আমাদের প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় লবণ একটি গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য উপাদান। সোডিয়াম ক্লোরাইড হলো সাধারণ লবণ। এটি দেহের জলীয় অংশের সমতা রক্ষা করে। আবার পেশি সংকোচন, দেহের মধ্যস্থিত সোডিয়াম ও পটাশিয়ামের মধ্যে সমতা রক্ষা করে। তবে অধিক সোডিয়াম শরীর থেকে পটাশিয়াম বিতাড়িত করে। মাংস ও দুধে সোডিয়াম বেশি থাকে এবং তাজা ফল ও সবজিতে পটাশিয়াম বেশি থাকে।
সাগরজলের লবণ বা পাথুরে লবণ-সব ধরনের লবণেই থাকে সোডিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, কপার ও জিংক। সাগরের পানি বাষ্পীভূত হওয়ার পর ৭৫ শতাংশ থাকে সোডিয়াম ক্লোরাইড ও বাকি ২৫ শতাংশ থাকে অন্যান্য খনিজ পদার্থ। লবণের সাহায্যে বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য সংরক্ষণ করা হয়। এটা ভালো খাদ্যসংরক্ষক। অনেক সময় প্রতিষেধক হিসেবেও লবণ কাজ করে থাকে। যেমন-ঠান্ডাজনিত গলাব্যথায় কুসুম গরমপানিতে লবণ দিয়ে গড়গড়া করতে হয়। আবার শরীরে কোনো ব্যথা, চুলকানি ইত্যাদিতে লবণমিশ্রিত পানি ব্যবহার করলে উপকার পাওয়া যায়।
খাদ্য উপাদানের মধ্যে পর্যাপ্ত সোডিয়াম থাকলেও স্বাদের জন্য রান্নার সময় বাড়তি লবণ ব্যবহার করা হয়। এই লবণ দেহের সর্বত্র পানিবণ্টন, পরিপাক ও বিপাক-কাজে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। ক্ষুদ্রান্ত্র থেকে খাদ্যকণা অবশোষণেও এর ভূমিকা রয়েছে। দৈনিক চার থেকে ছয় গ্রাম লবণ আমাদের শরীরের জন্য প্রয়োজন। অথচ প্রতিদিন আমরা যে লবণ গ্রহণ করি, তা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি। এই অতিরিক্ত লবণ কিডনির মাধ্যমে পরিত্যক্ত হয়।
যদি লবণ কম খাওয়া হয়, তাহলে কিডনি সোডিয়াম ক্লোরাইডের নিষ্ত্র্নমণ কমিয়ে দিয়ে নির্ধারিত হারটি বজায় রাখে। নিষ্ত্র্নমণের কাজটি করে অ্যাড্রিনাল গ্রন্থি থেকে ক্ষরিত অ্যালডেস্টেরম নামের হরমোন। এই হরমোন ক্ষরণ কমে গেলে প্রস্রাবের মাধ্যমে সোডিয়াম নিষ্ত্র্নমণ বৃদ্ধি পায়। আবার হরমোনের আধিক্য ঘটলে দেহে সোডিয়াম জমে গিয়ে শরীর ফুলে যায়। নেফ্রাইটিস ও হৃৎপিণ্ডের অসুখে কার্ডিয়াক ফেইলিওর হলে এভাবে সোডিয়াম জমে গিয়ে শরীরে পানি জমে যায়। প্রস্রাব ছাড়াও ঘাম ও মলের সঙ্গে সোডিয়াম বেরিয়ে যায়। এ কারণে প্রচণ্ড গরমে ঘাম হলে লবণ ও পানি খেতে বলা হয়। আবার ডায়রিয়ায় শরীর থেকে পানি বেরিয়ে যায় বলে লবণ ও পানি পান করলে শরীরে লবণের হার বজায় থাকে। জ্বরের সময় পানির সঙ্গে লবণ মিশিয়ে খেলে ভালো হয়। লবণ যেমন শরীরের জন্য প্রয়োজন, তেমনি এই লবণই মানুষের জন্য প্রাণঘাতী হিসেবে কাজ করে।
এ কারণে বিভিন্ন রোগে লবণ নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। যেমন-নেফ্রাইটিস, নেফ্রোসিস, কিডনির অসুখ, হার্টের অসুখ, লিভার সিরোসিস, উচ্চ রক্তচাপ। এসব ক্ষেত্রে মাংস, ডিম, দুধ, গাজর, শিম যতটা সম্ভব কম খাওয়া উচিত। এগুলোতে সোডিয়াম বেশি থাকে।
রোগের তীব্রতার ওপরই লবণ গ্রহণের মাত্রা নির্ধারিত হয়ে থাকে। তবে সব রোগের ক্ষেত্রেই পাতে আলগা লবণ বর্জন করতে বলা হয়। দৈনিক খাদ্যতালিকায় ৫০০-৭৩০ মিলিগ্রাম লবণ থাকা মানে সামান্য নিয়ন্ত্রণ। আর যদি ২০০ মিলিগ্রাম লবণ খেতে বলা হয়, তাহলে সেটা খুবই কড়াকড়ি। এ ক্ষেত্রে নির্ভর করতে হবে যেসব খাবারে লবণ আছে সেসব খাবারের ওপর। কম সোডিয়ামযুক্ত খাবার খেলে উচ্চ রক্তচাপ, ইডিমা বা শোথ, প্রোটিন ইউরিয়া এবং চোখে লাল-নীল দেখা প্রতিরোধ করা যায়। অনেকে মনে করেন, খাবারে লবণ কমালে বুঝি ওজন কমে যাবে। আসলে তা নয়। ওজন বেশি থাকলে উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগের আশঙ্কার কথা ভেবেই লবণ বাদ দিতে বলা হয়।
আখতারুন নাহার আলো
প্রধান পুষ্টি কর্মকর্তা, বারডেম
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুলাই ০৮, ২০০৯
Leave a Reply