দেখলাম, লখনউতে ঘোরার জায়গা বলতে সুবিখ্যাত ইমামবড়া (বড় এবং ছোটো), রুমি দরওয়াজা, দিলখুশা কোঠি, ছত্তর মঞ্জিল, হুসাইনাবাদ ক্লক টাওয়ার, বেশ কিছু পার্ক – যেমন জ্ঞানেশ্বর মিশ্র পার্ক, আম্রপালী ওয়াটার পার্ক, রাম মনোহর লোহিয়া পার্ক, ফোর সিজনস ওয়াটার পার্ক, গোমতী পার্ক ও আম্বেদকর পার্ক। এ ছাড়া, নবাব ওয়াজিদ আলি শাহের চিড়িয়াখানা, ইন্দিরা গান্ধী প্ল্যানেটোরিয়াম, জামা মসজিদ। লখনউ চিকন এবং অন্যান্য শৌখিন জিনিসপত্তর কেনার জন্য আমিনাবাদ, চওক ও হজরতগঞ্জ বাজার, রাজ্য সংগ্রহালয়, চন্দ্রিকা দেবীর মন্দির, সাতখণ্ড, কন্সট্যানশিয়া হাউজ এবং অবশ্যই ব্রিটিশ রেসিডেন্সি। হিসেব কষে দেখলাম,শুধুমাত্র বিখ্যাত ভোজনশালাগুলোয় খাওয়াদাওয়া নিয়ে ব্যস্ত থাকলে মাত্র তিন দিনে এত জায়গা ঘোরা সম্ভব নয়। কিন্তু কোন জায়গা দেখব আর কোন জায়গা দেখব না, তা কোন ভিত্তিতে ছেঁকে নেওয়া যায়?
ঠিক করলাম, প্রতিটা জায়গার ব্যাপারেই কিছু পড়াশোনা করতে হবে। প্রথমেই পার্কগুলো বাদ পড়ল। ‘প্রায়োরিটি লিস্ট’-এ স্থান পেল ঐতিহাসিক স্থান সমূহের নাম। তার মধ্যে আগে নজর কাড়ল ‘ব্রিটিশ রেসিডেন্সি‘৷
১৭৭৫ সালে যখন অযোধ্যার রাজধানী ফৈজাবাদ থেকে লখনউতে স্থানান্তরিত করা হয়, তখন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি অনুসারে অযোধ্যার নবাব সুজাউদ্দৌলা রাজি হন একজন ব্রিটিশ নাগরিককে লখনউ দরবারে স্থান দিতে। তাঁর উদ্যোগেই শহরের কেন্দ্রে ইংরেজদের এই আবাসস্থল তৈরি হওয়ার কাজ শুরু হয়। সম্পূর্ণ হতে সময় লাগে মোটামুটি পাঁচ বছর। ১৮০০ সালে নবাব সাদাত আলি খানের শাসনকালে এই ভবন ইংরেজদের বসবাসের জন্য ব্যবহার করা শুরু হয়। নবাব সাদাত আলি খান লখনউতে মোতায়েন ব্রিটিশ ফৌজের ক্যাপ্টেন জন বেইলি সাহেবের সম্মানার্থে বেইলি গেট-ও তৈরি করেন, যা এই আবাসস্থলের প্রধান প্রবেশদ্বার। ইংরেজরা নিশ্চিন্তে, নিরাপদে জাঁকিয়ে বসেন। কিন্তু সে সুখ দীর্ঘস্থায়ী হল কই! ঠিক যেমন অজানা মন্ত্রের টানে খাঁচার পাখি হঠাৎ নীল আকাশে ডানা ঝাপটায়, কিংবা দীর্ঘ কাল পায়ে লোহার বেড়ি পরা আপাতদৃষ্টিতে দুর্বল ও শান্ত বন্দি হাতি হঠাৎ একদিন নিজের শক্তি সম্পর্কে সচেতন হয়ে সব বাঁধন ভেঙে ফেলে- ঠিক সে ভাবেই পরাধীন দেশের মানুষ এক শতাব্দীর গোলামির জ্বালা ভোগ করার পরে আচমকা বিদ্রোহ ঘোষণা করে।
ইতিহাসবিদদের একাংশের মতে, ১৮৫৭ সালের ১০ মে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে সিপাহি বিদ্রোহই ছিল ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ। ধীরে ধীরে এই বিদ্রোহ বর্তমান উত্তরপ্রদেশ, বিহার, মধ্য প্রদেশের উত্তরাঞ্চল ও দিল্লিতে চরম আকার ধারণ করে। ৩০ মে থেকে ২৭ নভেম্বর অবধি লখনউতে বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়েছিল। অওধের নির্বাসিত নবাব ওয়াজিদ আলি শাহের বীরাঙ্গনা বেগম হজরত মহল, ১১ বছরের পুত্র বিরজিস কদ্র, বরকৎ আহমেদ ও আহমেদুল্লাহ শাহের নেতৃত্বে থাকা ক্ষিপ্ত সিপাহিরা ব্রিটিশ রেসিডেন্সিতে থাকা ইংরেজদের ওপর আক্রমণ হেনেছিল। কামানের গোলা, বন্দুকের গুলিতে এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে গিয়েছিল রেসিডেন্সির দেওয়াল। প্রাণভয়ে ইংরেজরা বাধ্য হয়েছিল আশ্রয় ছেড়ে পালাতে। বিদ্রোহ প্রশমিত হলে পরবর্তীকালে অবশ্য বাসিন্দারা ফিরেছিলেন রেসিডেন্সিতে। তবে যে ইংরেজরা ভেবেছিল তাদের আবাসস্থলের মাথায় চিরস্থায়ী হয়ে থাকবে ইউনিয়ন জ্যাক, সেখানেই আজ গৌরবের সঙ্গে উড়ছে ভারতের স্বাধীন ভারতের তেরঙা পতাকা। তার দিকে যত বার চোখ পড়ে, অজান্তেই বুকের ভেতর যেন অব্যক্ত যন্ত্রণা হালকা মোচড় দেয়। ১৯২০ সালে এই ভবন প্রথম সংরক্ষণ করার কাজ শুরু হয়৷ বর্তমানে এটি এশিয়াটিক সোসাইটির তত্ত্বাবধানে রয়েছে।
ইংরেজদের জন্য তৈরি হওয়া এই বাসস্থানকে কেন্দ্র করে লখনউ শহরজুড়ে যে ইতিহাসের এত সাক্ষ্য লুকিয়ে রয়েছে, তা এতদিন কেন পাঠ্যবইয়ের পাতায় জানতে পারিনি ভেবে একটু হতাশই হলাম। অবশ্য তৎকালীন ভারতে স্বাধীনতা আন্দোলনের যে উদ্দাম হাওয়া বয়েছিল, সেই হাওয়ায় তো কত ঘটনাই ঘটেছিল, যা বিস্মৃতির ধুলোয় ক্রমে চাপা পড়ে গিয়েছে। ছাপা বইয়ের অক্ষর তার সামগ্রিক রূপ ধরে রাখা হয়ত অসম্ভবই।
Lifestyle News in Bengali, লাইফস্টাইল খবর, Health Tips, Fashion Trends and Tips in Bangla
2021-06-17 12:04:11
Source link
Leave a Reply