হাইলাইটস
- উট কি কাঁটা বেছে খায়’? এই প্রশ্ন ভাবিয়েছিল লালমোহন বাবুকে।
- রাজস্থানের মরু প্রান্তরে ডাকাতকে ধাওয়া করতে উটের পিঠে চড়ে যথেষ্ট নাকানিচোবানি খেয়েছিলেন তিনি।
- তবু এই ‘আশ্চর্য জানোয়ার’ সম্পর্কে তাঁর কৌতুহল কমেনি।
- সত্যজিত্ রায়ের ‘সোনার কেল্লা’য় উটের দুধের চা খেয়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন জটায়ু।
গোরুর দুধের উপকারিতা সম্পর্কে আমরা সকলে জানলেও উটের দুধ তেমন প্রচারের আলো পায় না। মুষ্টিমেয় কয়েকজন ছাড়া উটের দুধের উপকারিতাও সকলের অজানা। মরুভূমিতে বসবাসকারী লোকেদের জন্য এই উটের দুধই পুষ্টির জোগানের গুরুত্বপূর্ণ উৎস। তবে বর্তমানে উটের দুধও প্রক্রিয়াকরণ করে নানান দেশে রফতানি করা হচ্ছে। এমনকি অনলাইনে উটের দুধের গুঁড়ো বা ফ্রোজেন দুধও পাওয়া যাচ্ছে। গোরু ও অন্যান্য প্রাণীজাত এবং উদ্ভিজ দুধ যখন সহজলভ্য এবং অনেকে ব্যবহার করে থাকে, এমন সময় কেন উটের দুধ কিনবেন ভাবছেন?
তা হলে উটের দুধের উপকারিতা সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক—
১. পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ
উটের দুধ নানান পুষ্টিকর উপাদানে সমৃদ্ধ, যা সামগ্রিক সুস্বাস্থ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ক্যালরি, প্রোটিন এবং কার্বের ক্ষেত্রে উটের দুধ গোরুর দুধকে কড়া টক্কর দিতে পারে। তবে এতে স্যাচুরে়টেড ফ্যাটের পরিমাণ কম থাকে। কিন্তু ভিটামিন সি, বি, ক্যালশিয়াম, আয়রন ও পটাশিয়ামের উল্লেখযোগ্য উৎস এটি।
১২০ এমএল গোরুর দুধে
ক্যালরি- ৫০ গ্রাম
প্রোটিন- ৩ গ্রাম
ফ্যাট- ৩ গ্রাম
কার্ব- ৫ গ্রাম
থিয়ামিন- ডেলি ভ্যালু (DV)- ২৯ শতাংশ
রাইবোফ্ল্যাভিন- DV-র ৮ শতাংশ
ক্যালশিয়াম- DV-র ১৬ শতাংশ
পটাশিয়াম- DV-র ৬ শতাংশ
ফসফরাস- DV-র ৬ শতাংশ
ভিটামিন সি- DV-র ৫ শতাংশ
২. দুধে অ্যালার্জি বা ল্যাকটোস ইনটলারেন্স থাকলে তাঁদের জন্য উটের দুধ একটি ভালো বিকল্প
ল্যাকটোসের অভাবে অনেকের মধ্যে ল্যাকটোস ইনটলারেন্স দেখা দেয়। দুগ্ধজাত খাদ্য দ্রব্যে উপস্থিত ল্যাকটোস বা চিনি হজম করতে এই ল্যাকটেস নামক উৎসেচকই সাহায্য করে। তাই দুগ্ধজাত খাদ্য পদার্থ গ্রহণ করলে অনেকের ব্লটিং, ডাইরিয়া এবং পেটে ব্যথা হতে পারে।
উটের দুধে গোরুর দুধের তুলনায় কম ল্যাকটোস থাকে। তাই যাঁদের ল্যাকটোস ইনটলারেন্স রয়েছে, তাঁরা উটের দুধ পান করতে পারেন।
আবার উটের দুধের প্রোটিন প্রোফাইল গোরুর দুধের প্রোটিন প্রোফাইলের তুলনায় পৃথক। সে ক্ষেত্রে গোরুর দুধে অ্যালার্জি থাকলে সহজেই উটের দুধ পান করা যেতে পারে।
উল্লেখ্য রোটাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট ডাইরিয়ার চিকিৎসায় শতাধিক বছর ধরে উটের দুধ ব্যবহার করা হয়ে আসছে। সমীক্ষায় জানা গিয়েছে যে, এই দুধে এমন কিছু অ্যান্টিবডি থাকে যা ডাইরিয়া (বিশেষত শিশুদের ক্ষেত্রে)-র চিকিৎসায় কাজে লাগানো হয়।
৩. রক্তে শর্করার পরিমাণ কম করতে পারে
এ-ও দেখা গিয়েছে যে, টাইপ ১ এবং টাইপ ২ ডায়বিটিজে আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে উটের দুধ রক্তে শর্করার পরিমাণ কমাতে সহায়ক। পাশাপাশি ইনসুলিনের প্রতি সংবেদনশীলতাকেও বৃদ্ধি করে।
উটের দুধে ইনসুলিনের মতো প্রোটিন থাকে, যা ডায়াবিটিক বিরোধী কাজকর্মের জন্য দায়ী। ইনসুলিন এমন এক হরমোন, যা রক্তে শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে।
প্রায় ৪ কাপ বা ১ লিটার উটের দুধে ৫২ ইউনিটের সমান ইনসুলিন পাওয়া যায়। শুধু তাই নয় উটের দুধে প্রচুর পরিমাণে জিঙ্কে থাকার ফলে ইনসুলিনের প্রতি সংবেদনশীলতা বৃদ্ধি করে।
২ মাস ধরে ২০ জনের ওপর একটি সমীক্ষা চালিয়ে দেখা হয় যে, যে গ্রুপটি নিয়মিত ২ কাপ (৫০০ এমএল) উটের দুধ পান করত, তাদের মধ্যে গোরুর দুধ পান করে থাকা গ্রুপের তুলনায় ইনসুলিনের প্রতি সংবেদনশীলতার উন্নতি ঘটেছে।
৪. রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াই চালাতে পারে ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলে
উটের দুধে এমন কিছু উপাদন থাকে যা রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াই চালাতে পারে। উটের দুধে উপস্থিত দুটি সক্রিয় উপাদান হস ল্যাক্টোফেরিন ও ইমিউনোগ্লোবুলিনস। এই দুই ধরনের প্রোটিন রোগ প্রতিরোধ শক্তি বাড়িয়ে তোলে।
ইঁদুরের ওপর করা একটি সমীক্ষা থেকে জানা গিয়েছে যে, উটের দুধ লিউকোপেনিয়া (শ্বেত রক্তকণিকার অভাব জনিত সমস্যা) থেকে রক্ষা করে। আবার এটি সাইক্লোফসফামাইড নামক টক্সিক অ্যান্টি ক্যান্সার ওষুধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া থেকেও সুরক্ষা প্রদান করে।
উটের দুধে উপস্থিত হোয়ে প্রোটিন ক্ষতিকর জীবাণুর সঙ্গে লড়তে পারে। আবার ফ্রি র্যাডিক্যাল ড্যামেজ থেকে লড়াই চালানোর জন্য শরীরকে সাহায্য করে উটের দুধে উপস্থিত অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান।
৫. মস্তিষ্কের জটিলতা ও অটিসম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার সারিয়ে তুলতে পারে
বাচ্চাদের মধ্যে আচরণগত অবস্থার ওপর উটের দুধের প্রভাব বিষয় নানান সমীক্ষা করা হয়েছে। আবার অটিসম সারাতেও যে এটি সাহায্য করে, সে বিষয়েও অনেকে সহমত পোষণ করেন। কিছু কিছু সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে যে অটিস্টিক বিহেভিয়ারে উন্নতি ঘটাতে উটের দুধ সক্ষম।
নানান নিউরোডেভেলপমেন্টাল অবস্থাকে এক সঙ্গে অটিসম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার বলা হয়ে থাকে। এর ফলে সামাজিক মেলামেশা নষ্ট হয় এবং পুনরাবৃত্তিমূলক আচরণ দেখা যায়।
২ থেকে ১২ বছর বয়সের মধ্যে ৬৫ জন বাচ্চাদের ওপর একটি সমীক্ষা চালানো হয়। দু সপ্তাহ ধরে উটের দুধ পান করতে দেওয়া হয় ওই শিশুদের। দেখা যায় এর ফলে তাঁদের অটিস্টিক বিহেভরিয়াল লক্ষণে উন্নতি ঘটেছে। গোরুর দুধ পান করিয়ে এ ভাবেই একটি সমীক্ষা চালানো হয়েছিল। কিন্তু তাতে কোনও উন্নতি চোখে পড়েনি। সমীক্ষার ফলাফল সন্তোষজনক হলেও অটিসমের চিকিৎসায় উটের দুধ ব্যবহার করার পরামর্শ দেওয়া হয় না।
আবার উটের দুধ পার্কিনসন্স এবং অ্যালজাইমার আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রেও উপকারী হতে পারে। কিন্তু এ বিষয় খুব কম সমীক্ষা করা হয়েছে।
৬. খাদ্য তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করা সহজ
অন্য যে কোনও ধরনের দুধের স্থান দখল করতে পারে উটের দুধ। শুধু দুধ পান করতে পারেন অথবা চা, কফি, স্মুদি, সস, সুপ, ম্যাক অ্যান্ড চিজ, প্যানকেক ও ওয়াফেলের ব্যাটারেও এটি ব্যবহার করা যায়।
তবে স্থান বিশেষে উটের দুধের স্বাদে তারতম্য দেখা দিতে পারে। যেমন আমেরিকার উটের দুধ মিষ্টি, সামান্য নোনতা ও ক্রিমি হয়ে থাকে। আবার মধ্যপ্রাচ্যের উটের দুধ শুকনো ফলের মতো ও স্মোকি স্বাদের হয়ে থাকে।
সম্ভাব্য সমস্যা
১. অধিক মূল্যবান
নানান কারণে গোরুর দুধের তুলনায় উটের দুধ অনেক দামী। অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মতোই উটও সন্তান প্রসবের পর দুধ উৎপাদন করে। একটি উট ১৩ মাস গর্ভবতী থাকে। এর ফলে উৎপাদনের সময় চ্যালেঞ্জিং হয়ে পড়ে। উটের দুধের চাহিদা বাড়লেও জোগান তার চেয়ে কম। আবার গোরুর তুলনায় অনেক কম দুধ উৎপাদন করে উট। উট দিনে দেড় গ্যালন বা ৬ লিটার দুধ উৎপাদন করে। অন্য দিকে গোরু দিনে ৬ গ্যালন বা ২৪ লিটার দুধ উৎপাদন করে থাকে।
২. পাস্তুরাইজ করা যায় না
প্রথাগত ভাবে, গরম বা পাস্তুরাইজ না-করে উটের দুধ কাঁচাই পান করা হয়। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা ফুড পয়জানিংয়ের আশঙ্কার কারণে কাঁচা দুধ পানের পরামর্শ দেন না। আবার কাঁচা দুধে উপস্থিত জীবাণু সংক্রমণ ঘটাতে পারে। এর ফলে কিডনি বিকল, এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। গর্ভবতী, বাচ্চা, বয়স্ক ও দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন ব্যক্তিরা এ ক্ষেত্রে অধিক ঝুঁকির মুখে থাকেন।
শুধু তাই নয়, উটের দুধে এমন কিছু জীবাণু থাকে, যা মিডল ইস্ট রেসপিরেটরি সিন্ড্রোম ও মেডিটারেনিয়ান ফিভারের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। এই দুই রোগই অনেক বেশি সংক্রামক এবং পাস্তুরাইজ করা হয়নি এমন দুধ থেকে সহজেই মানব শরীরে সংক্রমণ ঘটাতে পারে।
৩. নৈতিক উদ্বেগের কারণ হতে পারে
বহু যুগ ধরে প্রাচ্যের দেশগুলিতে উটের দুধ পান করা হচ্ছে। কিন্তু সম্প্রতি এর বাণিজ্যিকীকরণ করা হয়েছে এবং উটের দুধ এখন পাশ্চাত্যের দেশগুলিতে ট্রেন্ডে পরিণত হয়েছে।
ফলে এমন স্থানে উট রফতানি করা হচ্ছে, যেখানকার আবহাওয়া ও পরিবেশ তাঁদের বসবাসের প্রতিকূল। যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে উটের দুধ উৎপাদনের জন্য ক্যামেল ডেয়ারি ফার্ম গড়ে তোলা হয়েছে।
এ সমস্ত কারণে অনেকেই নৈতিকতার দিক দিয়ে চিন্তাভাবনা করে উটের দুধ পান করা থেকে বিরত থাকেন।
Lifestyle News in Bengali, লাইফস্টাইল খবর, Health Tips, Fashion Trends and Tips in Bangla
2021-08-04 11:21:48
Source link
Leave a Reply