অরণ্যের হাতছানি অ্যাডভেঞ্চার প্রেমী
হলিউড ছবির চিত্রনাট্য এটি। তবে গোটাটাই বাস্তব থেকে অনুপ্রেরিত। আত্মহত্যার অরণ্যের ভয়াবহ ঘটনাকে গল্পের আকার দিয়েই সুপারহিট হয়েছিল ‘দ্য সি অফ ট্রিজ্’ কিংবা ‘দ্য ফরেস্টে’র মতো হলিউড সুপারন্যাচারাল হরর মুভি। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার ছোট্টো দেশ জাপান। বেশ দামি দেশ। মধ্যবিত্তরা সেদেশে বেড়াতে যাওয়ার কথা বিশেষ ভাবেন না। কিন্তু তাও সেদেশের একটি অরণ্যের হাতছানি অ্যাডভেঞ্চার প্রেমীরা কিছুতেই এড়িয়ে যেতে পারেন না। জঙ্গলের পোশাকী নাম অওকিগাহারা। আর লোকে তাকে চেনে ‘আত্মহত্যার অরণ্য’ নামে।
নামকরণের স্বার্থকতা
জাপানের ফুজি পর্বতমালার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত অরণ্যটির নাম অওকিগাহারা। এর আয়তন প্রায় ৩৫ বর্গ কিলোমিটার। জঙ্গলে গাছের ঘনত্ব এতটাই বেশি যে একে ‘সি অফ ট্রিজ্’ বা গাছেদের সমুদ্র নামেও ডাকা হয়। এখানে প্রাণের অস্থিত্ব বিশেষ মেলে না। শান্ত নিরিবিলি হওয়ায় অ্যাডভেঞ্চার প্রেমী পর্যটকের কাছে এটি খুবই প্রিয় জায়গা। আর এটি আরও প্রিয় জায়গা আত্মহত্যাকারীদের কাছে। সমীক্ষা বলছে সুনসান এই অরণ্যে প্রায় প্রতি বছর শতাধিক জাপানি আত্মহত্যা করেন। সেই কারণেই এই জঙ্গলটির আরেক নাম ‘আত্মহত্যার অরণ্য’ বা সুইসাইডাল ফরেস্ট। বর্তমানে সেখানে পাহারার ব্যবস্থা থাকলেও বহু আত্মহত্যাপ্রবণ মানুষ তাঁদের কার্যসিদ্ধি করতে সক্ষম হন।
প্রেতাত্মার বাস
জাপানিদের বিশ্বাস এই জঙ্গলে প্রাচীন প্রেতাত্মারা বাস করে। জাপানি প্রাচীন গাঁথা অনুযায়ী, উবাসু নামক এক অঞ্চলের জাতি মধ্যে অদ্ভূত এক প্রথা ছিল। পরিবারের বয়স্ক মানুষদের তাঁরা এই অওকিগাহারার জঙ্গলে ছেড়ে দিয়ে আসতেন। সেখানে ঘুরতে ঘুরতে প্রাণ হারাতেন বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা। তাঁদের প্রেতাত্মাই নাকি জঙ্গলে ছেয়ে গেছে। আর সেই সব অশুভ আত্মার প্রভাবেই নাকি এই জঙ্গলে আত্মহত্যা করার প্রবণতা বেশি।
আত্মহত্যার হার
জাপানিদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বিশ্বের যে কোনও নাগরিকদের থেকে বেশি। আর অওকিগাহারা জঙ্গলে আত্মহত্যার প্রবণতা শুরু হয় ১৯৫০ সাল থেকে। ২০০২ সালে জঙ্গল থেকে উদ্ধার হযেছিল ৭৮টি মৃতদেহ। ২০০৩ সালের সংখ্যাটা ১০০ ছাড়িয়ে যায়। ২০০৪ সালেও শতাধিক ব্যক্তি এই জঙ্গলে আত্মহত্যা করেছেন। যত দিন গেছে মৃতের সংখ্যা বেড়েছে। পরবর্তী সময়ে জাপান সরকার আত্মহত্যার হার প্রকাশ করা বন্ধ করে দেয়। প্রধানত গাছে ফাঁসি দিয়ে বা মাদকগ্রহণ করেই আত্মহত্যার প্রবণতা এই জঙ্গলে বেশি।
কাঠগড়ায় উপন্যাস
১৯৬০ সালে সাইকো মাটসুমোটো নামক এক জাপানি লেখক ‘টাওয়ার অফ ওয়েবস্’ নামে একটি উপন্যাস লেখেন। বলা হয়, সেই উপন্যাস প্রকাশের পর থেকেই অওকিগাহারার অরণ্যে আত্মাহত্যার প্রবণতা বেড়ে যায়। এই উপন্যাসের দুটি চরিত্র এই বনে গিয়ে আত্মহত্যা করেছিল। এর পর থেকে জাপানিদের বিশ্বাস জন্মায় যে এখানে আত্মঘাতি হলে তাঁদের পরিবার এবং সন্তানরা ভবিষ্যতে সুখী হবে।যদিও জঙ্গলে আত্মহত্যার হার কমাতে ১৯৭০ সালেই উদ্যোগ নিয়েছিল জাপান সরকার। পুলিশ, স্বেচ্ছাসেবক এবং সাংবাদিকদের নিয়ে একটি বিশেষ দল গঠন করা হয়েছিল। এঁদের প্রধান কাজ ছিল জঙ্গলের ভিতরের মৃতদেহগুলি খুঁজে বের করা এবং লোকজনকে আত্মহত্যায় অনুৎসাহিত করা।
সাম্প্রতিক জনপ্রিয়তা
অওকিগাহারা জঙ্গলের রহস্য নিয়ে দুটি হলিউড ছবি নির্মিত হয়েছে। ‘দ্য সি অফ ট্রিজ্’ (২০১৬) কিংবা ‘দ্য ফরেস্টে’ (২০১৬)। দুটি ছবির বক্সঅফিস কালেকশন ছিল দুর্দান্ত। প্রথম ছবির বিষয় ছিল রহস্যময় অরণ্য অওকিগাহারা এবং দ্বিতীয় ছবিটি ছিল প্রধানত সুপারন্যাচারাল হরর ফিল্ম। এই ছবি দেখার পর বহু অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমীর কাছেই অওকিগাহারা হয়ে ওঠে দারুণ আকর্ষণের জায়গা। অলৌকিকতার কথা বাদ দিলেও এখানকার প্রাকৃতির রহস্যও কম আকর্ষণীয় নয়। জঙ্গলটির মেঝে পুরোপুরি আগ্নেয়শিলায় তৈরি। ফলে এখানে পাথর খুঁড়ে রাস্তা তৈরি করা একরকম অসম্ভব। বনের ভিতরে অবশ্য স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকরা কাজ চালানোর মতো রাস্তা তৈরি করে নিয়েছেন। এই রাস্তা দিয়ে মৃতদেহ সংগ্রহ করা হয়। জঙ্গলে যাতে পথ হারিয়ে না যায় সেজন্য প্লাস্টিকের টেপ দিয়ে পথনির্দেশিকা রাখেন পর্যটকরা। যদি বনের গভীরতার প্রথম এক কিলোমিটারের মধ্যেই শুধুমাত্র এই পথ নির্দেশিকার চিহ্ন মিলবে। কিন্তু মজার কথা হল পর্যটকরা নিজেদের সুবিধার জন্য এই পথনির্দেশিকা লাগালেও জাপান সরকারের কর্মীরা সেগুলিকে সাবধানতা বশে প্রতিবারই খুলে ফেলেন। তাঁদের যুক্তি এই সব পথনির্দেশিকা আত্মহ্ত্যাপ্রবণ মানুষদের জঙ্গলে ঢুকতে উৎসাহ দেয়। জঙ্গলে পা রাখলেই মনে হবে আপনি যেন সমস্ত সভ্যতাকে পিছনে ফেলে আদিমযুগে পদার্পণ করেছেন। আর সেই অনুভূতির কোনও তুলনা হয় না। এমনও মনে হতে পারে যে এমন সুন্দর পরিবেশে মানুষ, আত্মহত্যার কথা ভাবে কী করে? এর কোনও উত্তর অবশ্য কারও জানা নেই।
Lifestyle News in Bengali, লাইফস্টাইল খবর, Health Tips, Fashion Trends and Tips in Bangla
2021-06-28 17:51:16
Source link
Leave a Reply