আজ যাঁরা নবীন, আগামী দিনে তাঁরাই নেতৃত্ব দেবেন। পেশার জগতে এ কথা বলা যায় এমনভাবে—আজ যাঁরা ম্যানেজমেন্ট ট্রেইনি মানে প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনায় শিক্ষানবিশ, তাঁরাই ভবিষ্যতে হবেন প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার বা নীতিনির্ধারক। প্রতিষ্ঠিত দেশি-বিদেশি ব্যাংক ও বহুজাতিক কোম্পানিগুলোয় যাঁদেরই ‘ম্যানেজমেন্ট ট্রেইনি’ হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে, তাঁরাই একদিন হবেন প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন বিভাগের প্রধান এবং নেতৃত্ব দেবেন সামনে থেকে—এমনটাই আশা করে প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ।
ম্যানেজমেন্ট ট্রেইনি কী
ম্যানেজমেন্ট ট্রেইনি হলো কোনো প্রতিষ্ঠানের মূলধারা বা ব্যবস্থাপনা-সংক্রান্ত কাজে ঢোকার জন্য একেবারে শুরুর স্তরের (এন্ট্রি লেভেল) পদ। ম্যানেজমেন্ট ট্রেইনি পদে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মীরাই সংগঠন কাঠামোর সিঁড়ি বেয়ে একসময় প্রতিষ্ঠানের নীতিনির্ধারকে পরিণত হন। কাজেই ম্যানেজমেন্ট ট্রেইনি হিসেবে কেউ কোনো সুপ্রতিষ্ঠিত সংগঠনে যোগ দিতে পারলে, তিনি সাফল্যের প্রথম ধাপে পা রাখবেন—এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায়।
এই প্রসঙ্গে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান ইউনিলিভার বাংলাদেশের একজন মানবসম্পদ ব্যবস্থাপক বলেন, ‘আমরা আমাদের ম্যানেজমেন্ট ট্রেইনিদের ফিউচার লিডার বা ভবিষ্যত্ নেতা হিসেবে বিবেচনা করে থাকি। এ জন্য তাঁদের নির্বাচন-প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে পুরো পেশাজীবনের রূপরেখা নিরূপণের জন্য দরকারি নির্দেশনাও দিয়ে থাকি।’
সুযোগ আছে যেখানে
এখন ব্যবসায় প্রশাসন বা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কোনো বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থীদের প্রথম পছন্দ কোনো বহুজাতিক বা প্রতিষ্ঠিত কোনো ব্যাংকের চাকরিতে যোগ দেওয়া। কারণ, এসব প্রতিষ্ঠানই দিচ্ছে সম্মানজনক অবস্থান, কাজ করার চমত্কার পরিবেশ এবং আকর্ষণীয় বেতন। তাই তো সদ্য স্নাতক বা স্নাতকোত্তর চাকরিপ্রার্থীদের লক্ষ্য থাকে, এসব নামকরা প্রতিষ্ঠানের চাকরি শুরু করা।তাঁরা চান নিজেদের পেশাজীবনের শুরুতেই একটা ভালো অবস্থানে গিয়ে প্রতিযোগিতাপূর্ণ চাকরির মাঠে অন্যদের চেয়ে এগিয়ে রাখা।
জানা গেছে, বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান, মুঠোফোন সেবাদাতা, বেসরকারি দেশি ও বহুজাতিক ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, খ্যাতনামা আবাসন, আমদানিকারক, শেয়ার ট্রেডিং ও ব্রোকারেজ প্রতিষ্ঠানে ম্যানেজমেন্ট ট্রেইনি পদ রয়েছে। এই পদটি যদিও মোটামুটি আগে থেকেই দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে রয়েছে, তবে এ পদটিতে প্রার্থী নির্বাচন, মূল্যায়ন ও নিয়োগদানের ক্ষেত্রে বর্তমান সময়ে নানা পরিবর্তন ও উত্কর্ষ সাধিত হয়েছে।
নিয়োগ প্রক্রিয়া যেমন
বর্তমানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজমেন্ট ট্রেইনি নিয়োগ-প্রক্রিয়ার দিকে খেয়াল করলে দেখা যায়, সেখানে লিখিত পরীক্ষা, প্রাথমিক সাক্ষাত্কার, উপস্থাপনা, দ্বিতীয় দফা সাক্ষাত্কার ও চূড়ান্ত সাক্ষাত্কার ইত্যাদি ধাপ রয়েছে। প্রতিটি ধাপেই বিপুল সংখ্যক প্রার্থীর থেকে ধাপে ধাপে যোগ্যদের নির্বাচন করা হয়ে থাকে। এখানে জীবনবৃত্তান্ত তৈরি করা থেকে প্রার্থীর আচার-আচরণ, কথাবার্তা, বুদ্ধিদীপ্ততা, প্রত্যুত্পন্নমতিতা ইত্যাদি খুব নিখুঁতভাবে পর্যবেক্ষণ করেন নিয়োগ বোর্ডের সদস্যরা।
লিখিত পরীক্ষায় যাঁরা ভালো করেন এবং যাঁদের উপস্থাপনা শৈলী ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে দক্ষতা রয়েছে, তাঁদেরই এখানে নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ ও সম্ভাবনা বেশি থাকে।
এ প্রসঙ্গে ব্র্যাক ব্যাংকের মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রধান তাহনিয়্যাত আহমেদ করিম বলেন, ‘আমাদের এখানে ম্যানেজমেন্ট ট্রেইনি নিয়োগ-প্রক্রিয়াটি ধাপে ধাপে সম্পন্ন হয়ে থাকে। প্রথম পর্যায়ে আমরা স্নাতকে যাঁদের কমপক্ষে সিজিপিএ ৪.০০-এর মধ্যে ৩.০০ রয়েছে, তাঁদের কাছ থেকে জীবনবৃত্তান্ত আহ্বান করি। সেটি দেখে প্রথম বাছাইয়ের মাধ্যমে সাক্ষাত্কারের জন্য অনেককে ডাকা হয়। এখানে তাঁদের আইকিউ, বোঝার বা শেখার ক্ষমতা, প্রত্যুত্পন্নমতিতা ইত্যাদি দেখা হয়। তারপর এখান থেকে প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত প্রার্থীদের লিখিত পরীক্ষা, উপস্থাপনা (প্রেজেনটেশন) ও চূড়ান্ত মৌখিক পরীক্ষার পর্ব পার করে চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত হওয়ার পর্যায়ে উঠে আসতে হয়।’
ম্যানেজমেন্ট ট্রেইনি পদের জন্য যাঁরা আবেদন করতে চান, তাঁদের সবারই উচিত সুন্দরভাবে তাঁদের জীবনবৃত্তান্ত তৈরি করে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে জমা দেওয়া। এ প্রসঙ্গে তাহনিয়্যাত আহমেদ করিম বলেন, “যাঁরা ব্র্যাক ব্যাংকের ম্যানেজমেন্ট ট্রেইনি হিসেবে আবেদন করতে চান, তাঁদের প্রতি আমাদের উপদেশ হলো, তাঁরা যেন সবার আগে সুন্দর ও নিখুঁতভাবে তৈরি করেন তাঁদের জীবনবৃত্তান্ত। কাট-কপি-পেস্ট করে অর্থাত্ অন্যের করা জীবনবৃত্তান্তের অনুকরণেনিজেরটা তৈরি করা উচিত নয়। বানান ভুল ও ব্যাকরণগত ভুল এড়িয়ে যেতে হবে। জীবনবৃত্তান্ত হতে হবে খুব ‘সুনির্দিষ্ট’, যেন সেটা দেখলেই বোঝা যায়, নির্দিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠানের নির্দিষ্ট কোনো পদের জন্যই তৈরি করা হয়েছে।”
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ম্যানেজমেন্ট ট্রেইনি পদের জন্য ইউনিলিভার, ব্রিটিশ-আমেরিকান টোব্যাকো, নেসলে—এ তিন বহুজাতিক কোম্পানি, ফিনান্সিয়াল ইনস্টিটিউটশন আইডিএলসি ও ব্র্যাক ব্যাংকে সদ্য স্নাতক প্রার্থীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। বহুজাতিক ব্যাংক স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ও এইচএসবিসিতেও সদ্য স্নাতকদের সুযোগ দেওয়া হয়। তবে বহুজাতিক ব্যাংক সিটিব্যাংক এনএ এবং অন্য সব দেশি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন প্রার্থীদেরই বেশি সুযোগ দেওয়া হয়।
নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরাই এখানে নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রাধান্য পেয়ে থাকেন। আর দেশের বাইরের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি সম্পন্ন করে এলে সেটাও বিশেষ বিবেচনায় নেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে যে যোগ্যতা চাওয়া হয়, তা হলো প্রার্থীকে এসএসসি, এইচএসসি, স্নাতক (সম্মান), স্নাতকোত্তর এই চারটি পরীক্ষার কমপক্ষে দুটিতে প্রথম শ্রেণী বা সিজিপিএ ৩.০০ থাকতে হবে।
আছে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ
ম্যানেজমেন্ট ট্রেইনি হিসেবে যাঁদের নির্বাচন করা হয়, তাদের সব প্রতিষ্ঠানেই মোটামুটি এক-দুই বছরের জন্য অন দ্য জব বা কাজের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তারপর তাঁদের কর্মদক্ষতা ও আগ্রহ অনুসারে প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন বিভাগে নিয়োগ দেওয়া হয়। ব্যাংকগুলোয় দুই বছর ম্যানেজমেন্ট ট্রেইনি অফিসার হিসেবে কাজ করার পর তাঁদের নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়। অন্যান্য পদে ঢোকা চাকুরেদের তুলনায় তাঁদের পদোন্নতি খুব দ্রুত হয় এবং বেতনও বাড়ে সেই অনুপাতে। কাজেই ম্যানেজমেন্ট ট্রেইনি হিসেবে কেউ যোগদান করায় সফল হতে পারলে তিনি সাফল্যের প্রথম সোপান বা ধাপে পা রাখবেন এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
কৃতজ্ঞতা: এমজিএইচ
মুহাম্মদ লুতফুল হক খান
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ডিসেম্বর ১৯, ২০০৯
Leave a Reply