হাইলাইটস
- মানেভঞ্জন, লামাইদুরা, জৌবারি, মাবু, মায়মাজুয়া, গুরুওয়ালেভঞ্জম।
- নেপালের ইলাম জেলায় পাহাড়ের কোলে সযত্নে লালিত কয়েকটি গ্রামের নাম।
- মানেভঞ্জন থেকে শুরু করে এই সব গ্রাম পেরোলেই দেখা মিলবে চিন্তাফুর।
মানেভঞ্জন, লামাইদুরা, জৌবারি, মাবু, মায়মাজুয়া, গুরুওয়ালেভঞ্জম। নেপালের ইলাম জেলায় পাহাড়ের কোলে সযত্নে লালিত কয়েকটি গ্রামের নাম। মানেভঞ্জন থেকে শুরু করে এই সব গ্রাম পেরোলেই দেখা মিলবে চিন্তাফুর। অবশ্য চিন্তাফু যাওয়ার অন্য একটি পথও আছে। মায়মাজুয়া থেকে গাড়িতে পশুপতিনগর হয়ে শিলিগুড়ি আসা যায়। ফিরেছিলাম সে পথ ধরেই। তবে এতগুলি গ্রামের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মন কেড়েছিল মায়মাজুয়া ও গুরওয়ালেভঞ্জম। বহু পথ পেরিয়ে এক ক্লান্ত বিকেলে মায়মাজুয়া ঢোকার মুখেই পড়ল মায়াখোলা। ‘খোলা,’ অর্থাৎ নদী। পেরোলেই বেশ বড় মাঠ। মাঠে তখন সেভেন লাইন্স ডিফেন্সে ফুটবল খেলা চলছে। উত্তেজনা তুঙ্গে। মাঠের এক প্রান্তে এলাকার একমাত্র স্কুল। ছুটির মরশুম থাকায় পড়ুয়াদের দেখা মিলল না। স্কুলবাড়ির সামনে বসে ফুটবল ম্যাচ দেখে মায়মাজুয়া গ্রামের হোমস্টেতে পৌঁছতে সন্ধে হয়ে গেল। কোনও মতে একটু খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।
কাঠের ঘরের ছোট্ট জানলার কাচ জানান দিল, মায়মাজুয়াতে ভোর হয়েছে। না, সকাল হয়নি তখনও। দূরের ওই সবুজ পাহাড় যেন হাত বাড়িয়ে বরণ করে নিতে চাইছে সোনালি সকালকে। মিনিট তিরিশ পরে গায়ে জ্যাকেট জড়িয়ে, জুতোয় পা গলিয়ে দরজা খুলে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। সবুজ পাহাড়ের আড়ালে সূয্যিমামা উঁকি দিচ্ছে। ছোটবেলায় ড্রইংখাতায় দুই পাহাড়ের মাঝে যে রকম সূর্য আঁকতাম, ঠিক সেই রকম। সকালের মিঠে আলোয় একটু একটু করে কুয়াশা কাটছে। তবে রোদের আঁচলে এ গ্রাম ঢাকতে এখনও ঢের দেরি। দাঁড়িয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। চারপাশের এই এত সবুজ, এদিক ওদিক ছড়ানো ছোট্ট ছোট্ট কাঠের বাড়ি, বাড়ির সামনে কালো গ্রো ব্যাগে মাটি ফেলে লাগানো অনেক রঙবেরঙের ফুলের গাছ, দূর থেকে শুনতে পাওয়া গবাদি পশুর গলায় বাঁধা ঘণ্টা মনটা যেন অবশ করে দিল। আমার এ অলস মেঘলা মন যেন দেখতে পেল অত্যন্ত কঠোর পরিশ্রমী মানুষগুলি পাকদণ্ডি বেয়ে কাঠ কাটতে আর পশু চরাতে যাচ্ছে, কেউ বা গাড়ি চালাতে। আবার কেউ ঘরে শিশুসন্তান আর তাদের মাকে ফেলে আগেই পাড়ি দিয়েছে দূরের কোনও শহরে।
দাঁতে দাঁত চেপে ঘরে-বাইরের সমস্ত কাজ সামলাচ্ছে মেয়েরাই। হ্যাঁ, চোখে না দেখলেও জানি এই সবকিছু মিলিয়েই এক একটা পাহাড়িয়া গ্রামের জন্ম হয়। ভাবতে ভাবতেই এক ফালি রোদ মুখে এসে পড়ায় বুঝলাম, বেশ কিছুটা সময় গড়িয়েছে। কাঠের বারান্দা যেখানে বাঁ দিকে বেঁকেছে, সেখানেই নীচে নামার জন্য কয়েক ধাপ হাতলহীন সিঁড়ি। তার শেষে বাঁ দিক ঘেঁষে কাঠের বাথরুম। বহু দিন পরে ঘাড়ে মাথায় জল দিলাম। ঠাণ্ডা জলের কণা যেন শিরদাঁড়া বেয়ে নামল! বাড়ির পাশে হাট বসেছে। পাহাড়িয়া সুন্দরী মা-বৌয়েরা কোলের শিশু নিয়ে পসরা সাজিয়ে বসেছেন। রঙবেরঙের শীতের পোষাক। মিশকি নামের গালফুলো পুচকে মেয়ের সঙ্গে আলাপ হল। ওর সঙ্গে কিছুক্ষণ খেলে রওনা হলাম গুরওয়ালেভঞ্জমের পথে।
গুরওয়ালে দূর থেকে চোখে দেখা যায় না, সব সময় মেঘে ঢেকে থাকে। তাই পৌঁছেও বুঝতে পারছিলাম না, পৌঁছেছি কি না! খাদের ধারে ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ। মেঘের মধ্যে থেকে এগিয়ে আসা একজনকে জিজ্ঞেস করে জানলাম, এটিই গুরওয়ালে গ্রাম। দুপুর আড়াইটে বাজলেও দেখে মনে হচ্ছিল সবে ভোর হয়েছে। চোখ মেলে তাকালাম সাদা মসলিনের শাড়ির মতো মেঘে ঢাকা পাহাড়িয়া গুরওয়ালের দিকে। এ বসন্তে সে যেন লাজে রাঙা ষোড়শী! গোটা গ্রাম সেজে উঠেছে লাল রঙের গুরাসে (রডোডেনড্রন)। এ যে সত্যিই ফুলের আগুন! গুরওয়ালে গ্রামে মাত্র ছ’টি কাঠের বাড়ি, বাচ্চা বুড়ো জোয়ান মিলিয়ে জনা পঁচিশ বাসিন্দা আর পাঁচটি কুকুর, দুটো শুয়োর, কয়েকটি গরু, একজোড়া মোরগ, খান দশেক মুরগি আর তাদের একমুঠো ছানা। মেঘের চাদর সরিয়ে একটু একটু করে এগিয়ে পৌঁছে গেলাম আমাদের প্রতীক্ষায় থাকা সেই কাঠের বাড়িতে।
গুরওয়ালেভঞ্জম থেকে ৩ কিলোমিটার উঠলেই চিন্তাফু। পরিষ্কার আকাশে কাঞ্চনজঙ্ঘা পরিবারকে দেখার জন্য খুব ভোরে ঘুম চোখে উঠে হাতে টর্চ নিয়ে বেরোলাম চিন্তাফুর পথে। চিন্তাফু টপে পৌছানোর পথে আকাশে আলো ফুটল। দিগন্তে দেখা দিল চিন্তাফুকে ঘিরে থাকা সাদা, লাল, গোলাপি রঙের রডোডেনড্রন বন। আলোর রেখা ধরে কুম্ভকর্ণ-কাঞ্চনজঙ্ঘা-পান্ডিম একে একে মেঘের আড়াল থেকে বেরিয়ে মাথা তুলে দাঁড়াল।কাঞ্চনজঙ্ঘা আর এভারেস্টদের সংসার দেখার তাড়নায় আমরাও দৌড়ে চড়াই ধরলাম। প্রতিটি পদক্ষেপ বুঝিয়ে দিচ্ছিল, খুব কম লোকই এই পথে পা রেখেছেন। পায়ে পায়ে বাধা, চড়াই উতরাই পেরিয়ে শ্যাওলাধরা পাহাড়ি পাকদণ্ডি বেয়ে যখন টপে পৌঁছলাম, তখন সাড়ে ছ’টা বাজে। ডান দিকে সূর্যোদয় আর সামনে বিশাল কাঞ্চনজঙ্ঘা শিখরশ্রেণি। উত্তর-পশ্চিমে এভারেস্ট, মাকালু ও লোটসে শৃঙ্গ। তারা যেন একমুখ হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে! দু’ চোখে শুধুই বিস্ময় নিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘার ভয়ঙ্কর সুন্দর রূপ দেখে যেন শরীরের সমস্ত ক্লান্তি দূর হল।
চিন্তাফু প্রচলিত ট্রেকরুটগুলির মতো খুব জনপ্রিয় নয়। বছরের বিভিন্ন সময়ে দলে দলে মানুষ এখানে না আসার কারণে বেশ কিছু জায়গায় গাড়ি চলাচলের রাস্তা নেই। পর্যটন শিল্পও ভালো মতো গড়ে ওঠেনি। অবশ্য সেটিই এখানকার বড় প্রাপ্তি। যে দিন এ রাস্তা পাকা হবে, গাড়ির কালো ধোঁয়ায় বাতাস কলুষিত হবে, ঘন ঘন পর্যটক সমাগমের ঢল নামবে, সে দিনই দূষণের করাল থাবায় দীর্ণ হতে শুরু করবে চিন্তাফু।
লেখিকা সোহিনী দেবরায় বর্তমানে এক NGO-র সঙ্গে যুক্ত। তাঁর লেখার মূল বিষয় প্রধানত ভ্রমণকাহিনী। তবে রূপকথা, বিজ্ঞানবিষয়ক ও সামাজিক বিষয়ে বেশ কিছু লেখা হয়েছে। এই সময় ডিজিটালের সঙ্গে নিজের ব্যক্তিগত ভ্রমণ অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিয়েছেন সোহিনী।
Lifestyle News in Bengali, লাইফস্টাইল খবর, Health Tips, Fashion Trends and Tips in Bangla
2021-06-27 12:11:29
Source link
Leave a Reply