আমি যে সময়ের কথা বলছি, তখন ডায়াবেটিস সম্পর্কে এত জানা ছিল না। অনীকের (কাল্পনিক নাম) বয়স যখন ১৬, তখন তাঁর চিকিৎসক বলেছিলেন, ‘এমন অসুখ, আয়ু বড়জোর ১৫-১৬ বছর।’ অনীকও তা বিশ্বাস করেছিলেন। মনে করেছিলেন, মধ্য ত্রিশ পেরোনোর আগেই তো পরলোকপ্রাপ্তি। অনীক বিশ্বাসের বয়স এখন ৫৪। মনে হয়েছিল, এ যেন মৃত্যুদণ্ড। টাইপ-১ ডায়াবেটিস রোগ নির্ণয়ের পর তো তা-ই ঘটেছিল। শৈশবকালীন ডায়াবেটিস।
ডায়াবেটিসের মতো ক্রনিক রোগে শরীরে ইনসুলিন তৈরি হয় না বা শরীরে ইনসুলিন তৈরি হলেও তা ব্যবহৃত হতে পারে না। ইনসুলিন হরমোনটি শর্করা, শ্বেতসার ও অন্য খাদ্যকে এনার্জিতে রূপান্তর করতে সাহায্য করে। আর আছে টাইপ-২ ডায়াবেটিস, বড়দের মধ্যে হয়। বেশির ভাগ সময় এ ধরনের রোগী থাকে স্থূল।
অথচ ৩৮ বছর পার হওয়ার পরও অনীক কেবল যে বেঁচে ছিলেন তা-ই নয়, বেশ সজীব হয়েই বেঁচে ছিলেন। তাঁর চিকিৎসক বলেছিলেন, দীর্ঘদিনের ডায়াবেটিস যাঁদের, তাঁদের এ থেকে জটিলতা না হওয়াটা তেমন চোখে পড়ে না। অনীক যে এত দিন বেঁচে আছেন, কেবল তিনি নন, অনেকের ক্ষেত্রে তা-ই ঘটছে।
বস্তুত টাইপ-১ ডায়াবেটিস নির্ণয় যাঁদের ক্ষেত্রে হয়েছে, এঁরা অনেক দিন বাঁচছেন। রোগ নির্ণয়ের পর ৫০ বছর পরও বেঁচে আছেন অনেকে।
বারবারা ডেভিস সেন্টার ফর চাইল্ড হুড সেন্টারস এডাল্ট প্রোগ্রামে ছয় হাজার ডায়াবেটিক রোগীকে অনুসরণ করে দেখা গেছে, এঁদের মৃদু জটিলতা হয়েছে। যেমন-আগাম মৃদু কিডনি রোগ, যা প্রতিরোধ করা সম্ভব। অধ্যাপক ডা· সতীশকে গার্ন বললেন, এদের মধ্যে এক হাজার ২৭০ জন বেঁচে ছিলেন ৩০ বছর বয়স বা এরও বেশি। এক হাজার ২৭০ জনের মধ্যে ২৭০ জন রোগী ৪০ বছরের বেশি বেঁচে ছিলেন ডায়াবেটিস নিয়ে। ৩৫ জন বাঁচলেন ৫০ বছরেরও বেশি।
কলোরাডো স্কুল অব মেডিসিনের অধ্যাপক গার্ন বলেন, ডায়াবেটিসের চিকিৎসা এগিয়েছে অনেক দূর। ২৫ বছর আগে তিনি ডায়াবেটিক রোগীদের বিয়ে না করার এবং সন্তান না নেওয়ার পরামর্শ দিতেন। কারণ, মনে করা হতো এমন রোগী ৩৫ বছর বয়সের বেশি বাঁচবেন না। কিন্তু এখন ডায়াবেটিস রোগীরা গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণে রেখে দীর্ঘায়ু হচ্ছেন, সজীব বার্ধক্য উপভোগ করছেন। অনেক ডায়াবেটিক মহিলা জননী হচ্ছেন, স্বামী-সন্তান নিয়ে সুখে আছেন।
অবশ্য এখনো জানা নেই, যেকোনো জিন উপকরণ ডায়াবেটিক রোগীদের আয়ুবৃদ্ধির জন্য দায়ী কি না। গার্ন বলছেন, গ্লুকোজ মান ব্যবস্থাপনা এখন অনেক সহজ চিকিৎসা ক্ষেত্রে অগ্রগতির জন্য। নতুন ইনসুলিন বেরিয়েছে, যা রক্ত-গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণ করে অনেক ভালোভাবে। ইনসুলিন প্রয়োগেরও নতুন নতুন সহজ কৌশলও বেরিয়েছে। রক্ত-গ্লুকোজ মনিটর করার জন্যও নতুন প্রযুক্তি এসেছে। তবে যাঁরা রক্তের গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণে রাখেন না, তাঁদের জটিলতার মুখোমুখি হতে হয়। অধ্যাপক গার্ন আরও বলেন, যাঁদের ডায়াবেটিস আছে, এঁদের জন্য প্রয়োজন হলো রক্তের গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণে রাখা, রক্তচাপ ও কোলেস্টেরল মানকে নিয়ন্ত্রণ রাখা, স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া ও নিয়মিত ব্যায়াম করা।
১৯৯৩ সালে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিনে একটি গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশ করে মন্তব্য করেন, গ্লুকোজের মান নিয়ন্ত্রণে জীবন বাঁচে, হ্রাস করে নিউরোপ্যাথি ও রেটিনোপ্যাথির মতো জটিলতা। ২০০৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর হেলথ এনআইএইচের অর্থায়নে পরিচালিত গবেষণায় দেখা যায়, যেসব ডায়াবেটিক রোগী গ্লুকোজের মান নিয়ন্ত্রণে রেখেছিলেন, এঁদের হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের ঝুঁকি কমেছিল তাৎপর্যপূর্ণভাবে। এসব গবেষণায় ডায়াবেটিসের প্রতি চিকিৎসকের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন এনেছিল। বেশির ভাগ রোগী ডায়াবেটিসের তদারকি ও যত্ন নিলে মৃত্যুবরণ করে ডায়াবেটিসের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, এমন সব রোগে।
এবার অনীকের প্রসঙ্গে আসি। ১৬ বছর বয়সে যখন তাঁর রক্তের সুগার প্রথম টেস্ট করা হয়েছিল, তখন তা ছিল অনেক বেশি, স্বাভাবিক মান ৭০-১১৫ মিলিগ্রামের চেয়ে অনেক বেশি। ইতিমধ্যে তাঁর শরীর থেকে ওজন কমেছিল ৪০ পাউন্ড, চোখে ঝাপসা দেখা, বমি, বারবার প্রস্রাব ও তৃষ্ণা লাগা তো ছিলই। কিন্তু ক্রমে ক্রমে অনীক স্বাস্থ্যবান হয়ে উঠলেনঃ অ্যামেনড নামে একটি কর্মসূচি অনুসরণ করে এই পরিবর্তন এসেছিল।
এ = অ্যাটিচুড
এম = মাইন্ডফুলনেস
ই = এক্সারসাইজ
এন = নিউট্রিশন
ডি = ডায়েট
দৃষ্টিভঙ্গি, মনোযোগ, ব্যায়াম, পুষ্টি ও খাদ্য-এ কটি নীতি অনুসরণে এল সাফল্য। প্রথমে অনীক ধূমপান ছাড়লেন। ১২ বছর বয়স থেকে ধূমপান শুরু করা অনীক ধূমপান ছাড়লেন, যখন তাঁর বয়স ২২ বছর। এরপর তিনি ধ্যানচর্চা শুরু করলেন। শ্বাসক্রিয়ার ব্যায়াম, প্রাণায়াম করলেন নিয়মিত। খাদ্যাভ্যাস বদলালেন। আঁশ, শাকসবজি, ফল, দধি এল খাবারের তালিকায়।
আজকাল অনীক আহারের এক ঘণ্টা পর রক্তের গ্লুকোজ মাপান বেশ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে। প্রায় প্রতি সকালে তিনি ২০ মিনিট যোগব্যায়াম করেন। আধঘণ্টা ধ্যানচর্চা করেন। কখনো খেলেন ভলিবল। ১৯৮০ সাল থেকে বাইসাইকেলও চালান।
এ কর্মসূচির অংশ হিসেবে লাল গোশত খান না, বি কমপ্ল্লেক্স ভিটামিন খান। প্রচুর সবজি ও ফল খান। লো-গ্লাইসিমিক ফল।
অনীক বিশ্বাস বলেন, ডায়াবেটিক রোগী যদি সুস্বাস্থ্যের প্রতি দায়বদ্ধ থাকেন, তাহলে তিনি অর্জন করবেনই।
অনীক আরও বলেন, ডায়াবেটিস নিয়ে বেঁচে থাকা কঠিন, তবে এর চেয়ে কঠিন হলো ডায়াবেটিসে মৃত্যুবরণ। তাই স্বাস্থ্যকর জীবন নিয়ে বাঁচার জন্য চেষ্টা করুন।
অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরীর কলম থেকে
পরিচালক, ল্যাবরেটরি সার্ভিসেস
বারডেম হাসপাতাল, ঢাকা
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মার্চ ০৪, ২০০৯
Leave a Reply