প্রযুক্তির সহায়তায় নারী উৎপীড়ন
প্রয়োজন নীতিমালা ও সামাজিক সচেতনতা
রাজধানীর একটি স্বনামধন্য ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের ছাত্রী মাইশা (ছদ্মনাম)। প্রতিরাতে মাইশা ফেসবুক খুলে বসে এবং সেখানে তার অসংখ্য বন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ হয়। মাইশার এক বন্ধু একদিন তাকে আমন্ত্রণ জানায় সামনাসামনি দেখা করার। বন্ধুর সঙ্গে দেখা হওয়ার পর মাইশা আপত্তিকর পরিস্থিতির শিকার হয় এবং সেই ভয়াবহ পরিস্থিতি মেনে নিতে না পেরে সে এখন মানসিক ভারসাম্যহীন।
বাংলাদেশ মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রী মুনিয়া আহমেদ। কদিন আগে রিকশায় যাচ্ছিলেন। ট্রাফিক সিগন্যালে রিকশা দাঁড়িয়ে থাকার সময় খেয়াল করলেন পাশ থেকে একটি ছেলে মোবাইল ফোনের ক্যামেরায় তার ছবি তুলছে। বুঝতে পেরে দুই হাতে মুখ ঢেকে ফেলেন মুনিয়া।
প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথে সাথে ইভটিজিংয়ে (নারীকে উত্ত্যক্ত করা) যুক্ত হয়েছে নতুন মাত্রা। সাম্প্রতিক সময়ে ইন্টারনেটে ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ সাইটের মাধ্যমে প্রতারিত হচ্ছে বিভিন্ন বয়সের নারী। মোবাইল ফোনের ক্যামেরা দিয়ে ছবি তোলা, ভিডিও করা, নগ্নছবি এমএমএস করা এমন সব বিব্রতকর ঘটনার সম্মুখিন হতে হচ্ছে তাদের। শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে বড়রাও এসব পরিস্থিতির শিকার হচ্ছে। এ বিষয়গুলো নিয়ে অভিভাবক থেকে শুরু করে সমাজের প্রতিটি বিবেকবান মানুষ এখন উদ্বিগ্ন।
ভিকারুন নিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের কয়েকজন ছাত্রী বললেন, কলেজের গেট পেরুতেই মোবাইল বেজে ওঠে, ফোন ধরতেই কেমন আছ, আমি তোমার শুভাকাঙক্ষী, বন্ধুত্ব করতে চাই কিংবা তোমাকে ভালোবাসিণ্ড বাসায় না পৌঁছানো পর্যন্ত শুনতে হয় এমন ভালো-মন্দ নানা টিজিং। এসব কথার পরিপ্রেক্ষিতে রেগে গেলে শুনতে হয় আজেবাজে কথা। নয়তো মিসকল দিয়ে অতিষ্ঠ করে তোলে। ফোন রিসিভ না করলে আপত্তিকর ম্যাসেজ ও অশ্লীল ছবি পাঠায়।
ঢাকার কয়েকটি স্কুল-কলেজ পাড়া সরেজমিন পরিদর্শন করে ও অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এসব তথ্য। স্কুল-কলেজে আসা যাওয়ার সময়, বিশেষ করে বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজগুলোর আশেপাশে ছুটির সময়ে বখাটে দলের উপস্থিতি ইদানিং কিছুটা কমে গেলেও এখন ফেসবুক ও মোবাইল ফোনের মাধ্যমে নারীরা উত্ত্যক্ত হচ্ছে বেশি। উচ্চবিত্তরা উত্ত্যক্ত করছে আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে, আর যারা ইন্টারনেট ব্যবহার করছে না তারা গলির মুখে, চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন আওয়াজ বা মন্তব্য ছুঁড়ে উত্ত্যক্ত করছে। এর সঙ্গে শীষ বাজানো, চোখ টিপ্পনী দেয়া, মোবাইল ফোনে মিসকল ও আপত্তিকর বার্তা পাঠানো, ভিড়ের মধ্যে ধাক্কা দেওয়া, ইঙ্গিতপূর্ণভাবে সিগারেটের ধোঁয়া ছোড়া, যানবাহনের ভেতর খোঁচা মারার মত বিষয়গুলো তো রয়েছেই।
আইনজীবী, মানবাধিকার কর্মী, জেন্ডার বিশেষজ্ঞ, সরকারের আইনরক্ষাকারী সংস্থার সদস্যরা বলেন, বখাটে বা উত্যক্তকারীরা এখন শুধু স্কুল-কলেজের সামনে বা রাস্তা-ঘাটেই মেয়েদের উত্ত্যক্ত করে ক্ষান্ত হচ্ছে না, তারা ব্যবহার করছে উন্নত সব প্রযুক্তি। এসব অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে নীতিমালা মেনে চলার আইন না থাকলে সমাজে এই পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।
মনোবিশেষজ্ঞ ডা. মোহিত কামাল বলেন, দেশে এখন সাইবার ক্রাইমও হচ্ছে। এজন্যে আইন দরকার এবং সমাজের সচেতনতা দরকার। সাইবার ক্রাইমের কারণে আত্নহত্যার ঘটনা ঘটছে ও মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ছে অনেকে। এছাড়া অনেকে নানা ধরনের মানসিক জটিলতার শিকার হচ্ছেন। তিনি বলেন, শুধু আইন করে এসব দূর করা সম্ভব নয়, এজন্য চাই সমাজের সচেতনতা।
ইয়াসমিন পিউ
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, ডিসেম্বর ২৮, ২০০৯
Leave a Reply