অক্টোবরের শেষেও ডেঙ্গুর বিস্তার বাড়ছে। বাড়ছে মৃত্যুহারও। এই সংক্রামক রোগ হলেই যে মানুষের মারা যাওয়ার আশঙ্কা প্রবল, তা কিন্তু নয়। তবে কখনো কখনো পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠলে মৃত্যুঝুঁকি বাড়ে। তাই সতর্ক থাকার কোনো বিকল্প নেই।
ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ৮০ শতাংশই উপসর্গবিহীন কিংবা তাঁদের সাধারণ জ্বরের মতো সামান্য উপসর্গ থাকে। বাকি ৫ শতাংশের রোগ জটিল আকার ধারণ করে। খুবই অল্প কিছু ক্ষেত্রে এটি প্রাণঘাতী হয়। ইনকিউবিশন পিরিয়ড (ভাইরাস দেহে প্রবেশের পর থেকে রোগের সূত্রপাতের মধ্যবর্তী সময়) স্থায়ী হয় ৩ থেকে ১৪ দিন, কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তা ৪ থেকে ৭ দিন। শিশুদের প্রায়ই ভিন্ন ধরনের উপসর্গ হতে পারে, যেমন সাধারণ সর্দি-জ্বর ও গ্যাস্ট্রোএন্টেরাইটিস (বমি ও ডায়রিয়া)। সাধারণত বড়দের চেয়ে শিশুদের উপসর্গের তীব্রতা কম হয়, কিন্তু তারাই রোগের জটিলতার শিকার হয় বেশি।
ডেঙ্গুবাহী মশা কামড়ানোর দুই থেকে সাত দিন পর উপসর্গ স্পষ্টভাবে লক্ষণীয় হয়। সাধারণ উপসর্গ হলো জ্বর, যা ১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত উঠতে পারে। বিরামহীন মাথাব্যথা, হাড়, সন্ধি ও পেশিতে তীব্র ব্যথা, বমি ভাব বা বমি হওয়া, গ্রন্থি ফুলে যাওয়া, সারা শরীরের ফুসকুড়ি, চোখের পেছনে ব্যথা হওয়া ইত্যাদি। ডেঙ্গু যদি প্রথমবার আক্রান্ত করে এবং এটি যদি তরুণ বা শিশুদের হয়, তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে উপসর্গ মৃদু থাকে বা না-ও থাকতে পারে। এমনকি জ্বর না-ও হতে পারে। টিপিক্যাল ডেঙ্গু বা ক্ল্যাসিক্যাল ডেঙ্গুতে জ্বরের সঙ্গে সর্দি-কাশি থাকতে পারে।
সংক্রমণের কোর্স তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত: প্রাথমিক, প্রবল ও আরোগ্য।
প্রাথমিক পর্যায়ে থাকে অত্যধিক জ্বর (১০৪ ডিগ্রি°ফারেনহাইট বা তার বেশি), মাথা ও শরীরব্যথা। এটি সাধারণত দুই থেকে সাত দিন স্থায়ী হয়। এই পর্যায়ে ৫০ থেকে ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রে ত্বকে দানা বা র্যাশ দেখা যেতে পারে। মুখ ও নাকের মিউকাস মেমব্রেন থেকে অল্প রক্তপাতও হতে পারে।
কিছু লোকের ক্ষেত্রে রোগ চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায়। রক্তনালির ভেতরকার তরল বা প্লাজমা বেরিয়ে এসে ফুসফুসের পর্দা ও পেটের ভেতর জমা হয়। এর কারণ ক্ষুদ্র রক্তনালি বা ক্যাপিলারি লিকেজ। এতে রক্তপ্রবাহে তরলের পরিমাণ কমে যায় এবং গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গে রক্ত সরবরাহ হ্রাস পায়। এ পর্যায়ে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিকল বা অকার্যকর হতে পারে। হার্ট বা কিডনি অকার্যকর হলে বুকে পানি জমা, শ্বাসকষ্ট, অক্সিজেন সরবরাহ কমে যাওয়া ইত্যাদি জটিলতা হতে পারে। ৫ শতাংশের কম ক্ষেত্রে এ ধরনের ডেঙ্গু শক সিনড্রোম ও ডেঙ্গু হেমারেজিক ফিভার ঘটে। যাঁদের আগেই ডেঙ্গু ভাইরাসের অন্যান্য স্টিরিওটাইপের সংক্রমণ ঘটেছে, তাঁদের ঝুঁকি বেশি।
ঝুঁকিপূর্ণ সময় অতিবাহিত হলে আরোগ্য পর্যায়ে বেরিয়ে যাওয়া তরল রক্তপ্রবাহে ফেরত আসে। এটি সাধারণত দুই থেকে তিন দিন স্থায়ী হয়। এ সময় আবার চুলকানি ও হৃৎস্পন্দনের গতি ধীর হতে পারে। ম্যাকুলোপাপুলার বা ভাসকুলাইটিক রূপে আরেক রকম র্যাশও বেরোতে পারে। এতে ত্বকে গুটি বেরোয়। এ পর্যায়ে তরলের অতিপ্রবাহ অবস্থা ঘটতে পারে। এতে যদি মস্তিষ্ক আক্রান্ত হয়, তাহলে সচেতনতার মাত্রা হ্রাস অথবা মূর্ছা যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। এরপর ক্লান্তি অবসাদ কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত থাকতে পারে।
ডেঙ্গুর জটিলতা যে কারও হতে পারে। তবে যাঁদের আগে সংক্রমণ হয়েছে এবং শিশু, অতি বয়স্ক, হৃদ্রোগী, কিডনি রোগে আক্রান্ত এবং অন্তঃসত্ত্বা নারীদের ঝুঁকি বেশি। ডেঙ্গুর এ মৌসুমে তাই জ্বর হলেই ডেঙ্গু পরীক্ষা করতে হবে এবং চিকিৎসকের নির্দেশনা অনুযায়ী চলতে হবে।
লেখা: অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আজিজুর রহমান, মেডিসিন ও বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ
সূত্র : প্রথম আলো
Leave a Reply