বর্তমান সময়ে আমাদের দেশে করোনারি আর্টারি ডিজিজ বা হৃদরোদ আক্রান্ত ব্যক্তিদের সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্দি পাচ্ছে এবং বিপুল সংখ্যক মানুষ এই রোগে মারা যাচ্ছেন। একদিকে বাড়ছে হৃদরোগীর সংখ্যা, অন্যদিকে কমছে এতে আক্রান্তদের বয়স। পরিসংখ্যানটি রীতিমতো আতঙ্কজনক। প্রচলিত চিকিৎসা পদ্ধতিগুলো অত্যন্ত ব্যববহুল। তাছাড়া এগুলো কোনো দীর্ঘস্থায়ী সুফলও বয়ে আনে না।
আপনি জেনে আনন্দিত হবেন যে, হৃদরোগ প্রতিরোধ করা যায়, এমনকি প্রতিকারও আছে এর। যে নতুন যুগান্তকারী চিকিৎসাপদ্ধতির কথা বলা হবে এ রচনায় সে বিষয়ে বহির্বিশ্বে ইতোমধ্যেই জনসচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে। হৃদরোগের প্রকৃত কারণ নির্ণয়ে যদি সমর্থ হই তবে কেন আমরা অসুস্থ থাকবো? হৃদরোগ মুক্তির এই বিকল্প পদ্ধতিতে রোগীকে নিবেদিতপ্রাণ হতে হয়। আর ধৈর্য ধরে একবার অভ্যস্ত হয়ে উঠলে পরবর্তীকালে মানুষের জীবনধারাই বদলে যায়। লক্ষ্য করুন, একদিকে রয়েছে অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও ঝুঁকিপূর্ণ ওপেন হার্ট সার্জারি, যা আবার রোগমুক্তি ঘটায় সাময়িকভাবে। অন্যদিকে রয়েছে যোগব্যায়াম এবং শাকসবজি খেয়ে হৃদরোগকে প্রতিরোধ করা। আপনি কোনটি বেছে নেবেন?
দশকের পর দশক ধরে চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা অস্বীকার করে আসছিলেন যে, হৃদরোগ প্রতিকারযোগ্য। কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণায় প্রমাণ মিলেছে যে, বিকল্প পদ্ধতিতে জীবনধারা ইতিবাচকভাবে বদলে দিতে পারলে সেটা হৃদরোগের উর্ধ্বগতি থামিয়ে দেয়। একই সঙ্গে রুদ্ধ ধমনীগুলোও (ব্লকেজ) খুলে যায়।
করোনারি আর্টারি ডিজিজ
করোনারি আর্টারি ডিজিজ এখন বিশ্বব্যাপী আলোচিত ব্যাধি। বাংলাদেশ এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্য ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। এই রোগের কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকে : বংশানুক্রমিক ধারা (অর্থাৎ পিতা-মাতার হৃদরোগ থাকলে), উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, উচ্চ মাত্রার কোলেস্টেরল, ধূমপান ইত্যাদি। ব্যক্তির জীবনযাপন এবং মানসিক অবস্থাও সমভাবে গুরুত্ব বহন করে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ব্যাপারে। প্রতিকূল পরিস্থিতি, সামাজিক নিরাপত্তার অভাব এবং পরিবার ও কর্মক্ষেত্রে মানসিক চাপ যুবা বয়সে হার্ট অ্যাটাকের প্রধান কারণ।
প্রচলিত চিকিৎসা
হৃদরোগ চিকিৎসায় বর্তমানে যে পদ্ধতিটি বহুল ব্যবহৃত সেটি হলো হৃদযন্ত্রের ধমনীকে প্রসারিত করে তার ভেতরে রক্ত সঞ্চালন করা এবং হৃদযন্ত্রের পেশিতে অক্সিজেনবাহিত রক্তের প্রয়োজন হ্রাস করা। সার্জিক্যাল চিকিৎসায় সংকীর্ণ ধমনীতে রক্ত সঞ্চালনের বিকল্প পথ তৈরি অথবা বেলুন প্রবেশের মাধ্যমে সেই পথ প্রসারিত করা হয়। এসবই রোগীকে সাময়িক উপশম দেয় বটে কিন্তু এর কোনোটিই হৃদরোগের মূল সমস্যার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়।
তাই বিকল্প চিকিৎসা
এটা প্রমাণিত যে, এই পদ্ধতি গ্রহণে হৃদরোগ ভাল হতে শুরু করে, এবং জীবনধারায় পরিবর্তন এনে রোগের মাত্রা থামিয়ে দেয়া যায়। এইসব পরিবর্তনের ভেতর রয়েছে: মেদযুক্ত খাদ্য পরিহার, অত্যন্ত স্বল্প মেদযুক্ত এবং নিরামিষ আহার গ্রহণ; ধূমপান বর্জন, মনোদৈনিক চাপ ব্যবস্থাপনা, নিয়মিত ব্যায়াম করা এবং মনোসামাজিক সহায়তা দান। এই জীবনধারা তাদের জন্য সুপ্রযোজ্য ও অত্যন্ত উপকারী। যারা বাধ্য হয়ে বাইপাস সার্জারি বা এনজিওপ্লাস্টি করার ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করছেন। এই বিকল্প চিকিৎসা গ্রহণ করলে বিশাল সাশ্রয় হবে।
বিকল্প চিকিৎসা প্রোগ্রামে রয়েছে
০ ডায়েট কাউন্সিলিং বা পরামর্শ অনুযায়ী খাবার গ্রহণ
০ নিয়মিত ব্যায়াম, যেমন প্রতিদিন ৩০-৪০ মিনিট হাঁটা, প্রাণায়াম, যোগ ব্যায়াম
০ গভীর প্রশান্তির জন্য চাপ গ্রহণ ও চাপ মুক্তির ব্যায়াম
০ মেডিটেশন এবং দৃশ্যমান ইমেজারি
০ অনুভূতি ভাগাভাগির ওপর জোর দিয়ে গ্রুপ আলোচনা।
কখন শুরু করবেন
জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় যৌবনেই এই সঠিক জীবনধারা গ্রহণ করা সমীচীন। পুরুষের ৩৫ বছর এবং নারীর ৪০ বছর হলেই প্রতি বছর কার্ডিয়াক বা হৃদযন্ত্রের চেকআপ জরুরি। একইসঙ্গে হৃদরোগ প্রতিরোগে ব্যবস্থা গ্রহণও অবশ্যক।
অপারেশন ছাড়াই হৃদরোগ প্রতিরোগে আরো দুটি পদ্ধতি
বায়োকেমিক্যাল এনজিওপ্লাস্টি বা চীলেশন থেরাপি : হৃদযন্ত্রের ধমনীর ব্লক অপসারণ সম্ভব বায়োকেমিক্যাল মিশ্রণের মাধ্যমে। তবে সেটা হতে হবে মানবদেহের জন্য সম্পূর্ণ নিরাপদ এবং পরিমিত মাত্রায়। এই কেমিক্যাল মিশ্রণে থাকে অ্যান্টি এক্সিডেন্টস, ইডিটিএ, ভিটামিন, আইসোটনিক, পিএইচ ভারসাম্যপূর্ণ ওষুধ। এই কেমিক্যাল মিশ্রণটি শিরার মাধ্যমে রোগীর দেহে প্রবেশ করানো হয় আড়াই ঘন্টা সময় নিয়ে। অনেকটা স্যালাইন দেওয়ার মতোই বিষয়টি।
রোগীর বয়স ও শরীরের অবস্থা অনুযায়ী এই মিশ্রণ প্রয়োগের মাত্রার রকমফের ঘটে। একজন অভিজ্ঞ ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসকই কেবল এই মাত্রার বা ডোজের বিষয়টি সঠিকভাবে নির্ধারণ করতে পারেন। এই বায়োকেমিক্যাল এনজিওপ্লাস্টি অনেক বেশি কার্যকর হয়ে থাকে যদি রোগীর জীবনধারায় ইতিবাচক পরিবর্তন আনা হয়।
প্রাকৃতিক বাইপাস থেরাপি বা ইসিপি (এক্সটার্নাল কাউন্টার পালসেশন) : স্রষ্টা আমাদের হৃদযন্ত্রে শত সহস্র ধমনী দিয়ে দিয়েছেন। তিনটি প্রধান ধমনী ১০টি শাখায় সজ্জিত, যেখান থেকে ১০০টি প্রশাখা ছড়িয়ে পড়েছে। এর আবার রয়েছে হাজারো প্রশাখা। এগুলোকে বলা হয় ক্যাপিলারিস। অনেকটা জালের মতো এগুলোর ভেতর আন্তঃসম্পদ্ধ রয়েছে: আবার প্রতিটিই অপরটির সঙ্গে রক্ত গ্রহণ ও প্রদানের সম্পর্কে সম্পর্কযুক্ত। একটি প্রধান বা অপ্রধান ধমনীতে ব্লক সৃষ্টি হলে ওই শত-সহস্র রক্তনালী হৃৎপিন্ডের পেশিতে রক্ত সঞ্চালনের প্রয়োজনীয় ভূমিকা রাখতে পারে। যদি কোনো উপায়ে ওই রক্তনালীগুচ্ছের চ্যানেলটি মুক্ত ও বিস্তৃত রাখা যায় তাহলে হৃদযন্ত্রের রক্ত সঞ্চালন প্রক্রিয়া সংহত থাকে। এটাকেই বলা হয় প্রাকৃতিক বাইপাস। এটা চালু রাখার জন্য যে চিকিৎসা পদ্ধতি প্রযোগ করা হয় তাকে বলা হয় প্যান বাইপাস।
এই প্রাকৃতিক চ্যানেলটি খেলোয়াড় ও অ্যাথলেটদের ক্ষেত্রে সাধারণত উপস্থিত থাকে। যেহেতু তাদের প্রচুর ব্যায়াম করা লাগে পুরো ক্যারিয়ার জুড়েই। তাই তাদের বেলায় ক্যাপিলারিস পরিণত হয় বর্ধিত টিউবে। এই টিউবের কারণেই শতকরা ৮০ থেকে ৯০ ভাগ ব্লকেজ দেখা দিলেও এরা বুক-ব্যথা বা এনজিনায় ভোগেন না। এমনকি ১০০ ভাগ ব্লকেজ হলেও এদের হৃদপিন্ডের মাংসপেশী বিকল হয়ে পড়ে না।
এখন প্রশ্ন করা হলো কিভাবে এই প্রাকৃতিক বাইপাস চ্যানেল সৃষ্টি করা যায়- না, আমরা একজন হৃদরোগীকে দৌঁড়বিদের মতো দৌঁড়ানোর পরামর্শ দেবো না। তাদেরকে আমরা এমন কোনো কঠিন ব্যায়ামও দেবো না যাতে বুকের সম্প্রসারণ হয়ে বুক-ব্যথা অনুভূত হবে। তবে বর্তমানে বিজ্ঞানীরা এমন একটি যন্ত্র আবিষ্কার করেছেন যেটা সমান্তরাল রক্ত-চ্যানেল সৃষ্টিতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। মেশিনটি কৃত্রিমভাবে ধমনীতে রক্তপ্রবাহ বাড়ায়। মেশিনের এক ঘন্টার সহায়তায় এই সমান্তরাল আর্টারি/ ক্যাপিলারি সিস্টেম চালু করে দেয় এবং হৃদপিন্ডের পেশিতে অতিরিক্ত রক্ত সঞ্চালন শুরু করে। সম্পূর্ণভাবে প্রাকৃতিক চ্যানেল চালু করার জন্য এই মেশিনের মাধ্যমে ত্রিশটির মতো সেশনের প্রয়োজন হয়। এভাবে খুব সহজেই বাইপাস সার্জারির বিকল্প হতে পারে এই মেশিন।
এসব বিকল্প হৃদরোগ চিকিৎসার সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো এর জন্য রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া লাগে না, কর্মক্ষেত্র থেকে সাময়িক অবসরে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না, বা এসব শরীরের ওপর কোনো আঘাতও হানে না। অপারেশনের রয়েছে নানাবিধ পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া। অপারেশনহীন এই বিকল্প হৃদরোগ চিকিৎসায় সেসবের কোনো বালাই নেই।
ডা. গোবিন্দ চন্দ্র দাস
চেম্বার : সিনিয়ন কনসালটেন্ট
শহীদ সোহরাওয়ারদী হাসপাতাল, ঢাকা। করোনারী আর্টারি ডিজিজ প্রিভেনশন এন্ড রিগ্রেশন (সিএডপিআর) সেন্টার, ৫৭/১৫ পশ্চিম পান্থপথ, ঢাকা, ফোন : ০১৯২১৮৪৯৬৯৯।
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, জুন ২৭, ২০০৯
Leave a Reply