বিশ্বে প্রতি ছয় সেকেন্ডে একজন স্ট্রোকে মারা যাচ্ছেন। এসব আক্রান্ত ব্যক্তির কেউ হতে পারেন আপনার মা-বাবা, ভাইবোন, নিকটাত্মীয়, এমনকি আপনি নিজেও। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ বা স্ট্রোক যেমন ব্যক্তিগত, সামাজিক ও পারিবারিক সমস্যা, একই সঙ্গে অনেক মানুষ হারাচ্ছে তাদের কর্মক্ষমতা, হচ্ছে প্রচুর অর্থ ব্যয়। সুতরাং স্ট্রোক জাতীয় ও বিশ্বজনীন সমস্যা। এ রোগ সম্পর্কে সচেতন করতে প্রতিবছরের ২৯ অক্টোবর পালিত হচ্ছে বিশ্ব স্ট্রোক দিবস। স্ট্রোককে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় সেরিব্রভাসকুলার অ্যাকসিডেন্ট বলা হয়। মস্তিষ্কের রক্তবাহী নালির দুর্ঘটনাকেই স্ট্রোক বলা যায়। এ দুর্ঘটনায় রক্তনালি বন্ধও হতে পারে, আবার ফেটেও যেতে পারে। আমাদের দেশে প্রচলিত একটি ধারণা আছে যে স্ট্রোক একটি হূৎপিণ্ডের রোগ। বাস্তবে এটি মোটেই সত্য নয়। স্ট্রোক সম্পূর্ণই মস্তিষ্কের রক্তনালির জটিলতাজনিত রোগ।
স্ট্রোক কেন হয়?
উচ্চ রক্তচাপ স্ট্রোকের সবচেয়ে বড় কারণ। এ ছাড়া ধূমপান, মাদক সেবন, অতিরিক্ত টেনশন, হূদেরাগ, ডায়াবেটিস, স্ট্রোকের পারিবারিক ইতিহাস, রক্তে বেশি মাত্রায় চর্বি, অতিরিক্ত মোটা হওয়া, অতিরিক্ত মাত্রায় কোমলপানীয় গ্রহণ এর আশঙ্কা বাড়ায়। কিছু কিছু ওষুধ, যা রক্ত জমাট বাঁধার ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। যেমন: অ্যাসপিরিন, ক্লপিডগ্রেল প্রভৃতি ব্যবহারে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হতে পারে।
এ বছরের বিশ্ব স্ট্রোক দিবসের স্লোগান—‘স্ট্রোক প্রতিরোধযোগ্য রোগ’। কীভাবে আমরা এই ভয়াল দানবকে রুখে দাঁড়াতে পারি?
স্ট্রোক থেকে ভালো থাকতে গেলে নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে (কমপক্ষে ৪৫ মিনিট ঘাম ঝরিয়ে হাঁটবেন)। ব্যায়াম করে কয়েক কেজি বাড়তি ওজন ঝেড়ে ফেলা যায়।
ধূমপান ও মাদক সেবনকে না বলুন।
যেকোনো পরিবেশে হাসিখুশি থাকুন।
নিয়মিত ওষুধ সেবনের মাধ্যমে উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখুন।
চর্বি ও শর্করাযুক্ত খাবার অপছন্দ করুন। ফাস্টফুড, বাদাম, সন্দেশ-রসগোল্লা, দুধ-ঘি-পোলাও-বিরিয়ানি, পাঙাশ-চিংড়ি-কাঁকড়া, গরু বা খাসির মাংস, নারকেল বা নারকেলযুক্ত খাবার, ডিমের কুসুম ইত্যাদি খাওয়া উচিত নয়।
তাহলে খাবোটা কী? ইচ্ছামতো শাকসবজি, অল্প ভাত, পাঙাশ-চিংড়ি-কাঁকড়া বাদে যেকোনো মাছ, বাচ্চা মুরগিও ডিমের সাদা অংশ খেতে পারেন।
এবার একটু চিকিৎসার দিকে চোখ ফেরাই—প্রতিটি হাসপাতালেই থাকবে একটি সুবিন্যস্ত স্ট্রোক কেয়ার ইউনিট,যেখানে ডাক্তার, নার্স, থেরাপিস্ট এবং অন্যান্য বিশেষজ্ঞ একসঙ্গে এক সমন্বিত পরিকল্পনার মাধ্যমে স্ট্রোক রোগীর চিকিৎসাদেবেন।
হাসপাতালের উপস্থিত ব্যবস্থাকে একটু পরিবর্তন করেই বিশেষ কোনো বাড়তি ব্যয় ছাড়া এইস্ট্রোক কেয়ার ইউনিট তৈরি করা সম্ভব। একজন স্ট্রোক রোগীর যেমন প্রয়োজন হয় নিউরোলজিস্টের চিকিৎসা, তেমনি একই সঙ্গে কোনো কোনো স্ট্রোক রোগীর অপারেশন অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। যেসব ক্ষেত্রে নিউরোসার্জনের উপস্থিতি একান্ত কাম্য।
পাশাপাশি অনেক স্ট্রোক রোগীর হার্টের রোগ থাকে। এসব ক্ষেত্রে কার্ডিওলজিস্টের পরামর্শের প্রয়োজন হয়। দীর্ঘদিন অজ্ঞান হয়ে থাকলে শ্বাসকষ্ট, বেডসোর প্রভৃতি সমস্যা দেখা দেয়। সুতরাং রেসপিরেটরি মেডিসিন স্পেশালিস্ট, প্লাস্টিক সার্জনসহ সবার সহযোগিতার প্রয়োজন হয়। রোগীর রিহ্যাবিলিটেশন বা পুনর্বাসনের জন্য ফিজিওথেরাপিস্ট নানাবিধ ব্যায়ামের মাধ্যমে রোগীর অঙ্গ সঞ্চালন করে জড়তা কাটিয়ে তোলেন। অনেক রোগী কথা বলতে পারেন না। তাঁদের জন্য প্রয়োজন স্পিচথেরাপি। আবার কেউ কেউ কথা বোঝেন না, তাঁদের শেখাতে হয় সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ।
রোগী দীর্ঘ সময় অজ্ঞান থাকলে পুষ্টি নিয়ন্ত্রণের জন্য নিউট্রিশনিস্ট প্রয়োজন হয়। সুতরাং বাংলা প্রবাদবাক্য ‘দশে মিলে করি কাজ, হারিজিতি নাহি লাজ’—এ কথা অনুধাবন করে সবাই যদি সবার হাত ধরে গড়ে তুলি এসব ক্ষেত্রে স্ট্রোক কেয়ার ইউনিট, যেখানে সমন্বিত স্ট্রোক কেয়ার টিমের ব্যবস্থাপনায় চিকিৎসায় আসবে সুফল, রোগী ও রোগীর স্বজন হবেন চিন্তামুক্ত, রোগী লাভ করবে আরোগ্য।
সুদীপ্ত কুমার মুখার্জি
নিউরোসার্জন, শহীদ শেখ আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতাল, খুলনা
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, নভেম্বর ০২, ২০১১
Leave a Reply