বর্ষা এলেই ডেঙ্গুজ্বরের কথা বিশেষভাবে মনে হয়। ডেঙ্গুজ্বর বাড়ছে বিশ্বজুড়েই। জলবায়ুর পরিবর্তনে ডেঙ্গুজ্বর বাড়ছে বলে মনে হয়। অনেক সময় এ জ্বর এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে সেখান থেকে রোগীকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয় না। ব্যাংককে আমেরিকার বৃহত্তম বহির্বিশ্ব চিকিৎসা গবেষণা ল্যাবরেটরিতে সামরিক বাহিনীর বিজ্ঞানীরা ডেঙ্গুর একটি টিকা আবিষ্কারের চেষ্টা চালাচ্ছেন।
মশাবাহিত এই ডেঙ্গুজ্বরের নাম একসময় ছিল হাড়ভাঙা জ্বর। হাড়ের গিঁটে ও পেশিতে হয় প্রচণ্ড ব্যথা। মাথা এত ধরে যে মনে হয় ফেটে পড়বে। তবে মৃত্যুর হার ছিল কম। হাসপাতালবাসীর মধ্যে এ হার ছিল ২·৫ শতাংশ-বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন।
যেহেতু রোগীদের প্রয়োজন হয় অনবরত সযত্ন, সতর্ক তদারকি; সে জন্য গ্রী্নমণ্ডলীয় দেশগুলোতে এ রোগ হলে খরচ অনেক বেশি। প্রতিবছর বিশ্বজুড়ে এ রোগে হাসপাতালবাসী হয় পাঁচ লাখ লোক। একটা ব্যাপার হলো, গ্রী্নমণ্ডলীয় অনেক রোগের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমেছেন সেনাবাহিনীর সদস্যরা। গবেষণাগারে ঘটছে সে লড়াই। ডেঙ্গুর টিকা আবিষ্কারের চেষ্টা চলছে, অর্থ ও গবেষণার জোগান দিচ্ছে থাই সরকার। বিল ও মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের মতো অলাভজনক সংস্থা এবং গ্লাক্সো ্নিথক্লাইনের মতো ওষুধশিল্পের প্রতিষ্ঠান। ব্যাংককের আর্মিল্যাবে ফরাসি ওষুধশিল্পের প্রতিষ্ঠান সানোফি অ্যাভেনটিস ও থাইল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ উদ্যোগে আরও একটি ডেঙ্গুজ্বরের টিকা পাঁচ-সাত বছরের মধ্যে বেরোবে বলে বিজ্ঞানীদের আশা। ডেঙ্গু ভাইরাস ছড়ায় যে মশার মাধ্যমে, এর নাম হলো এডিস (এডিস ইজিপটাই)। মানুষের রক্তে এর বসবাস, বেঁচে থাকা। এডিস কদাচিৎ তার জন্মস্থল থেকে ১০০ গজ দূরে যায়। আর ঘন-ঘিঞ্জি এলাকাতেই বেঁচে থাকা, স্বচ্ছন্দে তো অবশ্যই। সোডার বোতলের মতো ছোট আধারে যেমন এদের জন্ম হতে পারে, তেমনি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার পানির বড় বড় আধার হলো এদের জন্ম ও বৃদ্ধির আদর্শস্থল। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক থমাস ডব্লু স্কট, যিনি একজন বিশেষজ্ঞ এই প্রজাতির, তিনি বলেন, অন্যান্য মশার চেয়ে ভিন্ন এডিস ইজিপটাই, এরা পছন্দ করে স্বচ্ছ ও পরিষ্কার পানি।
হিম হিম পরিবেশে এ মশা বেঁচে থাকতে পারে না। এরা মূলত অন্দরের মশা। লুকিয়ে থাকে ছোট ঘরে, পায়খানায় বা পর্দার পেছনে আর আলমারির খুপচিতে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতিবছর ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয় পাঁচ কোটি মানুষ। তবে সংক্রমিত ৯০ শতাংশের বেশি মানুষের সামান্য ফ্লু-জ্বরের মতো হয়, কারও কারও তেমন উপসর্গ হয় না। রোগ গুরুতর হলে রোগীর প্রচণ্ড মাথাধরা হতে পারে। হঠাৎ করে প্রবল জ্বর, গিঁট ও পেশিতে প্রচণ্ড ব্যথা, বমি ভাব এবং অনেক সময় দেহের ভেতর রক্তক্ষরণ হতে পারে। তবে সময়মতো রোগীকে হাসপাতালে নিলে এবং রোগ চিহ্নিত হলে সুস্থ হয় রোগী। বিজ্ঞানীদের ধারণা, এই রোগটি ছিল শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে-১৭৮০ সালে ফিলাডেলফিয়ায় এর প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল। তবে গত অর্ধশতকে ডেঙ্গু সচরাচর দৃষ্ট হয়েছে, হয়েও উঠেছে আরও ভয়ঙ্কর।
১৯৭০ সালে মাত্র নয়টি দেশে ডেঙ্গুরোগের ভয়ানক রূপ ‘ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার’-এর স্থানিক প্রাদুর্ভাব ছিল। ১৯৯০ সালের মধ্যভাগে এই সংখ্যা হলো চারগুণ এবং বিশেষজ্ঞদের ধারণা, আশ্চর্য এক ছলে এ রোগটি আকাশভ্রমণ আর আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের এ যুগের সঙ্গে মানিয়ে নিল। ডেঙ্গু ভাইরাস চার রকম। যেসব রোগী এর যেকোনো একটি দ্বারা সংক্রমিত হয়, এরা কেবল সেই ধরনের ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ শক্তি অর্জন করে। তবে এই দ্বিতীয় ধরনের ভাইরাসের মুখোমুখি হলে অনেক সময় ডেঙ্গু হেমোরেজিক জ্বর হতে পারে। এই চার রকম ভাইরাসই আকাশযানে বাহিত হচ্ছে দূরদেশে, এমনকি নির্দিষ্ট উড়ালপথে ও বাণিজ্যপথে অনুসরণ করা যায় হেমোরেজিক ফিভারের প্রকোপ। এভাবেই ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশ্বে। সম্ভবত সেনাবাহিনীর সদস্যদের মাধ্যমে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রথম ডেঙ্গু হেমোরেজিক জ্বরের বিস্তার ঘটেছিল। ইংল্যান্ড, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও জাপানে সেনাদলের অভিযান, নগর থেকে নগরে দুরন্ত অভিযান এ রোগ বিস্তারে সহায়ক হয়েছে-বলেন ডেঙ্গু গবেষণার একজন প্রধান বিজ্ঞানী ও অগ্রপথিক ডা· সুচিত্রা নি্নান্বিতা। যুদ্ধের সময় এই ভাইরাস শনাক্ত ও আলাদা করেন একজন বিজ্ঞানী এবং আমেরিকার একজন সেনাচিকিৎসক আলবার্ট সাবিন আবিষ্কার করেন, কয়েক ধরনের ভাইরাস এ ডেঙ্গু ছড়ায়। সিডিসির সাবেক কর্মকর্তা ও শিশুদের ডেঙ্গু টিকা আবিষ্কার প্রচেষ্টার পরিচালক ডা· হেরোল্ড এস মার্গোলিস বলেন, ‘আমি অনেক বছর ধরে সংক্রামক রোগ নিয়ে কাজ করেছি, সবচেয়ে জটিল হলো ডেঙ্গু নিয়ে কাজকর্ম।’ এ জন্য ডেঙ্গুর টিকা আবিষ্কার বেশ কঠিন। কারণ চার ধরনের ভাইরাসের বিরুদ্ধেই দিতে হবে প্রতিরোধ। ডেঙ্গু একক একটি ভাইরাস রোগ হলে এত দিনে টিকা বেরিয়ে যেত। সানোফির ডেঙ্গু টিকা জিন প্রযুক্তিতে নির্মিত এবং ইতিমধ্যে থাইল্যান্ডে চার হাজার শিশুর ওপর প্রয়োগ করা হয়েছে কয়েক মাসে। দুর্বলীকৃত ভাইরাস দিয়ে প্রচলিত পদ্ধতিতে নির্মিত সেনাসদস্যদের উদ্ভাবিত টিকাও আমেরিকা, পোয়েটোবিকো ও থাইল্যান্ডে পরীক্ষা করা হয়েছে। দু-তিনটি ডোজ ইনজেকশন। এই টিকা কার্যকর প্রমাণিত হলেও উন্নয়নশীল দেশের মানুষের কাছে সুলভ ও সাশ্রয়ী মূল্যে এলে বড় একটি কাজ হবে। অনেকেই এখন টিকা উদ্ভাবন ও বিপণনের সঙ্গে জড়িত। এই প্রতিযোগিতায় সাফল্য ও সাশ্রয়ী মূল্যে আনার মতো কাজ দুটোই অর্জিত হবে বলে মনে হয়।
অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরী
পরিচালক, পরীক্ষাগার সেবা
বারডেম হাসপাতাল, ঢাকা
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুন ১৭, ২০০৯
Leave a Reply