দেশ বিদেশ থেকে যখন সংক্রমণের খবর টিভি বা সংবাদ পত্রে প্রকাশ হতে শুরু করল আমরা প্রথম ভাবছিলাম যে এই সমস্যাটা হয়তো ইউরোপ, ইতালি, আমেরিকার মতো কিছু কিছু দেশে হবে। আমাদের হবে না!
এর পর জানুয়ারির ৩০ তারিখ ভারতবর্ষ, ইরান, ইতালি-এই তিনটি দেশে একসঙ্গে সংক্রমণ প্রবেশ করে। এর পরে ইরান, ইতালিতে অনেক তাড়াতাড়ি ছড়িয়ে পড়ল। ২০২০-র জানুয়ারি থেকে সমক্রমণ ঢুকে পড়ল বটে তবে এর থেকে কী ধাক্কা হতে পারে তা আমরা ঠিক বুঝিনি। মার্চ-এপ্রিল-মে-জুন পর্যন্তও আমরা ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি যে জিনিসটা কী? আমাদের দেশেও কতটা এর প্রভাব পড়তে পারে?
ওই বছর মার্চে লকডাউন করা হয়েছিল বটে তবে, লকডাউনের মাসটা ঠিক ছিল বছরটা নয়। আমাদের দেশে লকডাউনটা যদি মার্চ ২০২০-তে না হয়ে মার্চ ২০২১-তে হত তাহলে অনেকগুলো প্রাণ আমরা বাঁচাতে পারতাম।
এর পর ওই বছর জুন নাগাদ লকডাউনটা যখন হালকা হতে শুরু করল তখনই সংক্রমণের প্রথম ধাক্কাটা বাড়তে শুরু করল, মোটামুটি সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সংক্রমণ বাড়ল। এর পর অক্টোবরটা একটু নিম্নমুখী হল। শীতকালটা মোটামুটি রেহাই দিল। ফেব্রুয়ারিতে আমরা ভাবলাম ইনফেকশানটা নেই বা আর ঝামেলা আসবে না। তখন কিছু রাজ্য সরকার, কেন্দ্র সরকার গা ঢিলে দিতেই আবার আগুনের আঁচ বাড়তে শুরু করল। এর মধ্যে আমরা কতগুলো বাজে সিদ্ধান্ত নিলাম যেমন- কুম্ভ মেলা হল, ৫টি রাজ্যে ভোট শুরু হল। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে তো ২ মাস ধরে ভোট হল। এমনিতে সংক্রমণ নিজস্ব গতিতেই বাড়ছিল এর মাঝে আমরা খানিকটা আগুনে ওই জল না ঢেলে তেল ঢালার প্রক্রিয়া শুরু করে দিলাম। দাউ দাউ করে বাড়তে শুরু করল!
দ্বিতীয় তরঙ্গের দিক হল ২০২১-এর মে মাসের মাঝামাঝি। যদি সেকেন্ড ওয়েভের পর্যালোচনা করা হয় সেটা মোটামুটি প্রথম ওয়েভের সাত সাড়ে সাত মাস পর হয়েছে। এর ফলে পাঁচগুণ বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। দ্বিতীয় তরঙ্গের সংক্রমণ মানুষকে অসুস্থ করল বেশি। এবং কয়েক মাসের মধ্যে বোঝা গেল এটি ছড়িয়ে পড়ার ক্ষমতাটা তার পূর্বসূরি ভ্যারিয়েন্টের থেকে ৫ গুণ বেশি।
যদিও এর অনেকগুলো কারণ ছিল। এর মধ্যে আমাদের ঢেলিমি, ভোট, কুম্ভ মেলা। তো সব মিলিয়ে আমরা একেবারে নাজেহাল অবস্থায় পড়লাম। যত মানুষ ভারতবর্ষে মারা গিয়েছেন তাঁর দুই তৃতীয়াংশ অফিশিয়ালি মারা গিয়েছেন দ্বিতীয় তরঙ্গে।
এখন আমরা যে স্টেজে আছি তাতে সংক্রমণ কিছুটা ক্ষমাঘেন্না করতে শুরু করেছে। জুন জুলাই অগস্ট এখন হয়ে গিয়েছে। এর পর ক্ষিপ্র গতিতে চলছে টিকাকরণ শুরু হল। দেড় মাসের মধ্যে কিছুটা কমতে শুরু করে। এই যে আমরা দুটো-তিনটে মাস একটু কাটিয়ে উঠতে শুরু করলাম এর মাঝে কেরালায় বাড়তে শুরু করেছে সংক্রমণ। এখন প্রশ্ন হচ্ছে সংক্রমণ চারিদিকে কমে গেলে এখন এই রাজ্য কেন টকবক করে ফুটছে?
এর কারণ হল কেরালায় সেকেন্ড ওয়েভ আসেনি। আর ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট এসে যাওয়ার কাদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে? কারা বেশি করে আক্রান্ত হতে পারে?
ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট তাদেরই হবে, যাদের সঙ্গে এই ভাইরাসের মুখোমুখি পরিচয় হয়নি, যাদের কোনও ইমিউনিটি নেই, যারা আগেই আক্রান্ত হয়ে সেরে উঠে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে, যাদের টিকার দুটো ডোজ হয়ে গিয়েছে তাদের এর থেকে রাহাই মিলতে পারে।
কিন্তু কেরালায় ওনাম-সহ কিছু উৎসব পালন করা হয়েছে যার ফলে সংক্রণের সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছে। এ ছাড়া কেরালায় জনঘনত্ব বেশি, যদিও তা আমাদের রাজ্যের তুলনায় অনেকটাই কম। আর কেরালায় কোনও গ্রাম নেই, কারণ গ্রাম হলে ছড়িয়ে পড়ার ধারাটা যাকে আমরা ট্রান্সমিশন বলি সেটা আটকে যায়। গ্রামে লোক কম থাকে শহরের তুলনায় এর ফলে সংক্রমণটা কম হয়। কিন্তু কেরালায় ছোট শহর বড় শহর রয়েছে এর ফলে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে অনেকটাই।
সেই কারণে থামাতে একটু অসুবিধা হচ্ছে, তবে ওদের ভালো কাজ এটা যে ওরা অনেক বেশি পরীক্ষা করছে। সেকেন্ড ওয়েভে অন্য রাজ্যে যে তুলনায় মানুষ মারা গিয়েছে, সেখানে কেরালায় মৃত্যু হয়েছে .২% থেকে .৩% শতাংশ। আমরা যদি বলি ৯০% মাইল্ড ইনফেকশন বাকি ১০% সিরিয়াস হয়। তাহলে এই ১০%ভবিষ্যতে বড় আকার নেবে। এখন অনেক জায়গায় নাইট কার্ফু শুরু হয়েছে। এ সবে যদিও অবশ্য কোনও কাজ হয় না। এখনকার পরিস্থিতি বললে, সারা ভারতবর্ষ কেরালাকে বাদ দিলে, কেরালা হচ্ছে গোটা দেশে দুই থেকে আড়াই শতাংশ। এই দুই থেকে আড়াই শতাংশটা বাদ দিলে সারাদেশে যদি ১২০ কোটি জনসংখ্যা হয় তার মধ্যে কেরলাকে বাদ দিলে ভারতের অবস্থাটা কিন্তু খুব একটা খারাপ নয়।
আমাদের ৩০ হাজার লোকের অ্যান্টিবডি স্টাডি করা হয়েছে, রাজ্যে ৪ জেলার লোকেদের স্টাডি করা হয়েছিল, যেখানে ৬৭.৮% মানুষের অ্যান্টিবডি রয়েছে শরীরে। এই যে সকলে বলছে থার্ড ওয়েভ আসছে। এক্ষেত্রে কারা বেশি সংক্রামিত হতে পারে, আমাদের রাজ্যে যদি ১০ কোটি জনসংখ্যা হয় তার মধ্যে ৬০%-এর শরীরে অ্যান্টিবডি। তাহলে হিসেব করলে দাঁড়ায় অ্যান্টিবডি নেই এমন মানুষের সংখ্যা আমাদের রাজ্যে প্রায় ৪ কোটি। তাই সব সময় সাবধনতা বজায় রাখতে হবে যাতে সংক্রমণ ছড়িয়ে পরতে না পারে।
এর মধ্যে শঙ্কার ভবিষ্যদ্বাণী থার্ড ওয়েভ। থার্ড ওয়েভ কী?এর অর্থ হল আবার অল্প সময়ে প্রচুর সংখ্যক মানুষের মধ্যে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়বে। খালি সেই পরিবেশ পরিস্থিতি যদি তৈরি হয়, যে পরিস্থিতি পরিবেশে বহু মানুষের কাছে বহু অল্প সময়ের মধ্যে পৌঁছে যেতে পারে।
আজকে যদি কলকাতায় ১০০ জনের মধ্যে সংক্রম ছড়িয়ে যায় তাহলে। আমাদের গায়ে লাগবে, এর বেশি হলে হাহুতাশ করতে শুরু করব। তবে, এই কথাটা মাথায় রাখতে হবে যেটিকে স্তিমিত রাখা দরকার তাকে খুঁচিয়ে ঘা করলে চলবে না।
টিকাকরণ যেভাবে হচ্ছে, আমরা গত তিন সপ্তাহের কথা যদি দেখি, ভারতবর্ষে Average Rate Of Vaccination অনেকটাই ইমপ্রুভমেন্ট হয়েছে। Average Daily Vaccination প্রায় ৭ লক্ষের উপরে। অনেকটাই ইমপ্রুভ হয়েছে। কেন হয়েছে? কারণ, কোভিশিল্ড অনেক বেশি তৈরি হয়েছে। এটা নিয়ে আমরা কিছুটা স্বস্তিতে রয়েছি। কিন্তু তার সঙ্গে আমরা জটিলতার কারণে আটকে রাখেছি ফাইজার এবং মর্ডানাকে। এর ফলে Logical কাজ হচ্ছে না। ফাইজার এবং মর্ডানাকে আমরা যদি হাতে পাই তাহলে সপ্তাহে এক এক দিন এক কোটি করছি বাকিটা আবার ৭০ লক্ষে নেমে আসছে। ফাইজার এবং মর্ডানাকে আনলে দেখা যাবে যে আমাদরে প্রায় Avarage Daily Rate- ১ লক্ষ করতে পারব। করোনার এই স্টেজে ফাইজার এবং মর্ডানাকে পারমিশনটা দেওয়া দরকার বলে মনে হয়।
তবে, আমার একটু অস্বস্তি এবং আক্ষেপ আছে। তার কারণ পশ্চিমবঙ্গে যে ক্ষিপ্র গতিতে ভ্যাক্সিনেশন হওয়ার কথা, সেটা হচ্ছে না। পশ্চিমবঙ্গে মেরে কেটে একদিন বা দু’দিন ১০ লক্ষের উপর টিকাকরণ হয়েছে। আমরা যদি টিকার ফার্স্ট ডোজ কতটা হয়েছে আমাদের রাজ্যে দেখি, তাহলে হিসেবটা দেখায় পশ্চিমবঙ্গ সবেমাত্র ৫০% শেষ করেছে। কেননা, আমার মনে হয় রাজ্যে যা টিকাকরণ হচ্ছে তা মূলত শহর কেন্দ্রিক। রাজ্যের প্রান্তিক এলাকায় আমার মনে হয় না সেই অর্থে টিকাকরণ হচ্ছে ।
তৃতীয় ঢেউকে আটকাতে হলে মূলত টিকাকরণ বাড়াতে হবে। আমার মনে হয় এখন আরও টানা ২-৩ মাস ভিড়ভাট্টা করা উচিত নয়। বড় বড় জমায়েত নিষিদ্ধ রাখা হোক। আর তৃতীয় ঢেউকে আটকাতে হলে গ্রাম হোক শহর হোক বা মফসল। যেখানে সংক্রমণ হয়নি, সেখানে যদি সংক্রমণ ধরা পড়ে, সঙ্গে সঙ্গে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে। যাঁরা পজিটিভ হয়েছে তাঁদের আলাদা করে উপযুক্ত চিকিৎসা এবং আইসোলেশনের মধ্যে রাখতে হবে। Spread Of Infection-কে ঠেকাতে হলে দেওয়ালে পিঠ দিয়ে রুখতে হবে।
ছোট ছোট অঞ্চলভিত্তিতে নজরদারি বাড়তে হবে। যদি কোথাও সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে সেখানে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। প্রত্যেকটা অঞ্চল থেকে সঠিক তথ্য সংগ্রহ করে কোভিড পরীক্ষা বাড়াতে হবে।
ভ্যাক্সিনেশন, লোকাল সারভিলিয়েন, ভিড় বা জমায়েত থেকে দূরে থাকা, সঠিক নিয়মে মাস্ক পরা-এই চারটি জিনিস মাথায় রেখে আমরা এই বছরটা যদি চলতে তাহলে অনেকটাই সুরক্ষিত হতে পারব। প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ‘হার্ড ইমিউনিটি’ একটা সময় মনে করা হত। এখন ডেল্টা ভ্যরিয়েন্টের আক্রমনের ফলে এই হার্ড ইমিউনিটি তৈরির ভাবনাটাই মিথ্যে হয়ে গিয়েছে এখন সকলেই টিকাকরণ করতে হবে। তবেই আটতে পারা যাবে তৃতীয় ঢেউকে। টিকার দুটো ডোজ নেওয়ার পরেও সংক্রণ হচ্ছে অনেকেরই, তবে তা খুবই নগন্য।
Health and Fitness Tips in Bengali শরীর-গতিক, Yoga and Exercise Tips in Bangla
2021-09-09 19:18:34
Source link
Leave a Reply