হয়। মূলত মাথাব্যথা করলে ইফতারের সঙ্গে সঙ্গেই ব্যথানাশক ওষুুধ যেমন এসপিরিন বা ডাইক্লোফেনাক সোডিয়াম খাওয়া উচিত নয়। কিছু খেয়ে তারপর এসব ওষুধ খেতে হবে। যাদের পেপটিক আলসারের ইতিহাস আছে, তারা এন্টাসিড ও রেনিটিডিন খেয়ে এসব ওষুধ খাবেন। সুতরাং একটু সতর্কতা ও নিয়ম পালন করলে রোজা রাখা কোনো সমস্যা নয়। রোজার মাধ্যমে আপনি পেতে পারেন সুন্দর, স্বাস্থ্যসম্মত জীবন।
ডা. মিজানুর রহমান কল্লোল
জেনারেল ও ল্যাপারোস্কপিক সার্জন।
চেম্বার : কমপ্যাথ লিমিটেড, ১৩৬ এলিফ্যান্ট রোড ঢাকা।
ফোন : ০১৭১৬২৮৮৮৫৫।
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, আগস্ট ২২, ২০০৯
Leave a Reply