২৬ জুন মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচারবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস
জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধসংক্রান্ত দপ্তর (ইউএনওডিসি) ১৯৮৭ সাল থেকে ২৬ জুন দিনটিকে ‘মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচারবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস’ হিসেবে পালন করে আসছে। বাংলাদেশেও এ দিনকে কেন্দ্র করে নানাভাবে মাদকবিরোধী সচেতনতা গড়ে তোলার প্রয়াস চালানো হয়। ২০০৬ সালের এক জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা ছিল প্রায় ৪৬ লাখ, আর ধারণা করা হয় বর্তমানে এ সংখ্যা ৭০ লাখের কাছাকাছি।
এর মধ্যে খুব অল্পসংখ্যকই চিকিৎসা-সুবিধা গ্রহণ করে আর বাকিরা ধাবিত হয় ভয়াবহ বিপর্যয়ের দিকে। আবার চিকিৎসা গ্রহণকারীদের মধ্যে যারা মাদকাসক্তি চিকিৎসার সব ধাপ যথাযথভাবে পাড়ি দিতে না পারে, তারা পুনরায় মাদকাসক্ত হয়ে যেতে পারে। এ জন্য প্রয়োজন সঠিক পদ্ধতিতে এবং চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে পরিপূর্ণ চিকিৎসা গ্রহণ, যদি তা দীর্ঘমেয়াদি হয় তবু ধৈর্য ধারণ করতে হবে।
মাদকাসক্তি চিকিৎসার কয়েকটি ধাপ রয়েছে। সবার আগে জানতে হবে আসক্ত ব্যক্তিটি কী ধরনের মাদকে আসক্ত। তার অন্য কোনো শারীরিক বা মানসিক রোগ আছে কি না। মাদকাসক্তির কারণে বর্তমানে তার কী কী সমস্যা হচ্ছে। এর পরের ধাপ হচ্ছে ‘ডিটক্সিফিকেশন’ বা শরীর থেকে মাদকের ক্ষতিকারক উপাদানগুলোকে দূর করা।
এ পর্যায়ে আসক্ত ব্যক্তিকে প্রয়োজনে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়, মাদক-নির্ভরতার কারণে যেসব ‘উইথড্রয়াল’ সমস্যা হয়, এর মোকাবিলা করতে হয়, পাশাপাশি সাইকিয়াট্রিস্টের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে ওষুধ সেবন করতে হয়। এ সময়টিতে আসক্ত ব্যক্তির পুষ্টি নিশ্চিত করা দরকার। লক্ষ রাখতে হবে যে তার শরীর যাতে পানিশূন্য হয়ে না যায়। এর পরের ধাপটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ, সেটি পুনর্বাসন ও এর মধ্যে মাদকমুক্ত থাকার প্রেরণা ধরে রাখা। এ সময় তাকে সামাজিক ও পারিবারিকভাবে সহায়তা করতে হয়। তার শিক্ষা ও পেশাগত দক্ষতা ফিরিয়ে আনতে সহায়তা করা। এ পর্যায়ে তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে কাউন্সেলিং। এই কাউন্সেলিং বা পরামর্শ সেবা নিয়ে আমাদের দেশে অনেক বিভ্রান্তি রয়েছে।
অনেকে মনে করে থাকে যে কেবল কাউন্সেলিং দিয়েই মাদকাসক্তি নিরাময় করা সম্ভব, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কাউন্সেলিং সামগ্রিক প্রক্রিয়ার একটা ধাপ মাত্র। এর আগে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শে মাদকাসক্তি নিরাময়ের বিভিন্ন ধাপ অতিক্রম করে আসতে হবে।
বাণিজ্যিক প্রচারণার কারণে অনেক সময় কাউন্সেলিংকে একমাত্র চিকিৎসা-পদ্ধতি হিসেবে দেখানো হয়, পাশাপাশি একই ধরনের প্রচারণায় ওষুধ ও চিকিৎসকের ভূমিকাকে গুরুত্বহীন করা হয়। এতে ফল হয় মারাত্মক। মাদকাসক্ত ব্যক্তির অভিভাবকেরা ডিটক্সিফিকেশন ও মাদক-নির্ভরতার রাসায়নিক কার্যকারণ দূর করার বিশ্বস্বীকৃত ওষুধভিত্তিক গুরুত্বপূর্ণ ধাপ বাদ দিয়ে কেবল কাউন্সেলিংয়ের পেছনে দৌড়ান আর তাঁদের সন্তানের চিকিৎসা হয় আংশিক বা খণ্ডিত। ফলে আপাতসুস্থ ব্যক্তিটির পুনরায় মাদকাসক্ত হওয়ার হার বেড়ে যায়, যাকে বলা হয় ‘রিল্যাপ্স্’। এ ছাড়া মনে রাখতে হবে, কাউন্সেলিং এক ধরনের চিকিৎসা-পদ্ধতি। তাই দক্ষ, প্রশিক্ষিত বা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃত উপযুক্ত ব্যক্তি ছাড়া অন্য কারও কাছ থেকে এ সেবা নিলে তা সুফল বয়ে আনবে না। মাদকাসক্তি নিরাময়ে কাউন্সেলিং নানাভাবে দেওয়া যেতে পারে। সাধারণত ছয় থেকে আটটি সেশন লাগে, তবে এর বেশিও লাগতে পারে। তিন থেকে সাত দিন পর পর সেশন নেওয়া হয় আর সেশনের সময়সীমা গড়ে প্রায় ৪০ মিনিট। মাদকাসক্ত ব্যক্তির সার্বিক ইতিহাস গ্রহণ, শারীরিক ও মানসিক অবস্থা বিবেচনা করার পর তাকে কাউন্সেলিং দেওয়া হয়। একটি ছয় সেশনের কাউন্সেলিংয়ে যে বিষয়গুলোর দিকে নজর দিতে হবে তা হলো-
প্রথম সেশন
— মাদকের কুপ্রভাব
-ব্যক্তির নিজের ওপর।
-তার পড়ালেখা বা পেশার ওপর।
-বন্ধুবান্ধব, সহকর্মী বা পরিচিতজনদের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে।
-মা-বাবা, স্ত্রী, পুত্র, কন্যা ও পরিবারের অন্য সবার ওপর।
— মাদকের সুফল (?) সে কি ভোগ করছে (মাদক গ্রহণে তার ভালো লাগে কেন)?
— মাদকাসক্তি নিরাময়ে তার নিজস্ব কী কী ভালো দিক (যেমন-পারিবারিক সহায়তা, ভালো পরিবেশ, ভালো চাকরি, ভালো একাডেমিক রেকর্ড, অন্য কোনো রোগ না থাকা) আর কী কী দুর্বল দিক (অসৎ বন্ধুবান্ধব, পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় না হওয়া, পরিবারে আরও কোনো মাদকাসক্ত ব্যক্তির উপস্থিতি ইত্যাদি) শনাক্ত করা প্রয়োজন।
— মাদক নিরাময়ে তার ভালো দিকগুলো কীভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে সে বিষয়ে আলোচনা করতে হবে।
দ্বিতীয় সেশন
— মাদক-নির্ভরতা কীভাবে হয়।
মাদক-নির্ভরতা দূর করতে ওষুধের প্রভাব ও এর প্রয়োগবিধি। মাদকাসক্তি সংশ্লিষ্ট জটিলতার (যেমন-এইচআইভি, হেপাটাইটিস-বি সংক্রমণ) ঝুঁকি হ্রাস কীভাবে করা যায়।
তৃতীয় সেশন
— ল্যাবরেটরি পরীক্ষার (ইউরিন টেস্ট) গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা। — নিয়মিত ওষুধ গ্রহণ ও আনুষঙ্গিক চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়ার গুরুত্ব, এ ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসার বিষয়ে বিশেষ জোর দিতে হবে।
চতুর্থ সেশন
— জীবনের ইতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরা। — সুন্দর জীবনে ফিরে যাওয়ার প্রক্রিয়া। — মানুষের জীবনে সুস্থ বিনোদনের গুরুত্ব।
পঞ্চম সেশন
— মাদকাসক্ত হওয়ার কারণে তার প্রতি অপরের দৃষ্টিভঙ্গি এবং এ বিষয়ে তার মতামত। — স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার পথে অন্তরায় কী কী? এগুলো অতিক্রম করার উপায়।
ষষ্ঠ সেশন
— বন্ধু, স্বজন, সন্তানের জন্য কী ধরনের দৃষ্টান্ত মাদকাসক্ত ব্যক্তিটি রাখতে চায়।
— কী করে মাদককে ‘না’ বলতে হবে।
বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে রোগীর পাশাপাশি তার অভিভাবক বা তার স্ত্রী বা স্বামীকেও কাউন্সেলিং করার দরকার হতে পারে। কাউন্সেলিং গ্রহণ করতে আসা ব্যক্তি ও তার পরিবারের সঙ্গে সম্মানজনক ব্যবহার করতে হবে। আসার জন্য তাদের ধন্যবাদ দিয়ে কাউন্সেলিং শুরু করা উচিত। রোগীর সব তথ্যের গোপনীয়তা বজায় রাখার বিষয়ে তাকে বা তার পরিবারকে আশ্বস্ত করতে হবে। এমনকি নোট নেওয়ার জন্য রোগী বা অভিভাবকের অনুমতি নেওয়া জরুরি। কথা বলতে হবে কম, শুনতে হবে বেশি। আর এ শোনাটা যে কার্যকরী ও মনোযোগের সঙ্গে হচ্ছে, তা বোঝানোর জন্য রোগীর বলার ফাঁকে ফাঁকে তার কথার প্রতিক্রিয়া দেখাতে হবে, সে যা বলতে চাইছে সংক্ষেপে এর পুনরাবৃত্তি করা প্রয়োজন। রোগীর অনুভূতির মূল্যায়ন এমনভাবে করতে হবে, যাতে সে মনে করে কাউন্সেলর তার প্রতি মনোযোগী। রোগীকে পরের সেশনের জন্য কিছু হোমওয়ার্ক ধরনের বিষয় দিতে হবে, আর প্রতি সেশনের শুরুতে আগের সেশনটি সংক্ষেপে আলোচনা করা যেতে পারে। মনে রাখতে হবে, কাউন্সেলিং মানে রোগীর প্রতি একগাদা উপদেশ বর্ষণ নয় বরং সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে তাকেই তার বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করা। মাদকাসক্তি চিকিৎসায় কাউন্সেলিংয়ের গুরুত্ব অপরিসীম। তাই এর সুনির্দিষ্ট ও যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করার পাশাপাশি কাউন্সেলিংয়ের নামে বিভিন্ন স্থানে যে বাণিজ্যিক প্রচারণা ও প্রতারণা চালানো হচ্ছে, সে বিষয়েও সচেতন হওয়া প্রয়োজন।
ঝুনু শামসুন নাহার
অধ্যাপক, মনোরোগবিদ্যা বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
আহমেদ হেলাল
বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুন ২৪, ২০০৯
Leave a Reply