নিয়মিত ড্রাগ সেবনকারীর পরিণতি প্রথমতঃ দৈহিক অসুস্থতা দিয়ে শুরু হয় এবং শেষ হয় মানসিক রোগ ও মৃত্যু দিয়ে। মাদকাসক্তির কুফল ও মাদকাসক্তি সম্পর্কে ভুলধারণাসমূহ জেনে নিয়ে মনোবল শক্ত না করে চিকিৎসা করলে নেশার জীবন আবার ব্যক্তিকে আকর্ষণ করবে।
আসক্তরা ক্ষতির কিছু কিছু দিক জেনেও তা লুকিয়ে রাখতে পছন্দ করে, যদি রোগ হিসেবে মেনে নিতো তাহলে নিজেরাই অভিভাবককে জানাতে সক্ষম হতো এবং সবার সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতো। সুসম্পর্ক এই রোগের পথকে বন্ধ করতে অনেকখানি সাহায্য করবে। মাদকাসক্তি একটি প্রগতিশীল রোগ যা নিয়ন্ত্রণ করলে কমবে নতুবা বাড়বে, বেড়ে মৃত্যু পর্যন্ত্য পৌঁছুবে। মাদকাসক্তি চিকিৎসার পর আবার মাদকদ্রব্যের প্রতি নেশা জন্মাবে যদি না সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে যদিও তা একটি চ্যালেঞ্জ।
মাদকাসক্তি নিয়ন্ত্রণ করার উপায়
১) যে কোন রকমের মাদকদ্রব্য থেকে দূরে থাকতে হবে।
২) ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া যেকোন ওষুধ সেবন বন্ধ রাখতে হবে।
৩) আসক্ত ব্যক্তি/ আসক্ত বন্ধুদের কাছ থেকে দূরে থাকতে হবে। (যতড়্গণ পর্যন্ত না চিকিৎসা গ্রহণ করে তারা নিজেদেরকে নিয়ন্ত্রণ করে নতুন জীবন গ্রহণ শুরু করেছে।
৪) যখনই নেশার ইচ্ছা হবে/ নেশার কথা মনে হবে তখন যেন আসক্ত ব্যক্তি নেশা জীবনের অসহায় অবস্থাগুলোর কথা মনে করে।
৫) মিথ্যে বলার অভ্যাস দূর করতে হবে।
৬) হঠাৎ কোন অনুষ্ঠানে / যেকোন পরিস্থিতিতে বন্ধুরা ড্রাগ/ রাসায়নিক দ্রব্যগ্রহণ করতে বললে “না” বলা শিখতে হবে। (কারণ আসক্তরা মাদকদ্রব্য পেলে সহজে “না” বলতে পারে না এটা অনেকটা পাহাড় থেকে পড়ন্ত্য পাথরকে ঠেকানো যেমন কষ্টকর তেমনি চিকিৎসার পর একবার মাদকদ্রব্য ব্যবহার শুরম্ন করলে তার নিয়ন্ত্রণও কষ্টকর)।
৭) মানসিকভাবে ও শারীরিকভাবে পুনরায় ভারসাম্য অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে অভ্যাসের প্রয়োজন যা অল্পদিনে সম্ভব নয়।
৮) মস্তিষ্কের বিচার করার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায় এটিকে পুনরায় স্থিতিশীল অবস্থায় নিয়ে আনসে নৈতিক শিক্ষা, ধর্মীয় মূল্যবোধ ও পারিবারিক বন্ধন শক্ত হতে হবে।
৯) মাদকাসক্তি সম্বন্ধে সঠিক তথ্য জানা থাকতে হবে।
১০) জীবনের প্রতি আগ্রহ বাড়াতে হবে।
১১) যে কোন রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করার কৌতূহল কমাতে হবে। কারণ মাদকাসক্তির প্রধান কারণ হিসেবে এখনো কৌতূহল ও দুঃসাহসিক মনোভাবকে বিবেচনা করা হয় (বিভিন্ন গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্য থেকে)।
১২) সিগারেট যে এক ধরনের মারাত্মক নেশা, সিগারেটের মধ্যেও যে অন্যান্য নেশা জাতীয় দ্রব্য মেশানো থাকে সে ধারণা করতে হবে।
১৩) জীবনের স্বাভাবিক অবস্থাকে মেনে নেয়ার অভ্যেস গড়ে তুলতে হবে। নিজের পরিবার এবং পরিবেশ থেকে আনন্দ পেতে শিখতে হবে।
১৪) নিজের আবেগ দমন ক্ষমতা বাড়াতে হবে। আবেগের প্রভাবই নেশার দিকে নিয়ে যায়।
১৫) মাদকদ্রব্য সম্পর্কে ভুলধারণাগুলো শোধরাতে হবে।
১৬) বাস্তবে পাওয়া দুঃসাধ্য এমন কিছু চাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। নতুবা ব্যক্তি অন্যান্য সহজ, সুন্দর ও স্বাভাবিক জীবনের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে অথবা সে জীবনের অন্যান্য দিকগুলো অবহেলা করতে শুরু করবে।
১৭) ব্যক্তির প্রতিদিনের সাধারণ দায়িত্বগুলি মেনে চলতে অভ্যস্ত হতে হবে।
পুনঃ আসক্ত মাদকাসক্তি রোগেরই একটি অংশ প্রথমবার চিকিৎসার পর আসক্তব্যক্তির সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়া নির্ভর করে রোগী কতদিন রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করছে। যথাঃ
১) দিনে কতবার মাদকদ্রব্য সেবন করছে বা করতো।
২) কি পরিমাণে মাদকদ্রব্য ব্যবহার করছে বা করতো।
৩) কি কি রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করতো/ করছে।
৪) কি প্রক্রিয়ায় ব্যবহার করতো/ করছে।
৫) শারীরিক, মানসিক, আবেগকি ও তার অভ্যন্তরীণ ব্যক্তিত্বের ভারসাম্যের মাত্রা কোন্ অবস্থায় আছে তার উপর নির্ভর করে।
৬) ব্যক্তির সাথে তার পরিবার ও পরিবেশের সম্পর্ক কোন্ পর্যায়ে অবস্থান করছে তার উপর ব্যক্তির সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়া নির্ভর করে।
৭) চিকিৎসার পর পরিবারে ফিরে যাবার পর পরিবারের সাথে সম্পর্ক ফিরিয়ে আনতে পরিবারের ভূমিকা প্রধান।
৮) সর্বশেষে ব্যক্তিকে তার কাজে/ পড়াশুনায় পুনর্বাসন করা। সেক্ষেত্রে পুনর্বাসন কেন্দ্রে পাঠানোর ব্যবস্থা করা, (যদি পরিবার পুনর্বাসন করতে সক্ষম না হয়)।
পরিবার ও সমাজের সকলকে মনে রাখতে হবে মাদকাসক্তি রোগকে অস্বীকার করা নয়, বরং চিকিৎসার জন্য আসক্ত ব্যক্তি গ্রহণ করার মানসিক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরী করতে হবে। কারণ আসক্ত ব্যক্তি সমাজের ভয়েই নিজের মারাত্মক পরিণতির কথা স্বীকার করতে চাচ্ছে না। যত তাড়াতাড়ি আসক্তদের স্বাভাবিকভাবে মেনে নেয়া যাবে সমাজ ততটুকুই সুস্থ থাকবে।
মাদকাসক্তি কিভাবে সনাক্ত করবেনঃ
মাদকাসক্তি রোগকে যত তাড়াতাড়ি রোগ হিসেবে মেনে নিয়ে চিকিৎসা করানো যায় ততই মঙ্গল। কারণ আসক্তি প্রকাশ পাবেই এবং তা মারাত্মক পরিণতির মাধ্যমে। সুতরাং লুকিয়ে না রেখে যথাশীঘ্র চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে।
মাদকাসক্তির কোন সুনির্দিষ্ট কারণ নেই। শুধুমাত্র কৌতূহলই এর জন্য দায়ী হতে পারে। মাদকামসক্ত ব্যক্তির লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্যগুলো যেমনঃ
১) মিথ্যে কথা বলা/ সতর্ক করা।
২) কথা দিয়ে কথা রাখতে না পারা।
৩) সামান্য কারণে মেজাজ করা।
৪) ক্ষুদা নষ্ট হয়ে যাওয়া, চেহারা ও স্বাস্থ্য ভেঙ্গে যাওয়া।
৫) পড়াশুনায় অমনোযোগী হয়ে পড়া/ স্কুল-কলেজের বাহিরে সময় কাটানো।
৬) চোখের জ্যোতি কমে যাওয়া, স্মৃতিশক্তি কমে যাওয়া, বিচার ক্ষমতা হ্রাস পাওয়া।
৭) প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত্য বাইরে থাকা/একা থাকা।
৮) শুধুমাত্র আসক্ত বন্ধুদের সাথে মেশা/ বন্ধুত্ব করা।
৯) নিজেকে সবার কাছ থেকে দূরে রাখা।
১০) প্রতিদিনের হাতখরচ লাগবেই।
১১) ঘরের জিনিসপত্র কিছু কিছু লুকিয়ে নিয়ে যাওয়া/ বিক্রি করা।
১২) যত গুরুত্বপর্ণ কাজই থাকুক না কেন নির্দিষ্ট সময় মাদকদ্রব্য গ্রহণের জন্য ব্যয় করবেই।
কারণ আসক্তদের জন্য নিজে নিজে আসক্তির পথ ছাড়ার চেষ্টা করতে পারা খুবই কঠিন হয়ে দাঁড়ায় যতক্ষণ পর্যন্ত্য না তারা শারীরিকভাবে অসু্স্থ হয়ে পড়ে এবং অভিভাবকের চোখে ধরা পড়ে। এজন্য যেভাবেই হোক অভিভাবকগণ তার সন্তানদের দিকে খেয়াল রাখবেন তার কি কি পরিবর্তন দেখা দিচ্ছে এবং রোগ থেকে মুক্তি পাবার জন্য তার সাথে সহানুভূতিশীল আচরণের দ্বারা চিকিৎসার জন্য রাজী করাতে হবে।
লেখকঃ সামীমা সেকান্দার
উৎসঃ দৈনিক ইত্তেফাক, ১১ নভেম্বর ২০০৭
Leave a Reply